আরশিনগরের গল্প-৩
দূর পরবাস
রাজীব আর আমি দুজনেই বাংলাদেশে আরশিনগরের, মানে কুষ্টিয়ার বাসিন্দা ছিলাম; যদিও তখন ওর সঙ্গে আমার তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। তবে ওকে চিনতাম কলেজজীবন থেকেই। কলেজজীবনটা আমাদের কাছে ছোট্ট এক টুকরো স্বপ্নের মতো। যেই স্বপ্ন আমরা বারবার দেখতে চাই। কারণ, স্কুলজীবন পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ জীবনে ঢোকার আগের একটা মুহূর্ত হচ্ছে কলেজজীবন। কিন্তু এত বর্ণে বর্ণিল যে তার রঙের আবেশ রয়ে যায় সারা জীবনে। আমি এখনো অবসরে সেই ক্ষুদ্র স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। যাই হোক, রাজীবকে চিনতাম আমাদের সহপাঠী হিসেবে না যতটা, তারচেয়ে চিনতাম ‘ক্যাডার’ হিসেবে। একটা ছেলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েও সারা কলেজ হইহই করে বেড়াচ্ছে। এক পাড়ার সঙ্গে অন্য পাড়ার গেঞ্জামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মিছিলে সবার আগে।
আমার এখনো মনে পড়ে মাথায় উল্টো করে লাল রঙের ক্যাপ আর গলায় একটা চেইনের সঙ্গে কিছু একটা ঝোলানো। হাঁটার ভঙ্গিটা কিছুটা অন্য রকম। হাঁটার সময় সামনের দিকে সব সময়ই কিছুটা ঝুঁকে থাকত, তাতে ওকে অনেকটা কুঁজো মনে হতো। হয়তোবা বয়সের তুলনায় বেশি লম্বা হওয়ার কারণেই এমন লাগত।
কলেজজীবনের স্মৃতি বলতে এটুকুই। তবে ওকে মনে রাখার কারণ হচ্ছে আমিও একসময় পাড়ার সবচেয়ে বজ্জাত ছেলেটিই ছিলাম। আমাকে নিয়ে মা মহলে প্রায় প্রতিদিনই সভা বসত, এই ডাকাত, গোঁয়ার ছেলের হাত থেকে তাঁদের ভালো ছেলেমেয়েগুলোকে কীভাবে বাঁচানো যায়। কিন্তু কালের আবর্তে আমি সেটা হারিয়ে ফেললেও এই ছেলে সেটা ধরে রেখেছে, তাই ওর কথা আমার মনে ছিল।
এরপর আর ওর সঙ্গে অনেক দিন দেখা নেই। আমি কোনোমতে টেনেটুনে অনার্স শেষ করে বন্ধুদের বদান্যতায় একটা ভালো চাকরি পেয়েছি। সেই চাকরির বস একদিন বললেন যে তোমাদের পরিচিত কেউ যদি ভালো অটোক্যাড পারে, তাহলে আমাকে জানিয়ো। আমি বন্ধু জাকির, যার ডাকনাম সুমন, কিন্তু আমাদের কাছে জ্যাক নামেই পরিচিতি পেয়েছিল ‘টাইটানিক’ চলচ্চিত্রটা মুক্তি পাওয়ার থেকে। জ্যাকের সঙ্গে ব্যাপারটা আলোচনা করার পর ও বলল, রাজীব ভালো অটোক্যাড পারে, ওকে রেফার কর। আমিও কোনো কথাবার্তা ছাড়াই রাজীবকে ফোন দিয়ে বললাম, স্যালারি এই রকম দেবে। এতে তোর চলবে কি না? ও কী বলেছিল, এখন আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমি তখনো করপোরেট কালচার সম্বন্ধে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিলাম না, তাই এই বোকামিটা করেছিলাম। আমার বসকে বললাম যে আমার এক বন্ধু আছে, ও ভালো অটোক্যাড পারে। আমি ওকে নিয়ে আসি একদিন। বস বলল, দাঁড়াও। ও কোন ক্যাম্পাসের? আমি বললাম, অমুক ক্যাম্পাসের। সে বলল, না, ওকে অমুক ক্যাম্পাসের হতে হবে, না হলে হবে না। আমি যারপর নাই লজ্জিত বোধ করেছিলাম। এরপর আর রাজীবের সঙ্গে আমার কথা বা দেখা হয়নি। জীবনের গতিময়তায় আমি একদিন অস্ট্রেলিয়ার ভিসা হাতে পেলাম, যেটাকে আমি বলতাম স্বপ্নলোকের চাবি। তবে সেটা আসলেই স্বপ্নলোকের চাবি কি না, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। আমরা আপাতত সেই বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। আবার বন্ধু জ্যাক বলল, রাজীব তো ওখানে আছে, ওর সঙ্গে যোগাযোগ কর, কিন্তু আমি দ্বিধা করছিলাম। আমার মনে বারবারই আগের স্মৃতিটা ভেসে উঠছিল আর আমি ততই সংকুচিত বোধ করছিলাম। দেখি, একদিন ওই আমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিল, কিরে, তুই নাকি চাবি হাতে পেয়ে গেছিস। আমি কাঁচুমাচু গলায় বললাম, হ্যাঁ। আমি তখনো সহজ হতে পারছিলাম না। কিন্তু ও এমনভাবে কথা বলছিল যেন ওর সঙ্গে আমার জীবনে মাত্র একবার কথা হয়েছে এমন না, ওর সঙ্গে আমার প্রতিদিনই কথা হয়। আমরা যেন প্রায়ই এমন করে আড্ডা দিই।
