কসোভো ভ্রমণের গল্প-২
যুগোস্লাভিয়া শাসনামল থেকে কসোভো অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে ছিল। তাই সার্বিয়ার সীমানা পাড়ি দিয়ে কসোভোতে প্রবেশকালে আমাকে বেশ হতাশ হতে হয়েছিল। সরু ও জীর্ণ রাস্তাঘাট এবং রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো দিনের ঘরবাড়িগুলো দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।
প্রিস্টিনার বাসস্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইস্কান্দার নামক এক ভদ্রলোক। ইস্কান্দার আমার এক সাবেক প্রতিবেশীর ছোট ভাই। জন্মসূত্রে তিনি কসোভোর নাগরিক, তবে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন জার্মানিতে। এ কারণে তাঁর জার্মানির নাগরিকত্ব রয়েছে। ইস্কান্দার পেশায় একজন ব্যবসায়ী, সম্প্রতি কসোভোতে তিনি নিজস্ব অর্থায়নে ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশকে ঘিরে তাঁর বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল ও টেক্সটাইল জাতীয় পণ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহী। এমনকি তাঁর বিভিন্ন প্রজেক্টে তিনি বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে চান।
ইস্কান্দার আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন, এরপর তাঁর গাড়িতে করে আলবি মলে নিয়ে গেলেন। আলবি মল প্রিস্টিনার সবচেয়ে বড় শপিং মলগুলোর মধ্যে একটি। আলবি মলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। কসোভোতে জামাকাপড়ের চালানের মোটা ভাগ আসে বাংলাদেশ, চীন ও ভিয়েতনাম এ তিন দেশ থেকে। পণ্যের নিচে বাংলাদেশের পতাকার ছবি দেখতে পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে গেল। ইস্কান্দার জানালেন, বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দিককার কোনো দেশ, যাঁরা কসোভোকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনারা কসোভোতে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কসোভোর সাধারণ মানুষ এ কারণে বাংলাদেশকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
আলবি মল থেকে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। মলের ঠিক উল্টো পাশে ইউনাইটেড হোটেল নামক একটি হোটেল রয়েছে। ইস্কান্দার সেখানে আমার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করলেন। চার রাত থাকার জন্য আমাকে ৯২ ইউরো গুনতে হয়েছিল, যার পুরোটা ইস্কান্দার নিজ পকেট থেকে আমার জন্য ব্যয় করেন। উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতো কসোভোতে লোডশেডিং সমস্যা রয়েছে, দেশটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করার পর আমাকে আরও একবার হতাশ হতে হয়েছিল। দীর্ঘ সময়ের যাত্রা শেষে স্বাভাবিকভাবে শরীর ভীষণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই গোসল শেষ করে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম নিলাম।
সন্ধ্যার দিকে ইস্কান্দার তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে আবারও আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমরা একসঙ্গে তাঁর ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে গেলাম। ফ্যাক্টরি পরিদর্শন শেষে আমাদের গন্তব্য ছিল প্রিস্টিনার সিটি সেন্টার। কসোভোতে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা, তারপরও খ্রিস্টমাস উৎসবকে ঘিরে দেশটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রিস্টিনার সিটি সেন্টারে খ্রিস্টমাস মার্কেটের উপস্থিতিও লক্ষ করলাম। বিভিন্ন ধরনের আলোকসজ্জা এ মার্কেটকে একেবারে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড কিংবা আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানার তুলনায় প্রিস্টিনার সেন্টার বেশ পরিপাটি। তবে প্রিস্টিনার মূল শহরের বাইরের প্রতিচ্ছবি একেবারে ভিন্ন। প্রথম দর্শনে প্রিস্টিনাকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শহর মনে হয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসনামলে নির্মিত হলুদ কিংবা ঘি রঙের দালানকোঠার পাশে সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত ঘরবাড়ি ও দোকানপাটগুলোকে দেখলে যে কারও এ ধরনের অনুভূতি হবে।
