কসোভো ভ্রমণের গল্প-৩
গাজমেন্দের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর আমি আবার সেন্টারের দিকে হাঁটতে থাকলাম। সেন্টারের কাছে পা রাখতে এক বিশাল আকারের চার্চ দেখতে পেলাম। কসোভোর প্রধান ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে চার্চটিকে বিবেচনা করা হয়। চার্চটির নাম রাখা হয়েছে মাদার তেরেসার নামে। মাদার তেরেসার জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট স্কুপিয়ের এক আলবেনিয় পরিবারে। স্কুপিয়ে বর্তমানে মেসিডোনিয়ার রাজধানী, যদিও অনেক আলবেনিয়ানদের মতে অটোমানরা আসার আগে স্কুপিয়ে নাকি গ্রেটার আলবেনিয়ার রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। মাদার তেরেসাও আলেবেনিয়ানদের কাছে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। আলবেনিয়ানদের অনেকে নিজেদের মাদার তেরেসার জাতি হিসেবে পরিচয় দেন।
সেন্টারের কাছে এক দোকান থেকে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। সার্বিয়ানদের মতো কসোভোর অধিবাসীরাও গ্রিলজাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। এ ছাড়া সুজুক নামের এক বিশেষ ধরনের সসেজের উপস্থিতি দেশটির সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় বিশেষভাবে অগ্রাধিকার পায়। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো বলকান দেশগুলোতে কাবাব ব্যাপক জনপ্রিয় যদিও রান্নার ধরন স্থানভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো কসোভোর সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসও অটোমানদের দ্বারা প্রভাবিত।
ওয়েটারের পরামর্শে দুপুরের খাবারে মিক্সড কাবাব প্ল্যাটার অর্ডার করলাম। কাবাবের সঙ্গে মাশরুমের সস সার্ভ করা হয়েছিল। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ ঝাল ও মসলাদার খাবারে অভ্যস্ত, অন্যদিকে কসোভোর বেশির ভাগ খাবারে ঝাল ও মসলার ব্যবহার নেই বললে চলে। এ ছাড়া আমাদের দেশে বেশির ভাগ বাসাবাড়ি কিংবা হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে মাংস রান্না করার সময় জ্বাল দিতে দিতে একেবারে সেদ্ধ ও নরম করে ফেলা হয়। কসোভোতে এমনটি হয় না। দেশটির বেশির ভাগ মানুষ একটু শক্ত থাকা অবস্থায় মাংসের স্বাদ নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
দুপুরের খাবার শেষে বাসে করে ছুটে গেলাম গারমিয়া পার্কের দিকে। প্রিস্টিনার গণপরিবহন পরিষেবার মান সত্যি আশানুরূপ, তবে এ শহরের বেশির ভাগ সড়ক বেশ ঘিঞ্জি। এ কারণে প্রায়ই গাড়ির লম্বা জট দেখা যায়।
কর্মব্যস্ত দিন শেষে ক্লান্ত প্রিস্টিনাবাসী প্রকৃতির বুকে বিশ্রাম নিতে এ পার্কে হাজির হন। গরমের দিনে এ পার্কে এত বেশি লোকের সমাগম হয় যে তিল ধারণের ঠাঁই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে শীতের দিন হওয়ায় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পার্কটিকে সে রকম একটা মোহিত রূপে দেখতে পাইনি। প্রকৃতি এ সময় বেশ রুক্ষ, চারপাশের গাছপালা ও লতাপাতা সবুজের রূপ হারিয়ে অনেকটা বিবর্ণ রূপে আমার চোখে ধরা দিচ্ছিল। কয়েক দিন আগের বৃষ্টি ও তুষারপাত পার্কের অভ্যন্তরে চলাচলের রাস্তাকে পুরোপুরি কর্দমাক্ত করে তুলেছিল। তবে পার্কের আশপাশে নেড়ি কুকুরের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ইউরোপের রাস্তাঘাটে অবশ্য খুব একটা নেড়ি কুকুরের উপস্থিতি দেখা যায় না; কিন্তু স্থানটিকে আমার কাছে আলাদা মনে হলো। পার্কের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ কাঠের তৈরি এক রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে ভেসে আসা গ্রিলের গন্ধ খাবারের প্রতি আমার লালসাকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ছুটির দিন হওয়ায় রেস্টুরেন্টের ভেতরে মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
বেশ কিছুক্ষণ পার্কের ভেতর হাঁটাহাঁটি করার পর ফোর নম্বর বাসে করে সেন্টারে ফিরে আসলাম। আগেই বলেছি কসোভোতে শতকরা ৯৭ ভাগের মতো মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন। দেশটিতে ইসলামের আগমন ঘটেছে তুর্কিদের হাত ধরে। এ জন্য কসোভোর বেশির ভাগ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী অটোমানদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অটোমান সুলতান মেহমেত ফাতিহ কর্তৃক ১৪৬১ সালে নির্মিত পাথরের মসজিদটি প্রিস্টিনার সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদের মধ্যে একটি। স্থানীয় ব্যক্তিরা এ মসজিদের নাম দিয়েছেন জামিয়া ছারা। মাগরিবের নামাজ এ মসজিদে আদায় করলাম। কসোভোর ন্যাশনাল মিউজিয়াম এ মসজিদের পাশে।
