আরশিনগরের গল্প-১

বাসা বদলানো আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হয়। বাসা বদলানোর চেয়ে মারা যাওয়াও আমার কাছে সহজ লাগে। বাসা বদলানোর আগের ও পরের কাজগুলো মিলিয়ে জীবন থেকে কয়েকটা দিন জাস্ট হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কোনো প্রোডাক্টিভিটি ছাড়াই। দেশে থাকতে বাসা বদলেছিলাম সব মিলিয়ে মাত্র দুবার।

তা–ও আবার বিয়ের পর। তাই আমাকে খুব একটা প্যারা নিতে হয়নি। বিদেশে এসেও ইতিমধ্যে দুবার বাসা বদলাতে হয়েছে। সেখানেও আমার গিন্নিই অধিকাংশ কাজ করেছে। তবু আমাকে যে সামান্য কাজটুকু করতে হয়েছে, তাতেই আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত।

বিদেশে এসে বাসা বদলানোর কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল প্রতিবেশীদের কল্যাণে। দুবারই আশফাক ভাই আর স্বপন ভাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসে হাত লাগলেন, তাই আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। আর প্রথমবার ফ্রিজটা গাড়িতে তোলার সময় আমাদের প্রতিবেশী ফিলিপাইনের নাগরিক আরলিন এসে হাত লাগানোতে সেটা গাড়িতে তুলতে আর বেগ পেতে হয়নি। নামানোর সময় বাপ্পী ভাই এসে ইউটটা জায়গামতো পার্ক করে দিয়েছিলেন। দুবারই অসুস্থ শরীর নিয়ে একজন সবকিছুর তদারক করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন সিডনিতে আমাদের স্থানীয় অভিভাবক নাজমুল ভাই।

প্রথমবারের বাসার মালিক ছিলেন বাংলাদেশি আর ওনার স্ত্রী পর্তুগিজ। প্রবাসে একজন বাঙালির পাশে আরেকজন বাঙালিই এসে দাঁড়ায় সবার আগে। একেবারে অচেনা–অজানা একজন বাঙালিও অন্য একজনের আত্মার আত্মীয় হয়ে যায় নিমেষেই। অবশ্য সব সময়ই যে সব সম্পর্ক টেকসই হয়, তেমন নয়; তবু বাংলাদেশিরা একে অন্যকে অনুভব করেন এবং বিপদ–আপদে এগিয়ে আসেন। এগুলো নিয়ে এর আগেও বহুবার লিখেছি। আজ একটু অন্য দেশের বা অন্য ভাষাভাষী প্রতিবেশীদের দিকে আলোকপাত করব।

আমাদের প্রথম বাসাটা ছিল একটা তেমাথার একেবারে কোনায়। বাসার বিপরীত পাশে একটা রাগবি খেলার মাঠ আর অন্য পাশের রাস্তার উল্টো দিকে ছিলেন একজন ভারতীয়। আর আমাদের ঠিক পাশের বাসাতেই থাকতেন আরলিন। যেতে–আসতে আরলিনের সঙ্গে এক–দুবার শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছিল, কিন্তু তেমন একটা কথা হয়নি। পরবর্তী সময়ে একদিন আরলিনের সঙ্গে আলাপ হলো। আরলিন ফিলিপাইন থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আমার মতোই স্কিলড মাইগ্র্যান্ট হিসেবে এ দেশে এসেছেন।

তিনি একটা অফিসে কাজ করার পাশাপাশি ছোটখাটো কনসালট্যান্সিও করেন। ওনাদের দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে দুজন আমাদের মেয়ের বয়সী। ওনার স্ত্রীর সঙ্গেও আমার গিন্নির দু–একবার আলাপ হয়েছিল, তবে আমার সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি। কারণ, আমি তখন খুব ভোরে উঠে কাজে চলে যেতাম, আবার ফিরতে ফিরতেও রাত হয়ে যেত।

