কসোভো ভ্রমণের গল্প–১

বলকান পর্বতমালার উপস্থিতির কারণে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ইস্টার্ন থ্রেস থেকে শুরু করে সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এক সুবিশাল অঞ্চলকে সামগ্রিককভাবে বলকান অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করা হয়

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এক সুবিশাল অঞ্চলকে বলকান নামে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক দিক থেকে এ অঞ্চলটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। স্থানীয় বলকান পর্বতমালার নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে বলকান। যদিও স্লাভরা বলকানের পরিবর্তে স্টারা প্লানিনা শব্দটি ব্যবহার করতে অধিক স্বাছন্দ্যবোধ করেন। তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ইস্টার্ন থ্রেস থেকে শুরু করে পশ্চিমে সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত বলকান নামক অঞ্চলটি প্রসারিত। তুরস্কের ইস্টার্ন থ্রেস এবং সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ছাড়াও বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, গ্রিস, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভোসহ হাঙ্গেরি এবং রোমানিয়ার অংশবিশেষ এ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে।

সামগ্রিকভাবে বলকান অঞ্চলটি পূর্বে কৃষ্ণসাগর, পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত। তিন দিক থেকে সাগরবেষ্টিত হওয়ায় এ অঞ্চলটিকে অনেক সময় উপদ্বীপ বা পেনিনসুলা হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। ইউরোপের অন্যান্য অংশের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এ অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো দিক থেকে বেশ পিছিয়ে। সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও বলকান রাষ্ট্রগুলো আশানুরূপ অবস্থানে নেই। এর পরও বলকানকে আমার কাছে সব সময় বিশেষ মনে হয়। বলকান পর্বতমালার রূপবৈচিত্র্য সত্যি অসাধারণ, যা আমার মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের মাদকতার জন্ম দেয়।

ইউরোপে সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে  সার্বিয়া ও কসোভোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো অন্যতম। সার্বিয়ানরা কসোভোকে তাদের নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করেন, এ কারণে তাঁরা সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যাকার সীমানাকে স্বীকার করেন না

বলকানের অধিবাসীরা পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসীদের মতো নন। আমাদের মতো তাঁরা অনেকাংশে আবেগপ্রবণ। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাঁদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। অতিথিপরায়ণতা আর বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বিশেষ সুনাম রয়েছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। রূপ-লাবণ্যের দিক থেকে বলকান নারীদের তুলনা হয় না। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে তাঁরা খুবই সচেতন। পোশাক-পরিচ্ছদ ও মেকআপের ব্যবহার থেকে শুরু করে ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড করা পর্যন্ত লাইফস্টাইলের যাবতীয় বিষয়ে তাঁরা খুবই রুচিশীল। হলিউডের নায়িকারাও তাঁদের কাছে হার মানবে। পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসীদের কাছে বলকান বিউটি মানে ভিন্ন কিছু।

২০১৮ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়াতে পা রাখি। স্লোভেনিয়া একই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত দেশ। তাই সে সময় থেকে আমার লক্ষ্য ছিল স্লোভেনিয়ার ভিসা ব্যবহার করে যে কয়টি দেশ ভ্রমণ করা যায়, তার সব কটিতে আমার পদচিহ্ন রাখব। ইতিমধ্যে আমার এ লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা সফল হয়েছি। বয়স আমার ২৩, কিন্তু এই ২৩ বছর বয়সে ত্রিশের বেশি দেশ ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে। আলবেনিয়া ও বুলগেরিয়া ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ইউরোপ ট্যুরের সূচনা করেছিলাম। এ দুই দেশই বলকান উপদ্বীপের মধ্যে পড়েছে। ২০২০ সালের সমাপ্তি টেনেছি কসোভো নামের এক বিতর্কিত ভূখণ্ডে এসে। কসোভোরও অবস্থান এ বলকান অঞ্চলে।

বড়দিনকে কেন্দ্র করে প্রিস্টিনার সেন্টারে ক্রিসমাস মার্কেট

কসোভো আদতে কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো পশ্চিমা দেশগুলো কসোভোকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১১৭টি রাষ্ট্র কসোভোকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। কয়েকটি দেশ পরে অবশ্য এ স্বীকৃতিকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া কসোভোকে এখনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও চীন কসোভোকে স্বীকার করে না, তা সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে কসোভোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কসোভোর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে পৃথকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এ দুই দেশ দেশের সমর্থন না থাকায় দেশটি আজও জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করতে পারেনি।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও কসোভোকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। যেসব দেশ কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে এটি এখনো সার্বিয়ার একটি অংশ। ১৯১২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯১৩ সালের মে পর্যন্ত সংঘটিত বলকান যুদ্ধের ফলাফল কসোভোর ওপর সার্বিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯১৮ সালে সার্বিয়ার নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়া, মন্টিনিগ্রো, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া সমন্বিতভাবে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠন করে। সেই থেকে কসোভো যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন ঘটে। একে একে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ঘোষণা দেয়। কসোভোর প্রায় ৯৭ ভাগের মতো মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন। জাতিগতভাবে কসোভোর বেশির ভাগ মানুষ আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত। কসোভোর প্রায় সর্বত্র আলবেনিয়ান ভাষা ব্যবহার করা হয়, যদিও দেশটিতে যাদের বয়স ত্রিশের ওপরে, তারা মোটামুটিভাবে সার্বিয়ান ভাষায় বেশ দক্ষ।