রোমান্স ও ভালোবাসার শহর প্রিজরেন
দ্বিতীয় দিন আমার গন্তব্য ছিল প্রিজরেন। কসোভোর স্থানীয় জনসাধারণের মতে প্রিজরেন হচ্ছে রোমান্স ও ভালোবাসার শহর। বেশির ভাগ দর্শনার্থী, যাঁরা কসোভোতে বেড়াতে আসেন, তাঁদের প্রধান গন্তব্য থাকে প্রিজরেন নামের ছোট এক শহর। প্রিজরেন বিস্ট্রিকা নামের নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ শহরের ওল্ড টাউনটি বেশ পরিচিত। এটা ঠিক যে কসোভোতে সে অর্থে বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা নেই। কসোভো থেকে ফেরার সময় ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তে মাঝবয়সী এক নারী পুলিশ অফিসার আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কেন কসোভোতে যাচ্ছি। আমার পরিবারের কেউ কসোভোতে বসবাস করেন কি না, সে বিষয়েও তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন। বললাম, দেশটিকে ঘুরে দেখার জন্য। উত্তর শুনে তিনি হাসতে থাকলেন। তিনি জানালেন, তাঁর পেশাগত জীবনে তিনি খুব মানুষকে খুঁজে পাননি, যাঁরা ভ্রমণের উদ্দেশে কসোভোতে যান। তাই এতটুকু বলা যায়, প্রিজরেনে আসা দর্শনার্থীদের বেশির ভাগ স্থানীয় পর্যটক। অবশ্য আলবেনিয়া থেকেও অনেকে পর্যটক হিসেবে কসোভোতে বেড়াতে আসেন। এর বাইরে আমার চোখে প্রিস্টিনা, প্রিজরেন কিংবা পেয়া কোথাও বিদেশি পর্যটক সেভাবে চোখে পড়েনি।
ঐতিহাসিকভাবে প্রিজরেন খুবই সমৃদ্ধ একটি শহর। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য, সার্বিয়ান সাম্রাজ্য এবং তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য—তিন সাম্রাজ্যের পদচারণ পড়েছে এ শহরে। প্রথম দেখায় যেকোনো মানুষ প্রিজরেনকে তুরস্কের কোনো শহর হিসেবে বিবেচনা করে ভুল করতে পারেন। সুলতান সোলায়মান কিংবা দিদিলিস এর্তুগরুলের মতো তুর্কি সিরিয়ালগুলোতে মধ্যযুগের তুরস্ককে যেভাবে দেখানো হয় প্রিজরেনকে দেখতে ঠিক একই রকম লাগে। এ শহরের অধিবাসীরাও আলবেনিয়ান ভাষার সঙ্গে তুর্কি ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। ওসমানী সাম্রাজ্যের শাসনামলে নির্মিত মসজিদ ও হাম্মামখানা, পাথরের তৈরি আর্কশেপের ব্রিজ কিংবা ওই সময়কার ঘরবাড়িগুলোর দিকে তাকালে সত্যি মনটা আনন্দে ভরে যায়। মানবসৃষ্ট স্থাপনার এক অসাধারণ রূপ খুঁজে পেলাম এ প্রিজরেন শহরে। সার্বিয়ানদের নিকট এ শহর বিশেষভাবে পবিত্র। প্রিজরেনে বেশ কয়েকটি অর্থোডক্স চার্চ রয়েছে যেগুলোর প্রত্যেক সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে বিশ্বাসী মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তবে সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে এসব চার্চ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত সার্বিয়ান ক্যাথেড্রাল মাদার অব গড অব লিয়েভিশ সবচেয়ে প্রাচীন সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চগুলোর মধ্যে একটি। চার্চটি এখন পরিত্যক্ত যদিও চার্চের আশপাশে সব সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত প্রিজরেন ফোরট্রেস শহরটির অন্যতম আকর্ষণ। যদিও ফোরট্রেসটি প্রথম নির্মাণ করা হয় বাইজেনটাইন শাসনামলে, পরবর্তী সময়ে সার্বিয়ান ও অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকেরাও ফোরট্রেসটিকে ঘিরে তাঁদের শাসনকালের স্বাক্ষর রেখেছেন। পাহাড়ি পথ ধরে খাড়া ওপরের দিক কয়েক মিনিট হাঁটলে এ ফোরট্রেসের দেখা মেলে। ফোরট্রেস থেকে এক অসাধারণ রূপে প্রিজরেনের ওল্ড টাউন ও আশপাশের পাহাড়গুলোর ছবি ভেসে ওঠে। বিশেষ করে ফোরট্রেস থেকে সূর্যাস্তের স্বাদ পাওয়ার অনুভূতি ছিল অন্য রকম। ফোরট্রেসের ভেতর পা রাখতে নিউজিল্যান্ডের এক পর্যটকের সঙ্গে পরিচয় হলো। নাম অ্যালেক্স রথম্যান, এখন তার বাস উজবেকিস্তানে। অ্যালেক্স পেশায় একজন শিক্ষক। বাংলাদেশ থেকে এসেছি, কথাটি শোনার পর অ্যালেক্স বললেন, উজবেকিস্তানের তাসখন্দের বাংলাদেশ দূতাবাসে যিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর মেয়েকেও তিনি পড়িয়েছেন। চলবে...
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।