কসোভোর সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। পশ্চিমা সংস্কৃতিকে তাঁরা অনুকরণ করতে ভালোবাসেন। দেশটির বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাঁদের স্বাধীনতাসংগ্রামে সব সময় সমর্থন জানিয়ে এসেছে। দেশটির অনেক সড়কের নামও রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামানুসারে। পূর্ব কসোভোতে অবস্থিত ফেরিজাই নামক শহরের নিকটে ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। রাতের অন্ধকারে ভালোমতো ছবি তুলতে পারছিলাম না। তাই পরের দিন ছবি তোলার জন্য আবারও প্রিস্টিনার সেন্টারে আসতে হলো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কৌচসার্ফিংয়ের বদৌলতে আমার সঙ্গে সেপটিম সুজাকু নামক এক যুবকের পরিচয় হয়েছিল। সেপটিমকে আগের থেকে অনুরোধ করেছিলাম যাতে তিনি আমাকে প্রিস্টিনা ঘুরিয়ে দেখান। সেপটিমও আমার অনুরোধ রেখেছেন। পরের দিন সকালে তাই তার সঙ্গে প্রিস্টিনা পরিদর্শনে বের হই। সেপটিম আগের থেকে আমাকে মেসেজ দিয়ে রেখেছিলেন যে আমার জন্য তিনি প্রিস্টিনা সিটি সেন্টারে অবস্থিত ন্যাশনাল থিয়েটার ভবনের সামনে অপেক্ষা করবেন। খ্রিস্টমাস মার্কেট দেখার জন্য ইস্কান্দার ও তার পরিবারের দুই সদস্যের সঙ্গে আগের দিন সন্ধ্যার দিকে এ স্থানে আসা হয়েছিল। সন্ধ্যার সময় এ স্থানে যে ধরনের জনকোলাহল লক্ষ করেছিলাম, পরের দিন সকালে একই জায়গায় ঠিক উল্টো চিত্র দেখতে পেলাম। মানুষের উপস্থিতি সে অর্থে ছিল না বললে চলে। অবশ্য খাবারের ভ্রাম্যমাণ স্টলগুলো তখনো চালু ছিল। ন্যাশনাল থিয়েটারের ঠিক উল্টো পাশে স্কেন্দারবেগের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যটি চোখে পড়ল। আলবেনিয়ান ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষের নিকট স্কেন্দারবেগ একজন বীর। অটোমানদের থেকে আলবেনিয়ানভাষী মানুষকে রক্ষা করতে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদিও তাঁর আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বর্তমানে আলবেনিয়া যদিও একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, তবে আলবেনিয়ার পাশাপাশি কসোভো ছাড়াও মেসিডোনিয়ার একটি বড় অংশের মানুষও জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান।
এমনকি গ্রিস ও মন্টিনিগ্রোতেও আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত অনেক মানুষ রয়েছে। তাদের প্রায় সবার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন আলবেনিয়া, কসোভো, মেসিডোনিয়া ও মন্টিনিগ্রোর অংশবিশেষ যেখানে আলবেনিয়ানভাষী মানুষেরা সংখ্যায় বেশি, সে এলাকাগুলোকে একত্র বৃহত্তর আলবেনিয়া গঠন করা। জোড়া ইগলের প্রতীক ব্যবহার করে তাঁরা তাঁদের এ স্বপ্নকে প্রকাশ্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আলবেনিয়ার জাতীয় পতাকায় জোড়া ইগলের ছবি রয়েছে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল উদ্যাপন করার সময় সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত দুই তারকা ফুটবলার জেরদান শাকিরি আর গ্রানিত জাহাকা বুকের কাছে দুই হাত উঁচু করে জোড়া ইগলের সিম্বলিক ছবি আঁকেন, যার কারণে তাঁদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। আলবেনিয়ার জাতীয় পতাকা কসোভো, মেসিডোনিয়া এমনকি মন্টিনিগ্রোতে বসবাস করা আলবেনিয়ানদের কাছে সমানভাবে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে আলবেনিয়ার বাইরের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বসবাস করা আলবেনিয়ানরাও জাতি হিসেবে তাঁদের স্বতন্ত্রটাকে তুলে ধরতে এবং একই সঙ্গে গ্রেটার আলবেনিয়া রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানাতে এ পতাকাকে ব্যবহার করেন।