একবার ডিসেম্বরে আমার গিন্নি দুই বাচ্চাকে নিয়ে দেশে গেছে। আমার টানা তিন সপ্তাহের ছুটি। সারা দিন বাসায় বসে বসে নাটক–সিনেমা দেখে সময় কাটাই। সন্ধ্যায় বড় ভাইয়েরা এলে তাসের আসর বসে। একদিন বিকেলে হঠাৎ বাইরের দরজার কাছে শব্দ শুনে গিয়ে দরজা খুলে দেখি, ওনাদের মেজ মেয়েটা পালিয়ে যাচ্ছে। আমি দরজার চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওনারা ক্রিসমাসের একটা গিফট প্যাকেট রেখে গেছেন। আমাকে দেখে উনি বলে উঠলেন, ‘হায় হায়, তুমি তো দেখেই ফেললে। তাহলে আর মজা থাকল না।’ আমি বললাম, ‘ব্যাপার না। উপহার তো উপহারই।’ এরপর শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে এলাম। এই খবর দেশে আমাদের মেয়ে তাহিয়াকে বলার পর সে খুবই খুশি হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, ওনারা কী উপহার দিয়েছেন?’ আমি বললাম, ‘তুমি দেশ থেকে এসে খুলে দেখো।’

বাসার সামনের রাগবি মাঠের কোনায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা। আমরা সকাল–বিকেল সেখানে গিয়ে খেলাধুলা করি। ওনাদের ছেলেমেয়ে তিনজনও সাইকেল নিয়ে বের হয়। এমনই একদিন অনেক জোরে বাতাস শুরু হলে ওনারা বাসা থেকে ঘুড়ি নিয়ে এসে ওড়াতে শুরু করলেন। সেটা দেখে তাহিয়াও বায়না ধরল তাকে ঘুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘুড়ি কোথা থেকে কিনেছ?’ উনি বললে, ‘অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে সহজ হলো চেইন শপ এলডির দিকে নজর রাখা। মাঝেমধ্যে ওরা ঘুড়ির সেল দেয়।’ আমি বললাম, ‘পরেরবার কিনলে তোমরা আমাদের জন্যও একটা কিনে রেখো।’ এর পরের সপ্তাহে উনি আমাদের বাসায় এসে একটা বিশাল প্রিন্সেস ঘুড়ি দিয়ে গেলেন আর বললেন, এটা ওনার মেয়েদের জন্য অনেক আগে কেনা হয়েছিল, কিন্তু ওড়ানো হয়নি; তাই তাহিয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন। এরপর আমরা ঢাউস সাইজের সেই ঘুড়ি বহুদিন উড়িয়েছি এবং এখনো মাঝেমধ্যে সময় পেলে ওড়াই।

প্রথমবার বাসা বদলানোর পর আমরা আরও কিছু নতুন প্রতিবেশী পেলাম। আমাদের বাসার রাস্তার উল্টো দিকেই থাকেন জর্জ আর‍ তাঁর স্ত্রী। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। তিন ছেলেমেয়েই বড় হয়ে নিজেদের সংসার নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। ছুটিছাটাতে ওনাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন, তখন ওনাদের বাসাটা মুখর হয়ে ওঠে বাচ্চাদের কলকাকলিতে। এমনিতে দুজন সারা দিন বাসার সামনের বিশাল জায়গায় করা বাগানের, ঘাসের যত্ন নিয়ে সময় কাটান। সকালবেলা হাঁটতে বের হলেই ওনাদের সঙ্গে দেখা ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। চেরি ব্লসমের সময় এলে অবার্নে গিয়ে চেরি ফুল দেখা অনেকটা সময়ের ব্যাপার আমাদের জন্য, তাই আমরা সব সময় আশপাশেই আমাদের আনন্দের উৎসগুলো খুঁজে নিই। আমাদের দুই বাসা পরই একটা বাসার ভেতরে যাওয়ার রাস্তার পাশে এক সারিতে ১০টা চেরি ফুলের গাছ লাগানো। বাসাবাড়ির গাছ, তাই যত্ন নেওয়াতে এবার অনেক ফুল এসেছিল। রায়ানকে নিয়ে সাঁতার থেকে ফেরার পথে একদিন সেই বাসার মধ্যে বাড়িওয়ালিকে দেখে ঢুকে পড়লাম। ওনার ও ওনার পোষা কুকুর আর্নল্ডের সঙ্গে পরিচয় হলো। পরে আবার একদিন গিয়েছিলাম তাহিয়াকে নিয়ে।