প্রিস্টিনার সেন্টারে স্কেন্দারবেগের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যটি চোখে পড়ল। আলবেনিয়ান ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষদের নিকট স্কেন্দারবেগ একজন বীর হিসেবে পরিগণিত হন

ক্রিস্টমাস এবং নিউ ইয়ার উপলক্ষে আমাদের ইউনিভার্সিটি ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করে। ছুটির এ সময়টিকে উপভোগ করার জন্য কসোভো ভ্রমণের পরিকল্পনা করি।

স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত অভিবাসীদের একটি বড় অংশ কসোভোর নাগরিক, বেকারির কাজে তাঁদের বেশ সুনাম রয়েছে। স্লোভেনিয়াতে বেকারির ব্যবসায় একচেটিয়াভাবে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া কসোভোর অনেক নাগরিক স্লোভেনিয়াতে নির্মাণশ্রমিক হিসেবেও কাজ করেন।

সেনজেনভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে কসোভো ভ্রমণের জন্য আলাদাভাবে ভিসা প্রয়োজন হয় না। স্লোভেনিয়ার সঙ্গে সরাসরি কসোভোর ফ্লাইট সংযোগ নেই, তাই বাসে করে জার্নি শুরু করতে হলো। স্লোভেনিয়ায় আমার বসবাস আইডোসচিনা নামের এক ছোট্ট মিউনিসিপ্যালিটি অঞ্চলে।

আইডোসচিনা থেকে কসোভোর রাজধানী প্রিস্টিনা পর্যন্ত পৌঁছাতে ১৯ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। রিটার্ন টিকিটসহ যাওয়া-আসা বাবদ আমাকে ৯০ ইউরো খরচ করতে হয়েছিল। সীমান্তবর্তী এলাকায় যানবাহনের চাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ারের ছুটি কাটাতে তাঁদের অনেকে নিজ দেশে আসেন। এ জন্য এই সময় সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে যানবাহনের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়।

ক্রোয়েশিয়ার বর্ডারে প্রায় দুই ঘণ্টা এবং সার্বিয়ার বর্ডারে প্রায় চার ঘণ্টা আটকে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল সত্যি বিরক্তিকর। সার্বিয়ার সীমানা পাড়ি দিয়ে যখন কসোভোতে প্রবেশ করার সময় আমার মধ্যে অন্য একধরনের অভিজ্ঞতার সূচনা হয়েছিল। ইউরোপে সবচেয়ে গোলযোগপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে সার্বিয়া ও কসোভোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো অন্যতম। সার্বিয়ানরা কসোভোকে তাঁদের নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করেন, এ কারণে তাঁরা সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যকার সীমানাকে স্বীকার করেন না।

কসোভোর মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতাসংগ্রামকে স্মরণ করতে নির্মাণ করা হয়েছে নিউবর্ন নামক এ বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ

কসোভোর স্থানীয় নাগরিকেরা যখন সার্বিয়াতে প্রবেশ করেন, তখন তাদেরকে সার্বিয়ার বর্ডার পুলিশের থেকে আলাদাভাবে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হয়। সীমান্তের সার্বিয়ান অংশে কোনো ধরনের বর্ডার ক্রসিং নেই। তবে কসোভো অংশে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে এক বিশাল পাঁচিল নির্মাণ করা হয়েছে। এ পাঁচিল পেরিয়ে যখন কসোভোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করি, তখন বর্ডার পুলিশ এসে আমাদের সবার পাসপোর্ট ও রেসিডেন্ট পারমিটের কপি স্ক্যান করে তাদের ডেটাবেজে এন্ট্রি করে। পাসপোর্টে কোনো ধরনের অ্যারাইভাল কিংবা ডিপারচার সিল দেওয়া হয়নি। পাসপোর্টে কসোভো ইমিগ্রেশনের কোনো সিল থাকলে পরবর্তী সময়ে সার্বিয়ার বর্ডার পুলিশ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কসোভোগামী কোনো অ্যারোপ্লেনকে সার্বিয়ার আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এসব কারণে কসোভোর ইমিগ্রেশন পাসপোর্টে সাধারণত কোনো ধরনের সিল প্রদান করে না। চলবে...

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া