আনত যিশুর শহরে-২
৩.
মারিনপ্ল্যাৎজ স্টেশনটা উজ্জ্বল কমলা রঙে রাঙানো। দেয়ালগুলো বাঁকানো কনকেভ আকারের। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামলে মনে হয় যেন বিরাট এক কমলালেবুর পেটের ভেতর ঢুকে পড়েছি। কেমন খিদে পেয়ে যায় চট করে। তাজা কমলালেবুর ঘ্রাণটা সপাটে নাকে ঝাঁপটা মেরে গেল। খিদেটাকে পাত্তা না দিয়ে চলন্ত সিঁড়ি ধরেছি। মারিনপ্ল্যাৎজ আমার গন্তব্য নয়। বাড়ি ফেরার পথে একটা জরুরি জিনিস কিনতে হবে। তাই মাঝপথে থামা।
সৌম্য চেহারার এক প্রৌঢ়কে ঘিরে জটলা চোখে পড়ছে। কলেজপড়ুয়া কতগুলো মেয়ে রাস্তা জানতে চাইছে বোধ হয়। আমাকে না আটকালেই হলো। পা চালিয়ে হনহন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।
‘এক্সকিউজ মি, একটু দাঁড়াবেন?’ ঠিক জালে আটকে গেলাম, ধুর! সমস্বরের ডাকটা উপেক্ষা করা গেল না। অনিচ্ছায় ঘুরে দাঁড়ালাম।
‘ভদ্রলোক অমুক দোকানের ঠিকানা খুঁজছেন। কিন্তু আমরা তো পথঘাট চিনি না। নিজেরাই ম্যাপ হাতে ঘুরছি।’ মুঠোফোনের গুগল ম্যাপটা দেখিয়ে ইংরেজি টানে ভাঙাচোরা জার্মানে দ্রুত কথাগুলো আওড়াল ওরা। বেশ বোঝা গেল, নানা দেশ থেকে আসা ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র আরকি।
নেহাত ভদ্রতায় পড়ে অনুরোধের ঢেঁকিটা ভালো করে গিলতে না গিলতেই মেয়েগুলো ভোজবাজির মতো এক চম্পটে উধাও! অগত্যা সামনে এগোতেই হলো।
ভদ্রলোকের পরনে সাবেকি বাভারিয়ান কোট। মুজিব কোটে হাতা জুড়ে দিলে যেমন দেখাবে আরকি। মাথায় ফেদোরা হ্যাটের মতো সিল্কের লেস বসানো টুপি মিলিয়ে ভারিক্কি সাজ। এখানকার বয়স্কদের অনেকেই নিজেদের সিগনেচার পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়; উৎসব-পার্বণ ছাড়াই। দেখতে কিন্তু বেশ লাগে। আগের দিনের পোশাক-আশাকে বনেদি একটা ভাব আছে।
তবে জমকালো বেশভূষার সঙ্গে ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা ছড়িটা বড্ড বেমানান লাগছে। হঠাৎ মনে হলো ইনি অন্ধ। আনাড়ি হাতে এলোপাতাড়ি ছড়ি ঠোকার ভঙ্গি দেখে আরও মনে হলো চোখ খুইয়েছেন বেশি দিন হয়নি। ছড়ি বরাবর উঠে গেলে কালো চশমার আড়ালে অস্থিরতা টের পাওয়া যায়।
অবাক করে দিয়ে অস্থিরতার বনামে শান্ত অথচ গমগমে রাশভারী কণ্ঠ কানে এল, ‘ফোনের দোকানটা কোথায় বলতে পারো? ওরা বলেছিল, সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলেই পেয়ে যাব। কিন্তু ডান-বাঁ কিছুই বলেনি। কী করি বলো তো?’