অকারণে পাড়ার মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা আমার ও তাহিয়ার অন্যতম শখের বিষয়। তাই আমরা জানি পাড়ার কোন বাড়িতে কী কী ফুল ও ফলের গাছ আছে। গত বছর এক বাড়িতে শজনেগাছ দেখে ভাবছিলাম, বাড়িওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সজনে চেয়ে নিতাম। আজ সকালে সেই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি আর তাহিয়া খুবই উল্লসিত হয়ে উঠলাম। কারণ, গাছে ফুল ও ফল দুই–ই দেখা যাচ্ছে। গাছের ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম, সদর দরজার সামনে গৃহকর্তা গাড়ির পরিচর্যায় ব্যস্ত। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা এই ফলটাকে কী বলো?’ উত্তরে বললেন, ‘আমরা বলি ড্রাম স্টিক।’ বলে স্মিতহাস্যে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কেনি।’ আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমি আলী।’ বললাম, ‘আমাদের দেশে এটাকে বলে শজনে।’ শুনে কেনি বললেন, ‘তোমাদের দেশ কোনটা?’ আমি বললাম, ‘বাংলাদেশ।’ তাঁর দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘আমার দেশ ফিজি, কিন্তু আমার মা–বাবা ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের।’ আমি বললাম, ‘ভগত সিং আমার আধ্যাত্মিক গুরু।’

এভাবেই আমাদের আলাপ এগিয়ে চলল। কেনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কোথায় থাকো?’ বললাম, ‘পাহাড়ের দিকে।’ শুনে কেনি বলল, ‘শোনো, তোমার যদি এগুলো নিতে ইচ্ছা করে, তুমি যেকোনো সময় চলে আসবে। আর সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি এর একটা ডাল নিয়ে লাগিয়ে দাও। আচ্ছা শোনো, পরের বসন্তকালে আমি তোমাকে একটা ডাল দেব, তখন লাগিয়ো। এখন লাগালে বাঁচবে না।’ এরপর ‘আমি ওদেরও কয়েক বছর আগে একটা ডাল দিয়েছিলাম, দেখো কী সুন্দর ফুল এসেছে’ বলে দুটি বাড়ির পাশের বাসাটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। বললাম, ‘আমি ওই গাছ দুটো দেখেছি। এবার অনেক ফুল এসেছে।’ এরপর আবার কেনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

দ্বিতীয়বার বাসা বদলানোর পর একটু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। নতুন এলাকাটাতে আমাদের প্রতিবেশী সবাই মোটামুটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক–ভদ্রমহিলা। তাঁদের বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়ে আলাদা থাকেন। তাই পাড়াটা মোটামুটি শান্ত। নতুন বাসায় ওঠার পর প্রথম পরিচয় হলো পল আর এলিজাবেথ দম্পতির সঙ্গে। ওনারা থাকেন আমাদের বাসার ঠিক বিপরীতে, রাস্তার উল্টো পাশে। দুজনই অনেক হাসিখুশি মিশুক মনের মানুষ। আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন এবং কোনো কিছু দরকার হলে যেন ওনাদের বলি, সেটাও জানিয়ে দিলেন। এরপর পরিচয় হলো আমাদের পশ্চিম পাশের বাসার জনের সঙ্গে। আমার গিন্নির বাগান করার শখ। সে একদিন একটা শাবল দিয়ে উনি মাটি কোপাচ্ছিল দেখে জন এসে বড় বেলচা ও শাবল দিয়ে গেছে। সেগুলো দেখে আমি জনকে বললাম, ‘আপনি তো আমার কাজ বাড়িয়ে দিলেন। আগে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে কাজ ফাঁকি দিতাম, এখন তো আর সেটা হবে না।’ পরে বিকেলবেলা এসে আমাদের সঙ্গে চা খেয়ে গেছেন।

এরপর পরিচয় হলো পূর্ব পাশের প্রতিবেশী সোনিয়ার সঙ্গে। সোনিয়া একাই থাকেন আর ওনার সঙ্গে থাকে দুটো বিড়াল। একটা ওনার পোষা আর একটা প্রতি রাতে আসে।

একবার এক ঝড়ের রাতে এসেছিল, উনি খাবার দিয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রতি রাতে এসে খেয়ে যায়। সেটা দেখে বাড়ির বিড়ালটা অনেক রেগে যায় আর অনেক জোরে চিৎকার করতে থাকে। আমাকে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমাদের ঘাসের মধ্যে নিশ্চয় আমার বিড়ালের পায়খানা পাও, দুঃখিত।’ বললাম, ‘দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, আমার মেয়ে দুই বছর ধরে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে একটা বিড়ালের তুলতুলে বাচ্চা কিনে দেওয়ার জন্য।’ এরপর নাম জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘সোনিয়া।’ আমি বললাম, ‘ভালোই হলো, আমার গিন্নির নাম তানিয়া আর আপনার নাম সোনিয়া।’ এরপর গিন্নিকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলাম এবং তাঁরা দুজন গুটুরগুটুর করে গল্প করতে শুরু করলেন।