প্রিস্টিনার সিটি সেন্টারে একসঙ্গে কিছুক্ষণ হাঁটার পর চলে গেলাম নিউবর্ন নামক এক বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভের দিকে। আগেই বলেছি যে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কসোভোর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে কসোভোর এ উত্থানকে স্মরণ করতে এ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের নামও রাখা হয়েছে নিউবর্ন। বড় হাতের ইংরেজি অক্ষর N, E, W, B, O, R এবং N-কে পাশাপাশি বসিয়ে এ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ কোনো দর্শকের চোখ দিয়ে বিবেচনা করলে হয়তো বা নিউবর্ন সে অর্থে বিশেষ কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নয়, তবে আমরা যদি কসোভোর সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও সংগ্রামের কথা বিবেচনা করি, তাহলে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য এ ধরনের কোনো মনুমেন্ট সত্যিকার অর্থে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যেভাবে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছি ঠিক একইভাবে অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে কসোভো আজকের এ অবস্থানে এসেছে। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার মতো কসোভোর সাধারণ মানুষের ওপরও সার্বিয়ার সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
নিউবর্ন পরিদর্শন শেষে সেপটিম আমাকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কসোভোর সামনে নিয়ে গেলেন। অনেকে বলেন, যুগোস্লাভিয়া শাসনামলে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কসোভো থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকাগুলো অত্যাধুনিক ও মনোরম স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন দালানকোঠায় পরিপূর্ণ ছিল। গুলশান, বনানী, বারিধারা কিংবা উত্তরার মতো প্রিস্টিনার এ অংশগুলো নাকি পুরো যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হতো। এখন অবশ্য কোনো ধরনের জৌলুশ চোখে পড়বে না। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পাশে সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চের দেখা পেলাম, বর্তমানে চার্চটি পরিত্যক্ত।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন কসোভোতে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ১৯৯৮ সালে সংঘটিত কসোভো যুদ্ধে তিনি দেশটির সাধারণ মানুষকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। এ কারণে কসোভোর বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে এবং প্রিস্টিনা সেন্টারের খুব কাছে তাঁর স্মরণে একটি স্কয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্কয়ারে বিল ক্লিনটনের ভাস্কর্য রয়েছে, যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আমরা অভিষেকের সময় শপথ অনুষ্ঠানে যেভাবে দেখি বিল ক্লিনটনের ভাস্কর্যকেও ঠিক একইভাবে সাজানো হয়েছে। বাঁ হাতে বই আঁকড়ে ধরে ডান হাত ওপরের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিল ক্লিনটনের এ ভাস্কর্যকে দেখলে মনে হয় তিনি বুঝি দেশটির সাধারণ মানুষকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। বিল ক্লিনটন স্কয়ারে পা রাখার কয়েক মিনিট পর এক তরুণের দেখা পাই। তাঁর নাম গাজমেন্দ সেগাশি। সেপটিমকে বিদায় জানানোর পর কিছুটা সময়ের জন্য আমি একা হয়ে পড়েছিলাম। তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়, তাঁকে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমার কিছু ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। এভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁর আন্তরিকতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। কসোভোর সাধারণ মানুষ বাংলাদেশকে ভীষণভাবে সম্মান করে। বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দিকের কোনো রাষ্ট্র যারা কসোভোকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, এ বিষয়টি জানার পর গাজমেন্দ বারবার এ একটি কথা বলছিলেন। গাজমেন্দ আমাকে নিয়ে এরপর একটি কফি শপে গেলেন, আমরা একসঙ্গে চা পান করলাম। অনেক বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হলো, গাজমেন্দ এর আগে প্রায় দুই বছর অস্ট্রিয়াতে বসবাস করেছেন। তিনি ইংরেজিতে সেভাবে পারদর্শী ছিলেন না, তবে তাঁর আন্তরিকতার কারণে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমস্যা হয়নি। পরে পেয়া ভ্রমণের সময় তিনি আমাকে বিশেষভাবে সঙ্গ দিয়েছিলেন। প্রতিদিন তিনি আমাকে মেসেঞ্জারে নক দেন এবং আমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। চলবে...
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া