অনুযোগের সুরটা হতাশা মেশানো। দিক খুঁজে পাওয়ার মতো মামুলি-তুচ্ছ ব্যাপারটা আচমকাই কঠিন হয়ে গেছে তার কাছে। তা ছাড়া, ছড়ি ঠুকে চলাফেরাটা ভালো করে না শিখিয়েই তাকে একা ছেড়ে দিয়েছে কেন কে জানে। এ লোক তো যেকোনো মুহূর্তে দড়াম করে আছাড় খেয়ে অক্কা পাবে।
কিছুটা ব্যস্তসমস্ত স্বরে বললাম, ‘দোকানের নামটা আরেকবার বলবেন?’ মনে মনে ভাবছি, এনাকে পথের হদিস ধরিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা মাপতে হবে। কুইক মার্চ।
‘টি-মোবাইল শপ’। নামটা বলেই ভদ্রলোক দিশেহারা মুখে ইতিউতি চাইলেন। যেন খুব জোর চেষ্টা করলে দৃষ্টি ফিরে আসবে আর তিনি ঠিক ঠিকানা বরাবর রওনা দেবেন। দৃশ্যটা স্টেশনের ঝলমলে আলোতেও বড্ড অন্ধকার ঠেকল।
জোর করে সহজ গলায় বললাম, ‘আরে, এত খুব কাছে! সিঁড়ি ভেঙে ওপরে পৌঁছে উঠলেই হলো। পৌঁছে দিচ্ছি, চলুন।’ জবাব শুনে ভরসা পেলেন মনে হলো। কপালের মিলিয়ে যাওয়া ভাঁজগুলো মসৃণ হলো কিছুটা। তার বদলে ভাঁজ হলো ডান হাতটা। বল ড্যান্সের ভঙ্গিতে কনুই বাড়িয়ে দিয়ে দিলেন। যেন এই বলে উঠবেন, ‘শ্যাল ইউ গো, মাই লেডি?’
বলার ধরনের থিয়েটারি কায়দাটা দুর্দান্ত লাগল। একটু আগের অসহায় বুড়ো লোকটা কই যেন মিলিয়ে গেছে। চওড়া একটা হাসি ফুটেছে মুখে।
একমুহূর্ত ইতস্তত করলাম। ভাবছি, এ করোনাকালে ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলব কি না। কিন্তু এমন করে বাড়িয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে দিই কী করে। তাই সংকোচ ঝেড়ে ঠিকানা খোঁজার সঙ্গী হলাম।
চলন্ত সিঁড়িতে বেভুল পা দিতেই ভদ্রলোক হড়কে গেলেন প্রায়। হ্যাঁচকা টানে ধরে না ফেললে হোঁচট ঠেকানো মুশকিল হতো। লোকটি কি এই আজকেই প্রথম একা বেরিয়েছেন? অন্ধদের আলাদা ট্রেনিং দিয়ে তবেই একা ছাড়া হয় যদ্দূর দেখেছি। এমন আনকোরা অন্ধ আর দেখিনি কখনো। শিশুর মতো খুব সাবধানে তাকে বের করে আনলাম পাতালরেলের সুড়ঙ্গ থেকে।
মারিনপ্ল্যাৎজের সুবিশাল চত্বরে বিকেলের নরম আলো ঠিকরে পড়ছে। ওপরে খোলা নীল আকাশে সাদা মেঘের পালক ভাসছে। তাতে কবুতরের ঝাঁক ডানা ঝাপটে ইচ্ছেমতো উড়ছে। এ সদ্য অন্ধ ভদ্রলোক তার কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এর কোনো মানে আছে? কেমন একটা অন্ধ ক্ষোভ আমাকেও জেঁকে ধরল।
