‘মামা সৈয়দবংশ!...চুরি করমু’
কিংবদন্তিতুল্য যাঁর জনপ্রিয়তা, সেই লেখক হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে (সম্ভবত বহুব্রীহি) গৃহ থেকে বিতাড়িত গৃহভৃত্য কাদের নামের চরিত্রটিকে যখন রিকশা চালানোর কথা বলা হয়, তখন তিনি বলেন, ‘মামা সৈয়দবংশ! রিকশা চালামু? মাইনসে দেইখখা ফালাইব না! ’
মামার প্রশ্ন ‘তো কি করবি?’
‘চুরি করমু’।
শুধু অর্থহীন বংশগরিমা রক্ষায় রিকশা চালানোর চেয়ে চুরি করাকে শ্রেয় মনে করছে কেউ আর কেউ সংস্কৃতজাত মানসিক দ্বিধায় সামান্য কাজ করাকে অবজ্ঞা করছে, ভীতচোখে দেখছে।
সুস্মি (সুসমা) এই দেশে এসেছে ১০ সপ্তাহ হয়নি। এরই মাঝে ট্রেনে চড়ে অফিসে যাওয়ায় অভ্যস্ত হচ্ছে। দুবাইতে সুস্মির বাচ্চা রাখার লোক ছিল; যাকে গভর্নেস বলা যায়। তার কাছে নিশ্চিন্তে বাচ্চা রেখে সে গাড়িতে চড়ে অফিসে যেত। ভারতে ট্রামে–বাসে কখনো–বা রিকশায় চড়ে কলেজ ও ইউনিতে গেছে। আর এই দেশে গভর্নেস তো দূরের কথা, একটা আয়াও নেই! আর থাকলেও তা সাধ্যের বাইরে। শহরে গাড়ি নিয়ে আসাও মুশকিল। কারণ, গাড়ির পার্কিং সীমিত। তাই ভোরবেলাই বাচ্চাসহ ট্রেন ধরা। বাচ্চাকে চাইল্ডকেয়ার সেণ্টারে নামিয়ে দিয়ে তবে অফিসে পৌঁছানো। তাই প্রতিদিন কিছুটা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়। মিনিট দশেক সময় স্টেশনে দাঁড়িয়ে মানুষের যাতায়াত দেখে আর ভাবে। কত কী ভাবে। জীবন কোথাও চূড়ান্ত নিশ্চিত নয়—এই অমোঘ সত্য ধরা দেয় চেতনায়।
আজ দেখে, এক মহিলা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে এক প্যাকেট চকলেট। যে যাচ্ছে তাকে একটা করে চকোলেট দিচ্ছেন। সুস্মি ভিড় কমলে মহিলার কাছে গিয়ে জানতে চাইল কীসের জন্য চকলেট বিলানো হচ্ছে। মহিলা চোখে পানি নিয়ে বলল, তার ছেলে আজ ফিশ অ্যান্ড চিপসের দোকানে কাজ শুরু করেছে, সেই আনন্দে তিনি চকোলেট বিলাচ্ছেন। ছেলের বয়স কত জানতে চেয়ে সুস্মি অবাক। ১৭ বছরের ছেলে এখনই আগুনের কাছে রান্নাবান্নার কাজ করতে যাবে, সেই আনন্দে মা অপরিচিত মানুষকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন! এ কোন আজব দেশে এসে পড়ল!
