আরশীনগরের গল্প-২
মরমি সাধক লালন সাঁই বলেছেন,
‘বাড়ির কাছে আরশীনগর
সেথা এক পড়শী বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে’
আমার জন্মস্থান এবং কলেজ পর্যন্ত বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়াতে। আমরা কুষ্টিয়ার লোকজন আসলেই অনেক ভাগ্যবান যে লালন সাঁই, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহান মানুষের পদধূলি পেয়েছি। আমাদের জীবনযাপনে তাই ওনাদের প্রভাব প্রকট।
আমাদের পাড়াতেই লালন সাধক আবদুর রব বয়াতির বাড়ি। আমরা ওনাকে চাচা ডাকতাম, কিন্তু জানতাম না উনি একজন বড়মাপের বাউল সাধক। ওনাদের বাসাতেই একসময় প্রতিবছর সাধুসঙ্গ হতো। তখন কয়েক দিন লালনগীতি গাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলত।
গ্রামে বসবাস করার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম এবং খবরাখবর রাখতাম। হয়তোবা সেই কারণেই লালন তাঁর নতুন প্রতিবেশীর খবর নিতে না পেরে উপরিউক্ত চরণগুলো লিখেছিলেন। বলা হয়ে থাকে এই গানটা তিনি রচনা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ করে।
লালন সাঁইয়ের এখন পর্যন্ত মাত্র একটাই স্কেচ পাওয়া যায়। সেটাও নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই আঁকা।
যাহোক, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেও পাড়া–প্রতিবেশীর সঙ্গে আমি তাই গায়ে পড়ে পরিচিতি হই, তারা যে দেশেরই হোক না কেন। পলের সঙ্গে পরিচয়টা খুবই কাকতালীয়ভাবে। বাসার বিপরীত পাশেই বিশাল রাগবি খেলার মাঠ। সেখানে প্রায় সব সময়ই খেলাধুলা চলে। বড়রা রাগবি খেলতে আসলে ছোটরা কী করবে তখন, হয়তো সেটা ভেবেই রাগবি মাঠের পাশেই আরও কিছুটা জায়গা উঁচু করে সেখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা করা হয়েছে। মাঠের পাশেই রাস্তা বরাবর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা।
আমাদের গাড়িটা সেখানেই পার্ক করে রাখি আমরা। একদিন আমরা বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ভদ্রলোক ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি ভারতীয়।’ আমি বললাম, ‘না, আমরা বাংলাদেশি।’ উত্তরে সে বলল, ‘তোমার গিন্নির পোশাকপরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছিল, তোমরা ভারতীয়।’ আসলে দেশের বাইরে গেলে বেশির ভাগ বাংলাদেশিকেই এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। চেহারা ও পোশাকপরিচ্ছদ দেখে সবাই ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কান বা পাকিস্তানি বলে মনে করে। তখন আমাদের যেচে পড়ে সেই ভুল ভাঙিয়ে দিতে হয়।
তখন আবার হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি, বয়সের একটা আলাদা আধিপত্য আছে। যেহেতু ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের জন্ম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের বেশ আগে, তাই সবাই এই ভুলটাই করে। বাংলাদেশের জন্মও যদি একই সময়ে হতো, তাহলে হয়তোবা আমাদের এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।
যাহোক, পলের সঙ্গে তখনই বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। পলের পরের প্রশ্ন ছিল, ও, তোমরা সেই দেশের নাগরিক, যারা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দাও না। আমি এই প্রশ্ন শুনে একই সঙ্গে বিস্মিত ও লজ্জিত হলাম। বিস্মিত হলাম পলের জানার পরিধি দেখে আর লজ্জা পেলাম ঘটনাটা সত্যি বলে। তারপর পল রানা প্লাজার ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলল, তোমরা এমনকি শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাও দিতে পারো না। পল এরপর বলেই চলল ব্যবসায়ীরা সব দেশেই শ্রমিকদের ফাঁকি দেয়, কিন্তু তোমাদের দেশে মনে হয় একটু বেশি, বলে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, কথাটা অপ্রিয় হলেও তুমি সত্যিটাই বলেছ। শ্রমিক সারা জীবন শ্রমিকই থেকে যায় কিন্তু কারখানার মালিকের কারখানার সংখ্যা এবং বাড়ির তলার সংখ্যা বাড়তেই থাকে। পল রাগবি মাঠটার মধ্য দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে স্টেশনে আসা–যাওয়া করে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছিল দেখে সেদিনের মতো বিদায় নিল।
এরপর থেকেই পলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর সেভাবে আলাপ করা হয়ে ওঠেনি। রায়ানকে নিয়ে একদিন বাইরে বসে আছি, দেখলাম পল কাজ থেকে ফিরছে, সঙ্গে তার একজন বন্ধুও আছে। রায়ানকে দেখে বলে উঠল, হাউ আর ইউ লিটল ব্যাম্বিনো। উত্তরে আমি বললাম, সারাক্ষণ তার ঠান্ডা লেগে থাকে।
শুনে পল আর পলের বন্ধু দুজনই একসঙ্গে কথা বলা শুরু করল। তাদের কথার সারমর্ম হচ্ছে বাইরের দুধ বাচ্চাদের একটু কম খাওয়ানোই ভালো, কারণ এই দুধে মিউকাস থাকে। আর মিউকাস বাচ্চাদের ঠান্ডা সারতে দেয় না। এ ছাড়া রায়ানের পোশাক–আশাকের বিষয়েও মতামত দিল। একটু পরে তাহিয়া আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলে তারা দুজনই তাহিয়াকে কুর্নিশ করে জানতে চাইল, হাউ আর ইউ প্রিন্সেস।