‘কই, বলো, এবার কোন দিকে যাব?’ নিজের ভাবনার জগৎ থেকে সংবিৎ ফিরে তাকালাম। ফোনের শোরুমটা তো চিরকালই এখানে ছিল। স্টেশন থেকে উঠলে ‘রিশার্ট’ নামের বেকারি, তারপরই একটা কসমেটিক শপ। আর গা ঘেঁষেই ফোনের দোকান। কিন্তু এখন কোথায় হাপিশ হয়ে গেল সেটা।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, সারি সারি দোকানপাটের কোনোটারই নাম পড়তে পারছি না। অক্ষরগুলো ঘোলাটে লাগছে। যেন ঘষা কাচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ডগুলো ওপরে।
‘কী, ঠাহর হচ্ছে না ঠিকমতো? একবার ফোনে দেখবে নাকি?’ ভদ্রলোক তাড়া লাগালেন।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্ষুনি দেখছি...।’ পকেট হাতড়ে মুঠোফোন বের করতে করতে বললাম।
এবার সত্যিকারের নার্ভাস লাগছে। মুঠোফোনের স্ক্রিনটাও বুঝি কেউ ঘষে দিয়েছে দেয়ালে। ম্যাপে দেখানো রাস্তাগুলো বোঝা যাচ্ছে না ভালো করে। সাপ বনে গিয়ে তারা এঁকেবেঁকে চলছে নিজের খেয়ালে। চারপাশের বিকেল উবে গিয়ে গাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল আচমকাই। কিছুই দেখতে না পাওয়ার বিকট আতঙ্ক গলা চেপে ধরল তীব্রভাবে।
‘হাই, কোনো সাহায্য করতে পারি?’ মাঝবয়সী এক নারী থেমে দাঁড়ালেন।
‘জি, মানে, আমরা টি-মোবাইল শপটা খুঁজছি...।’ কোনোমতে চিঁচিঁ করে বললাম।
‘তোমরা তো দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছো, পেছনে লোকের লম্বা লাইন, দেখছ না?’
ঘাড় ঘুরিয়ে বোকা বনে গেলাম। নিয়ন গোলাপিতে বড় বড় করে লেখা নামটা। এই তো পরিষ্কার দেখছি আবার।
‘এই যে নিন, পৌঁছে গেছি।’ আমতা-আমতা করে জানালাম সঙ্গের ভদ্রলোককে।
হাতের ইশারায় রিসেপশনে দাঁড়ানো লোকটাকে ডাকলাম। সে এক পলকে সাদাছড়িটা দেখে এগিয়ে এল। তার অন্ধ কাস্টমারকে লাইন ভেঙে সামনে নিয়ে যাবে।
বুড়োটা এবার ঘুরে তাকাল, ‘বাছা, অনেক করলে। ঠিকঠাক ফিরে যাও।’ খেয়াল হলো এখনো তার বাহু ধরে রেখেছি। লজ্জা পেয়ে হাত গুটিয়ে নিতেই হাতটা আবার খপাৎ মুঠোয় পুরে নিল সে। আলতো একটা উষ্ণ চাপ দিয়েই আবার ছেড়ে দিল।
ধীরলয়ে হাঁটছি। ঠিকঠাক তো আমি ঠিকই ফিরব। কিন্তু ইনি ঠিক বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন তো? স্টেশনের সিঁড়িতে হোঁচট খাবেন না তো? আবার অমন হঠাৎ করেই-বা ক্ষণিকের তরে দৃষ্টি হারালাম কী করে। অন্ধত্ব কি কখনো কখনো সংক্রামক?
প্রশ্নগুলো বুদ্বুদ হয়ে ভাসতে লাগল মারিনপ্ল্যাৎজের কমলালেবু প্ল্যাটফর্মে।
৪.