এরপর পরিচয় হলো আমাদের পেছনের বাড়িওয়ালার সঙ্গে। একদিন শনিবার গিন্নির ডিউটি ছিল। আমি আর বাচ্চাগুলে সারা দিন বাসায়। ওদের টিভিরুমে টিভি ছেড়ে দিয়ে পেছনের বারান্দায় বসে আমি রামিনস ফার্ম থেকে আনা লালশাক বাছতেছিলাম। তখন পেছনের বাড়ির মধ্যে মানুষের চলাচল ও কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সারা দিন এভাবে কাজ চলল। বারবারই মনে হচ্ছিল বেড়ায় টোকা দিয়ে কথা বলি, কিন্তু সেটা ঠিক কতখানি শোভন হবে ভেবে চুপ করে রইলাম। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে ভদ্রলোক তালগাছের মতো গাছটার কাটার জন্য চেয়ারে উঠে কাজ শুরু করল। তখন আমি এগিয়ে গিয়ে কাজ শুরু করলাম।

ওনার নাম কেনি। এটা ওনার স্ত্রীর বাসা। মানে মালিকানা ওনার স্ত্রীর। এত দিন ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। এখন বিক্রি করে দেবেন, তাই সাফসুতরো করছেন। আমাকে বললেন, ‘তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ থাকলে জানিয়ো।’ ওনার বয়স ৫১ বছর। একটা ব্লাইন্ড ডেটে গিয়ে বিয়ে করেছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। উনি একটা সিটি কাউন্সিলে চাকরি করেন। আমি কোন দেশের সেটা শোনার পর বললেন, ‘আমাদের কাউন্সিলে একজন বাংলাদেশি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কাজ করেছি।’ বললাম, ‘আমিও কাউন্সিলের চাকরির চেষ্টা করব আরও একটু বুড়ো হয়ে যাওয়ার পর।’ শুনে উনি স্মিত হাসলেন।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। ইতিমধ্যে রায়ান এসে আমার কোলে চড়ে বসেছে। রায়ানকেও ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম পরিবারের একমাত্র অজি পোলা বলে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় উনি বললেন, ‘আজ আর কাজ করব না। কালও আবার আসতে হবে। তোমরা বাসায় থাকলে আবার আলাপ হবে।’

এরপর আরও পরিচয় হয়েছে মিক দম্পতির সঙ্গে। ওনারা একটু রাশভারী স্বভাবের। এ ছাড়া একটা সামওয়ান পরিবার আছে। গৃহকর্ত্রীর নাম টনি। উনি বললেন, ‘অনেক শান্ত পাড়া।’ আমি বললাম, ‘একটু বেশিই শান্ত।’ উনি বললেন, ‘আমরা যখন ২০০১ সালে এখানে আসি, তখন অনেক বাচ্চা গিজগিজ করত আর সারা মহল্লা মাথায় তুলে রাখত।

তারা সবাই বড় হয়ে নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত এখন। তাই পাড়াটা এখন অনেক শান্ত।’ আমি বললাম, ‘আমার ছেলে একাই তো চিৎকার করে সারা পাড়া মাথায় তুলে রাখে।’ কোলে বসা রায়ানকে দেখলাম।

এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। প্রতিবেশীই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আত্মীয়, তিনি যে দেশেরই হোন না কেন। জন শুরুতে আমরা বাংলাদেশি শুনে মনে করেছিলেন, আমরা হয়তো রিফিউজি। পরে আলাপে আলাপে যখন সব জেনেছেন, তখন আরও বেশি আন্তরিক হয়ে গেছেন। জন অবশ্য এমনিতেই গায়ে পড়ে আমাদের অনেক উপকার করেছেন। বাংলদেশি হিসেবে অবশ্যই আমি বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশব, চলব, আনন্দ করব; কিন্তু প্রতিবেশীর খবরও আমাদের রাখা দরকার। কারণ, বিপদে পড়লে ওনারাও কিন্তু এগিয়ে আসবেন দেশ–জাতি–ধর্মের ব্যবধান ভুলে। এত দিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, একটু খোলা মন নিয়ে যেকোনো মানুষের সঙ্গে মিশলে সে নিমেষেই আপনার আত্মার আত্মীয় হয়ে যাবে। মানুষে মানুষের এই মেলবন্ধনের মাধ্যমে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে একটা ছোট গ্রাম—আরশিনগর। আর মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার সার্থকতাটাই সেখানে।
আমার গুরু লালন সাঁইজির ভাষায়,
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।’

*মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া