সুস্মি প্রামে বসা ছেলে কৃষের দিকে তাকাল। মনে মনে প্রার্থনা করল, তার ছেলেকে যেন কোনো দিন ফিশ অ্যান্ড চিপসের দোকানে কাজ করতে না হয়। তার আদরের কৃষ্ণ এখানে হয়ে গেছে কৃষ। এ দেশে ক্রিস্টোফারকে সংক্ষেপে ক্রিস বলে। কৃষ বা কৃষ্ণের জীবন যেন তার নিজের জীবনের চেয়েও ভালো ও মসৃণ হয়, সেই আশাতেই তো এই দেশে আসা। দুবাইতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট হিসেবে ভালো চাকরি ছিল তার, স্বামীও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ায় রেসিডেন্সির জন্য চেষ্টার পাশাপাশি চাকরির জন্যও বিভিন্ন সংস্থায় আবেদন পাঠিয়েছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই দুটিই একসঙ্গে হয়ে গেল। অর্থবিত্ত তাদের যথেষ্ট আছে। তবুও আসার পর থেকে বারবার মনে হচ্ছে, শুধু অর্থ থাকলেই ভারত বা দুবাইয়ের মতো স্বাচ্ছন্দ্য এখানে মেলে না। আজকের এই ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলল খুব। দুপুরে লাঞ্চ খাওয়ার সময় বাংলাদেশের সহকর্মী রায়া আলীকে ঘটনাটা বলে সুস্মি। সে বয়সে সুস্মির চেয়ে বড়, তার স্কুল– কলেজপড়ুয়া সন্তানও রয়েছে। মাঝারি লম্বার চিকন গড়নের নম্র গম্ভীর মহিলাকে ভাবুক মনে হয়। সুস্মি জানতে চাইল, তার মতো ভাবনা কি একেও দোলা দিয়ে গেছে কখনো! সব শুনে সুস্মিকে রায়া আশ্বস্ত করে বলে যে এই দেশে নিয়মই হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা কিছু কিছু কাজ করে বড় হয়। এদের মতে দায়িত্বশীল হয়ে বড় হওয়ার জন্য কাজ করাটা দরকার। সব শুনে সুস্মির বিস্মিত প্রশ্ন, ‘ছোটবেলা মানে কত ছোট? ’
‘এই যেমন ইয়ার টেন বা গ্রেড টেনে পড়ার সময়ে স্কুলের পাঠের অংশ হচ্ছে ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স অর্জন করা।’
‘তোমার বাচ্চারাও কি করেছিল?’
রায়া নিজের অভিজ্ঞতা তখন বর্ণনা করে।
তারও আছে দুই ছেলে। বড়জন ইয়ার টেনে থাকার সময়ে এক ইলেকট্রনিকের দোকানে কাজ করেছিল ১০ দিন। পয়সাও পেয়েছিল সামান্য। ইয়ার ইলেভেনে পড়ার সময়ে এক ছুটির দিনে সকালে নাশতার টেবিলে ঘোষণা করল, ‘আমি উইকএন্ডে কয়েক ঘণ্টা কাজ করব। দেখি কি কাজ পাই।’ রায়া ও তার স্বামী আঁতকে উঠল ছেলের কথা শুনে। তাদের আয়–উপার্জন ভালো। ছেলেদের চাহিদাও মিটিয়ে যায় দরাজ হাতে। দুই ছেলের জন্য এডুকেশন ইনস্যুরেন্স বা শিক্ষাবিমার জন্য প্রতিমাসে মোটা টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে যাচ্ছে। আর ছেলে চায় কাজ করতে! ওর মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো? নাকি বাজে সঙ্গীসাথি জুটেছে, তাই বাড়ি ছাড়ার মতলব করেছে? ভয় হলো তাদের। তবে অবস্থা দেখে তো সে রকম কিছু মনে হয় না। কোনো রকম মাথার গন্ডগোল বা মনের অস্থিরতা তো বোঝা যায় না। পড়াশোনা করছে আগের মতোই, বিতর্ক-বক্তৃতা, ক্রিকেট-বাস্কেটবল সবই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাজের জন্য উতলা কেন হঠাৎ। কারণ জানতে চাইল ওরা। বলল, পয়সা লাগলে আরও পয়সা দেবে ওরা। তা–ও এই বয়সে কাজের চিন্তা ছাড়ুক।
ছেলে বলেছিল, ‘আহ্হা, পয়সার জন্য না। বন্ধুরা সবাই কাজ করছে সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা হলেও, আর এই দেশে বড় ডিগ্রি থাকলেই চট করে চাকরিতে নেয় না, যদি আগের অভিজ্ঞতা না থাকে। জানো, অস্ট্রেলিয়ার একসময়ের লেবার দলের নেতা ও মিনিস্টার কিম বিজলী স্কুলে থাকার সময়ে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন কবর খুড়নেওয়ালা হিসেবে। বাকিরাও কোনে না কোনো কাজ করেছেই।’
তার পরও ছেলের কাজের বিষয়ে মা-বাবার অনীহা দেখে সে বিরক্ত হয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বলছিল—
‘ঠিক আছে, তবে ইউনি শেষ করলে তোমরাই আমাকে চাকরি খুঁজে দিও।’
সুস্মি গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইল।
‘তারপর কী হলো?’