টিনের বাক্সে চাকা লাগিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন গড়িয়ে চলে, তেমনি ঝনঝনিয়ে গ্যোথেপ্লাৎজ স্টেশনে এসে থামল রদ্দি মার্কা ট্রেনটা। জার্মানদের এই এক গুণ। কিংবা বেগুণ। ভাঙাচোরা মাল ভেঙে সাত টুকরো না হওয়া পর্যন্ত নাট-বল্টু টাইট দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দেয়। বিকট ঘটাং শব্দে ধাতব হাতল ঘুরিয়ে নেমে এসলাম। বাবা গো, হাতটা গেছে।
হাইফাই অটোমেটিক ট্রেনও আছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানো বলে কথা। প্ল্যাটফর্মে যেটা আগে আসে, সেটাতেই বাদুড়ঝোলা হয়ে ঝুলে পড়ি। বেশির ভাগ দিনই ঘটাং ট্রেন জোটে কপালে। তবে সময়মতো পৌঁছে দেয় বাড়ি। তাই তার সাত খুন মাফ।
ছেলেটাকে ইশকুল থেকে তুলতে হবে। সময়ের আগে চলে এসেছি। এখনো পাক্কা মিনিট পনেরো হাতে। মোড়ের ক্যাফেতে একপ্রস্থ কফি হয়ে যাবে নাকি ভাবছি। এমন ছোট ছোট অবসর দুর্লভ বোনাসের মতো। বোনাস উদ্যাপন করা উচিত। লম্বা লম্বা পা ফেললাম।
অমনি কোত্থেকে এক উটকো আধা মাতাল দড়াম ধাক্কা মেরে গেল। কী আশ্চর্য, ধাক্কা খেয়ে উল্টো নিজেই মুখ ফসকে সরি বলে ফেলেছি। নিজের গাধামিতে গা জ্বলে গেল। সেটা পুষিয়ে নিতে মনে মনে কড়া কয়েকখানা গালি দেওয়ার তোড় করছি। সুযোগটা অবশ্য দিল না সে। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের এক থাম্বার নিচে ঝুপ করে বসে পড়ল। চুরচুর হদ্দ মাতাল যাকে বলে। কয় পেগ টেনেছে, খোদা মালুম। এখন একদিকে গড়িয়ে রেললাইনের ওপর গিয়ে পড়লে না হয়। স্টেশনে ভিড় নেই, সুনসান। পড়ে গেলে খেয়াল করার লোক নেই।
ধেৎ, পড়ুক গে যে চুলায় পড়ার। এক কাপ ধূমায়িত কফির উষ্ণ চিন্তাটা থেকে একচুল নড়লাম না। বেরিয়ে এলাম স্টেশন ছেড়ে।
এগিয়েও গিয়েছি কয়েক কদম। কী ভেবে থামলাম। বছরখানেক আগে কে যেন এই গ্যোথেপ্লাৎজে সুইসাইড করেছিল। সে তো মরেইছিল; বাকিদেরও ভুগিয়েছিল চরম। পুরো স্টেশন শাটডাউন ছিল সেদিন। ট্রেনের অভাবে তিন থেকে চারটা বাস-ট্রাম ঠেঙিয়ে অফিস গিয়েছিলাম বহু কষ্টে। এই মাতাল যদি সত্যি সত্যি গড়িয়ে রেলে কাটা পড়ে, তাহলে কাল আর ট্রেন ধরতে হবে না।
ইতস্তত করে এক-এক-দুই চাপলাম। পুলিশের নম্বর।‘লোকটা কি আরব চেহারার?’
‘অ্যা, ইয়ে, দেখতে তো পাক্কা জার্মান। বড়জোর ইস্ট ইউরোপীয় হতে পারে’।
‘দাড়ি-মোচ আছে? বয়স কত, উচ্চতা কেমন, মাতাল নাকি নেশাখোর টাইপ...?’
রীতিমতো পুলিশি জেরার মুখে চিঁচিঁ জবাবে জানালাম, ‘চাপদাড়ি আছে, চল্লিশ-টল্লিশ হবে, আর মাতালই তো ঠেকল...।’
‘এক্ষুনি টিম পাঠাচ্ছি। আপনি স্টেশনে ফিরে যান প্লিজ, লোকটাকে খুঁজে পেতে সহজ হবে।’
বাধ্য ছাত্রের মতো সায় দিয়ে উল্টো ফিরে লেফট-রাইট ঠুকলাম। গাট্টাগোট্টা জার্মান পুলিশের সঙ্গে মোলাকাত বোধ হয় আর ঠেকানো গেল না। কী দরকার ছিল গায়ে পড়ে নম্বর ঘোরানো। একটা-দুটো মাতাল কি পাগল তো সব স্টেশনের কোনাকাঞ্চিতেই গড়াতে থাকে। এরা জাতে মাতাল, তালে ঠিক। রেলে কাটা পড়ার মতো নবিশ এরা নয়। খামোখাই খাল কেটে পুলিশ-কুমির আনছি। এখন আমাকে হাঁ করে গিলে নিয়ে হাজতে উগরে না দিলেই হয়।
ভীরু পায়ে দ্রুত নেমে এলাম পাতাল স্টেশনে। সব কটি খাম্বা-থাম্বার চারপাশে চোখ বোলালাম। নেই। লোকটা ভ্যানিশ! হঠাৎ শেষ মাথার পিলারের কাছে মাঝবয়সী এক নারীকে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখলাম; যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে। প্রায় ছুটে গেলাম। আরে, এই তো সেই মাতাল। মাথাটা বুকের সঙ্গে ঠেকানো। কাঠের পুতুলের মতো লাগছে।
ওই নারী হাতের ইশারায় কিছু একটা বললেন। বুঝলাম, জোর কাউন্সেলিং চলছে। তবে লোকটার প্রতিবাদী বিড়িবিড়ানি শুনে মনে হচ্ছে ভালো কথায় চিড়ে ভিজছে না। খুব সাবধানে গোল হয়ে চক্কর কাটছি। সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ আরকি। টুকরা কথাগুলো কানে আসছে ভাঙা ভাঙা।
‘জীবনে কত কী করার আছে। লাফ তো কোনো সমাধান না। সব রেখে এক লাফে পগার পার হলে লাভটা কী হলো, বলো?’