এরপর ওই আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুদ্ধি দিত। আমাকে কী কী নিয়ে আসতে হবে, আসার আগে কী কী করতে হবে ইত্যাদি। এমনকি ও বলল, তোর ভাবিকে আমি লাইনে দিচ্ছি, তুই তোর বউয়ের কাছে দে। গৃহস্থালির জন্য কী কী আনতে হবে, তোর ভাবি সেটা ভালো করে তোর বউকে বুঝিয়ে দেবে। এরপর তারাও প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করত। এতে আমাদের যে কী উপকার হয়েছিল, সেই বর্ণনায় আজ আর যাচ্ছি না। আসলে যে মানুষটা জীবনে যুদ্ধ করে জিতেছে, আপনি যদি তার কাছ থেকে যুদ্ধ করার বুদ্ধি নেন, সেটাই ঠিক বুদ্ধি, কিন্তু আপনি যদি এমন কারও কাছ থেকে বুদ্ধি নেন যে যুদ্ধের ময়দানে না গিয়েই যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, সে কখনোই আপনাকে সঠিক ধারণা দিতে পারবে না। তাই ওদের দুজনের বুদ্ধি আমাদের অনেক কাজে এসেছিল। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে এসে সবারই কমবেশি ঝাঁকুনি খেতে হয়। আমারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে যেহেতু আমাদের আশপাশে অনেক ফেরেশতারূপী মানুষ বসবাস করে, তাই আমাদের অন্যদের তুলনায় একটু কম ঝাঁকুনি খেতে হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় আমার আর রাজীবের মধ্যে বস্তুগত বিশাল দূরত্ব ছিল। কারণ, ও থাকে ক্যানবেরাতে আর আমরা উঠলাম সিডনিতে। তারপরও ও সেই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এসে আমাদের জন্য বাজার করে দিয়ে যেত। যেটা আমরা কখনোই সাহস করে এখানকার কাউকে বলতে পারিনি। তবে আমাদের অপর্যাপ্ত সবকিছুর কারণে ওদের একবেলা পেট ভরে খাওয়াতে পর্যন্ত পারিনি। যাই হোক, একবারের ছুটিতে আমি একা একা একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছিলাম। না ছিল খাওয়ার ঠিক, না ছিল ঘুমানোর ঠিক। ঠিক তখনই ও এসে হাজির হয়েছিল। ওর সঙ্গে ঘুরে সিডনিতেই কিছু অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো। এরপর ওরা আমাকে ক্যানবেরা বেড়াতে নিয়ে গেল। যদিও আমি শুরুতে একটু নারাজ ছিলাম যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু রাজীবের স্ত্রী সিমির চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। এবং এরপরের গল্প আজ আর বলে শেষ করা যাবে না। ছুটিতে সবাই অনেক টাকাপয়সা খরচ করে অনেক দামি দামি জায়গায় বেড়াতে গিয়েছে, কিন্তু আমি ওদের ওখানে গিয়ে যে সময়টুকু কাটিয়ে এসেছি আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময়ের একটি। সেই কলেজজীবনের স্মৃতিচারণ, পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে খুনসুটি আর সবার ওপরে সিমির হাতের রান্না। আমি নিশ্চিত ওই ৪ দিনে আমার ওজন অন্তত ৪ কেজি বেড়ে গিয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়াতেও রাজীব আমাদের পাশের স্টেট এসিটির রাজধানী ক্যানবেরাতে থাকলেও অনেক দিন হয়ে গেছে ওর সঙ্গে দেখা হয় না, হয় না কথাও। উন্নত বিশ্বের জীবন চলে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তাই আমার যেমন ব্যস্ততা আছে রাজীবও ওর দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আসলে এখানকার জীবনপদ্ধতিই এমন যে কাউকে প্রয়োজন না পড়লে তার কথা আমাদের মনে পড়ে না। রাজীবের কথাও আমি তাই বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্য মাঝেমধ্যে যে মনে পড়ে না, এমন নয়; কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আর সেই সময় ওকে কল দেওয়া হয়ে ওঠে না। দূর পরবাসের জীবনে রাজীবের মতো বন্ধুরাই নিঃস্বার্থভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জীবনটাকে সহজ করে দেয়। তা না হলে দেশে পরিবার–পরিজন ফেলে এসে অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় আমাদের স্থির হওয়া কঠিন হয়ে যেত। রাজীবদের কল্যাণে সেটা হয়নি। কিন্তু অকৃতজ্ঞ আমি বাড়ির পাশের আরশিনগরে রাজীব থাকলেও সামান্য সময় করে ওর কোনো খোঁজ নিইনি। মনে মনে দোয়া করি, দূর পরবাসের সবাই ভালো থাকুক আর একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াক।
* লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া