ছেলে ভালোভাবে পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। এখন চাকরি নয়, কয়েক ঘণ্টার ছোটখাটো কাজ পাওয়াও হয়ে দাঁড়াল মহামুশকিল। ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি স্কুলের বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করায়। যারা স্কুলে পড়ার সময়ে ঢুকেছিল কাজ করতে, ইউনি শুরু করলেও ওই একই পারিশ্রমিকে তাদের দিয়ে কাজ করানো যায় বলে এদের বিদায় করে না। তবে সরাসরি ইউনি পড়ুয়াকে নিতে চায় না বয়স আঠারো বছরের বেশি বলে। এ সময়ে মজুরি বেশি দিতে হয়।
‘তখন বুঝলাম, ছেলের বাস্তবজ্ঞান আমাদের চেয়েও বেশি, সাধে কি বলেছিল ছোটখাটো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে পেশা অনুযায়ী কাজ জোটানো সহজ নয়। তার পরও অনেক খোঁজাখুঁজি করে ইন্ডিয়ান এক রেস্টুরেন্টে শনিবার সন্ধ্যায় চার ঘণ্টার কাজ জোগাড় করেছে। অথচ স্কুলে থাকার সময়ে ওই ইলেকট্রোনিকের দোকানে চাইলেই কাজ করতে পারত।’
সুস্মি বলল—
‘ধরো, কারোর প্রয়োজন নেই ছুটকা কাজের; তবে সে কেন করবে?’
‘তার হয়তো দরকার নেই; তবে একসময় ওকে যারা বড় কাজে, মানে পেশাগত কাজে নিয়োগ দেবে, তারা দেখতে চাইবে পরিবারের বাইরেও বৃহৎ সমাজে, ভিন্ন পরিসরে নানা ধরনের, নানা স্বভাবের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য ওর অর্জিত হয়েছে কি না। ওই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে টিমওয়ার্ক অ্যাবিলিটি এসব গড়ে ওঠে, বুঝলে?’
‘জানো, তবুও আমার ভাবতে কষ্ট হয় যে স্কুলে পড়ার সময়েই আমার ছেলেকে কাজ করতে হবে, তাছাড়া আমারতো পয়সার দরকার নাই। ’
কথাটা বলে কেমন উদাস হয়ে গেল সুস্মী। রায়া আলী ভিনদেশের ভিন আচরণের ভাবনা কাতর সুস্মীর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে, ‘শোন, কাজ করা ভাল। বাচ্চারা শ্রমের মর্যাদা দিতে শেখে, দায়িত্বশীল মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। ঐদিন অপরাহ উইনফ্রের অনুষ্ঠানে দেখাল ওয়ারেন বাফেটের নাতনি নিকোল বাফেট পড়ছে আর পাশাপাশি এক বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করছে।’
‘কোন বাফেট? যে মেলিন্ডা-গেট ফাউন্ডেশনে কত বিলিয়ন না মিলিয়ন ডলার যেন দান করেছে, সেই কি?’
‘হ্যাঁ, ‘সেই বাফেটই, মজার কাণ্ড যাদের বাড়িঘর মেয়েটি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে, তারা বাফেটের মতো তত ধনীও নয়।’
‘মেয়েটি নিশ্চয়ই বাফেটের ওপর মহাবিরক্ত, তাই না?’
‘আমিও ভেবেছিলাম তা–ই হবে, আসলে তা নয়। নাতনি বলল বাফেটের সম্পদ যদি বিশাল জনগোষ্ঠীর উপকার করে, তবে তা–ই হওয়া উচিত। ও বেচারি কৃতজ্ঞ যে তার নানা বাফেট সাহেব তার পড়াশোনার খরচ দিয়েছেন।’
এবার সুস্মি আন্দোলিত হলো। তারপরে কিছুটা সময় ভেবে নিয়ে আশ্চর্য এক কথা বলল সে, ‘জানো, এখন মনে হচ্ছে, আসলেও কাজ করেই বড় হওয়া উচিত। জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের তফাত শ্রমে। পশুরা কাড়াকাড়ি, মারামারি করে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে, আর মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে, উন্নত করেছে তার শ্রম। ছোটবেলা থেকেই শ্রমে অভ্যস্ত হওয়া ভালো।’
ভিনদেশের হাওয়া কিছুটা পরিবর্তন এনে দিল সুস্মির চিন্তা–চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারপরও সে চিন্তা করল যে ভিনদেশের ভিনসংস্কৃতির ততটুকুই সে গ্রহণ করতে রাজি, যতটুকুতে কারও কোনো ক্ষতি না হয়। অন্যের ভালোটুকু গ্রহণ করলে কেউ তার নিজস্বতা হারাবে না নিশ্চয়।