এ তো দেখছি রবিবারের গির্জায় পাদরির আওড়ানো বুলির মতো একঘেয়ে বাৎচিত!
সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে কথাগুলো ঝেড়ে ফেলে দিল মাতাল লোকটা। মাতাল ভাব কমে গিয়ে তাকে এখন উদ্ভ্রান্ত লাগছে। চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছে। যেন একটা সুযোগ খুঁজছে। আড়চোখে বারবার রেললাইনের দিকে তাকানোটা মোটেও ভালো ঠেকছে না। লোকটা তাহলে সত্যি সত্যি সুইসাইড করতে এসেছিল। এই অচেনা, আগন্তুক নারী যেচে পড়ে একে না থামালে এতক্ষণে মামলা খতম হয়ে যেত।
চোখের সামনে মরতে চাওয়া একটা আস্ত জ্যান্ত মানুষকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে বিস্ময় আর কাটছে না। কী তার কাহিনি, কী তার ব্যর্থতা কিংবা বেদনা, কিছুই জানার উপায় নেই। একটা অদ্ভুত ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশ এসেইবা কী করবে। এত ‘ধরো তক্তা, মারো পেরেক’ টাইপ চোর-পুলিশ কেস নয়।
এদিকে দুই মেরু থেকে দুই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। লাফ দেওয়ার মোক্ষম সময়। আর যদি ঝাঁপিয়ে পড়েই, তাহলে তাকে ঝাঁপানোর আগেই ল্যাং মেরে ফেলে দেব, নাকি জ্যাকেট ধরে হ্যাঁচকা টানে প্ল্যাটফর্মে তুলে আনব—এসব হাস্যকর চিন্তা করছি। না করে উপায় নেই। কারণ ভদ্রমহিলাও ঝুঁকি আঁচ করতে পেরে লোকটার কাঁধে আলতো হাত রেখেছেন। যেকোনো মুহূর্তে জাপটে ধরে পথ আটকে দেওয়াই উদ্দেশ্য। চারপাশে আমজনতা যে যার মতো ঘাড় গুঁজে আসছে যাচ্ছে। দৃশ্যটা হয়তো চোখেও পড়ছে না। প্রতিটি মানুষ যেন সংযোগবিহীন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
আচমকাই ট্রেন দুটো গতি কমিয়ে খুব সাবধানে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোথাও থেকে নির্দেশ এসেছে নির্ঘাত। ভাবতে না ভাবতেই পুলিশের ছোট দলটাকে দেখে হাত নাড়লাম দূর থেকে।
‘কই সে লোক, বলো। সিসি ক্যামেরায় পিলারের আড়ালগুলো ভালো করে দেখা যায় না।’
আলাদিনের চেরাগ-দৈত্য সাইজের ষন্ডা মার্কা পুলিশ বাহিনী দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। এরা কাঁধে দড়ি আর মই, সঙ্গে ফোল্ডেড স্ট্রেচার, সিপিআর দেওয়ার মেশিন আর কী সব নিয়ে কমান্ডো স্টাইলে চলে এসেছে। জোগাড়যন্ত্র দেখে কলিজা শুকিয়ে খাক! ঢোঁক গিলে আমাদের নায়ককে দেখিয়ে দিলাম। পুলিশের একাংশ সেদিকে ছুটল।
রয়ে যাওয়া মোটাসোটা নারী পুলিশ সদস্য কাছে এগিয়ে সুধাল, ‘সে তো দেখছি দিব্যি প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। তুমি না বললে রেললাইনে শুয়ে আছে?’