উন্নত দেশগুলোর এই আচরণগুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করে, এরা বাচ্চাদের অনেক বেশি সম্মান দেয় হয়তোবা এই কারণেই এখনকার বাচ্চারা যখন বড় হয়, তখন তারা বড়দের সম্মান করে এবং গায়ে পড়ে উপকারও করে। আলাপ শেষ করে পল বলল, এখন তো বাইরে অনেক বাতাস, তুমি ওদের ঘরের ভেতরে নিয়ে যাও। তাই আমি পল এবং তার বন্ধুকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম।
এর মধ্যেই বাসা বদলে আমরা নতুন বাসায় গিয়ে উঠেছি। এখানে যেহেতু প্রতিটি পাড়াতেই একটা করে খেলার জায়গা থাকে, তাই আর খুব বেশি আসা হয় না আগের বাসার সামনের পার্কটাতে এবং পল ও তার বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয় না আর। এবারের স্কুল ছুটিতে গিন্নি এবং রায়ান ও তাহিয়াকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়াতে হাতে বেশ অবসর, তাই একদিন রোববার বিকেলে আশফাক ভাই বললেন, ইয়াকুব আপনার আগের বাসার সামনের পার্কটাতে চলে আসেন, আমি আপনার ভাবিকে স্টেশন থেকে উঠিয়ে নিয়ে আলিশা আর দৃপ্তকে নিয়ে আসছি। বিজয়দাকেও উনি আসতে বলেছেন রুপা বৌদি আর ওনাদের মেয়ে এলভিরা এবং ছেলে রেনোরকে নিয়ে আসতে। আমার হাতে যেহেতু কোনো কাজ ছিল না, তাই রওনা দিলাম। খেলার মাঠের পার্কিংয়ে গিয়ে দেখি, আশফাক ভাইয়েরাও কেবলই এসেছেন। গাড়ি থেকে নেমে দৃপ্ত বল নিয়ে রাগবি মাঠে চলে গেল। আর আমাদের দুজনকে বলল, তাকে কিক করে গোল দিতে। সে ইতিমধ্যেই রাগবির গোলপোস্ট দুটোকে ফুটবলের গোল বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এভাবে কিছুক্ষণ খেলার পর আমরা ওপরের পার্কটাতে এসে গল্প শুরু করে দিলাম। বিজয়দা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তাই আর ওনারা এলেন না। আমরা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি রাগবি মাঠটাকে কোনাকুনি অতিক্রম করে পল এগিয়ে আসছে।
দৌড়ে গিয়ে পলের সামনে দাঁড়ালাম। পল আমাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘অনেক দিন পর দেখা।’ আমি বললাম, ‘আমরা বাসা বদলেছি।’ শুনে সে বলল, ‘তাই তো তোমাদের দেখি না আর।’ যাহোক, তোমার ব্যাম্বিনো আর প্রিন্সেস কেমন আছে? শুনে আমি মনে মনে অনেক খুশি হলাম, তার মানে পল আমাদের মনে রেখেছে। আমি বললাম, ‘সে অনেক বড় হয়ে গেছে বলে মোবাইলে রায়ান আর তাহিয়ার ছবি দেখিয়ে দিলাম।’ পল বলল, ‘তোমার বাচ্চা দুটো ঠিক তোমার মতো।’ শুনে আমি আরও খুশি হলাম। এরপর পল আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা প্রশ্ন করল, ‘তুমি জর্জ হ্যারিসনকে চেনো?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’ সে আমাদের জন্য যা করেছে, সেটা আমরা জাতি হিসেবে কখনোই ভুলব না। শুনে পল বলল হ্যাঁ, সেই নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্ট আমার এখনো মনে আছে। বলে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, পরকালে উনি ভালো থাকুন। এরপর আমরা ধর্মকর্ম নিয়েও বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। দেখলাম, সে পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রধান ধর্মগুলোর সব কটার সম্বন্ধেই জ্ঞান রাখে। এমনকি সব ধর্মগুরুদের নাম পর্যন্ত জানে। আমাদের আলাপ করতে দেখে আশফাক এগিয়ে এলে ওনার সঙ্গেও বন্ধু পলের পরিচয় করিয়ে দিলাম।
তারপর বললাম, পলের সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে বলা তো যায় না, আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দেন। আশফাক ভাই আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিলেন।
পলের সম্বন্ধে একটু তথ্য দিয়ে রাখি। পলের বাবা ইতালি থেকে এই দেশে এসেছিলেন। তারপর এখানেই বিয়ে করে সংসারী হয়ে যান। আমি অবশ্য কারও ব্যক্তিগত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করি না, যদি না তিনি নিজে থেকে বলেন, কিন্তু দেশের নামটা বললাম, যাতে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হয় যে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির এবং ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের দুজন মানুষের মধ্যেও কত সহজেই বন্ধুত্ব হতে পারে।
পলকে একা দেখে তার বন্ধুর কথা জানতে চাইলাম। পল বলল, সে অসুস্থ। আমি তখন তার কুশল জিজ্ঞেস করলাম। এভাবে আলাপ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এল। তখন আবার আমরা দুজনেই একে অপরকে হাগ দিয়ে আবার দেখা হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে বিদায় নিলাম। এই মানুষটার সঙ্গে আমার পরিচয় এখানে আসার প্রায় বছরখানেক পর। এরই মধ্যে আবার প্রায় দেড় দু–বছর দেখা হয়নি কিন্তু ঠিকই সে আমাদের মনে রেখেছে, এটা ভাবলে চরম খারাপ সময়েই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আবারও আমি পৃথিবীর মানুষদের প্রতি নতুন করে শ্রদ্ধাশীল হই।
*লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া