শুনে চোয়াল ঝুলে গেল।
‘এমন তো বলিনি। শুধু বলেছি রেললাইনে ঝাঁপটাপ দিতে পারে।’
‘বানস্টাইগ মানে প্ল্যাটফর্ম। গ্লাইস মানে রেললাইন। আমরা কিন্তু দুবার করে জিজ্ঞাসা করেছি, লোকটা কি গ্লাইসে? তুমি “হ্যাঁ” বলেছ। এখন তোমার আউসভাইস, মানে পরিচয়পত্রটা দেখাও দিকিনি।’
রেসিডেন্স পারমিটের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডটা বের করতে করতে প্রমাদ গুনলাম। অ-আ-ক-খ লেভেলের জার্মান দিয়ে এ দেশে বেশি দিন টেকা যাবে না। একদিন ঠিক কোথাও এভাবে ফেঁসে যাব।
‘বাহ, ক্লিনিকের গবেষক। একেবারে খারাপ না দেখছি। ডক্টর সারকার, এই নিন, ধরুন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বিবাদী সিল-ছাপ্পর এবেলা বোধ হয় বাঁচিয়ে দিল। এপিঠ-ওপিঠ কার্ড ঘুরিয়ে নারী পুলিশ সদস্যের কপালের ভাঁজ কাটল মনে হল। তা ছাড়া এক ধাপে পুলিশি ‘তুমি’ গিয়ে ‘আপনি’তে ঠেকেছে। কানে বড় মিষ্টি লাগল সম্বোধনটা।
দেঁতো হেসে মাতাল লোকটাকে ওদের হাতে ফেলে চলেই যাচ্ছিলাম। আপদ বিদায়ের আনন্দ হচ্ছে মনের ভেতর।
নাহ, হলো না। দুই পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে ভদ্রমহিলাকে ধরলাম।
‘লোকটা কিন্তু সুইসাইড করতেই এসেছে। ভাগ্য ভালো যে আপনারা তাকে গ্লাইসের ওপরে চার টুকরো পাননি; বরং প্ল্যাটফর্মে আস্ত পেয়েছেন। তাই বলছি, জোর খাটিয়ে কথা না বলে ইমোশনাল সাপোর্টের ব্যবস্থা করুন।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা দেখছি। নো ওয়ারিজ।’ আশ্বস্ত করার খুব একটা চেষ্টা না দেখিয়ে ভদ্রমহিলা দায়সারা ভঙ্গিতে সেদিকে চললেন।
আর নাক না গলিয়ে অবাধ্য পা ফেলে ফিরে চললাম। হাতে সময় নেই একদম। ছেলেটা স্কুলগেটে একা দাঁড়িয়ে থাকবে। হেঁটে গেলে হবে না। লম্বা দম নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। চারপাশের এই ঘোর ধরানো পরাবাস্তব জগৎ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে দ্রুত।
সময় না দিয়েই কাছের গির্জার ঘণ্টা ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠল। আনত যিশুর এই শহর বড্ড যান্ত্রিক। জীবন এখানে ঘড়ির দুই বাহুতে বন্দী। এতটুকু ভুলচুক বরদাশত হওয়ার নয়। তবু কারও–বা কখনো ভুল হয়ে যায়। চলার পথে এই ভুলে ভরা চরিত্ররাই পথ আগলে দাঁড়ায়। আফসোস, তাদের কঠিন সব হিসাব মিলিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, গল্পগুলোই যে অজানা। শেষ...
* লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।