জারদৌসি নকশা ও কুসুমের ঈদ
রাত তিনটা। রাত পোহালেই কাল ঈদ। কুসুম ৪ নম্বর সড়কের বাড়ির বাইরে পা রাখল। কামিজে পুঁতি-চুমকি বসানো ও আরও নানান জারদৌসি কাজ সারতেই রাত গভীর। সুফী ও আরজু কিছুটা পথ এগিয়ে দিচ্ছে কুসুমকে। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী এই ধনীপাড়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পোশাকগুলো পৌঁছে দেবে। জরুরি কাজ রাত জেগে করায় রোজগারও বেশি। কুসুম স্বামীকে বলেছিল রাত ১২টা বাজতে পারে। এত রাত হওয়ায় ভয় পাচ্ছে। যদিও তার স্বামী মানুষ ভালো। পোশাক কারখানায় সেলাইয়ের কাজ করতে করতেই স্বামীর চোখ যাওয়ার পথে। এখন তাই কাজও বন্ধ। কুসুম প্রাণপণ খাটছে। আজকের রাতের উপার্জন দিয়ে স্বামীকে ভালো চোখের ডাক্তার দেখাতে পারবেন, চশমা কিনে দিতে পারবেন। ভীষণ ক্লান্ত-শ্রান্ত কুসুমকে এ ভাবনা একটু স্বস্তি দিল। বাড়ি পৌঁছে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়ে উঠেই সিঁড়ি ধুয়ে ফেলবে। নামাজে যাওয়ার আগেই সিঁড়ি সাফসুতরা থাকা চাই—মালকিনের নির্দেশ।
তারপর দুই সন্তানকে গোসল করিয়ে ঈদের নতুন জামা পরাবে। নতুন জুতা কিনতে পারেনি। নাশতা ওপরতলার মালিক খালাম্মাই খাওয়াবেন। কুসুম বছরে একদিনই মাংস রান্না করে। সে এই ঈদের দিনে। আদা-রসুন খালাম্মার কাছ থেকে চেয়ে আনবে। আর গরমমসলা গরিবের জন্য নয়।
এদিকে বড়বাড়ির গেটের কাছে খুপরি ঘরে ঘুমহীন স্বামী। রাত একটা পর্যন্ত কুসুমের জন্য দরদে বুক উথালপাতাল করেছে। তারপর এক ঘণ্টা দুর্ভাবনায় নির্জীব ছিল। দুই সন্তানকে ঘুমন্ত রেখে কুসুমকে আনতে যাওয়ার কোনো উপায় মাথায় আসছে না। উপায় বের করতে না পেরে শান্ত ভালো মানুষটির মাথা গরম হতে শুরু করল। কুসুমের জন্য দুশ্চিন্তা বাদ। কুচিন্তা রাগের মধ্যে ঘি ঢালল। হৃদয় বলছে, কুসুম খাটছে। রাতদিন অসুরের মতো। রাগের মাথা বলছে, বদ ও নষ্ট মেয়েরাই কাজের বাহানায় রাত করে ঘরে ফেরে।
গেটে মৃদু খুটখাট শব্দ। রাগে জ্ঞানহীন স্বামী গেট তো খুললই না, উপরন্তু নিচু গলায় যে অশ্লীল শব্দাবলি উগরে দিল, কুসুমের কালা হয়ে যেতে ইচ্ছা হলো। কুসুমের ভালো মানুষ স্বামী আজ পাগল হয়ে গেছে। কান্না জড়ানো গলায় বারবার কাকুতি-মিনতি করল।
-গেইটটা খুলো না রনির বাবা! পায়ে ধরি; পায়ে ধরিগো তোমার!
-বিদায় হও, কুত্তি বদমাশ মাইয়াছেলা কোনহানের
-দেখ, তুমি দেখ চাইয়া কত্ত টাকা! তোমার চোখ ভালো ডাক্তাররে দেহান যাবানে রনির বাপ!
-চুপ চুপ নষ্ট মাইয়াছাইলা; তোমার টাকায় আমি থুতু দেই; থুহ্ থুহ্
-চোখ ভালো হলি তুমিই কাজ করবানে; আমারে আর কাজে যাতি হবিনানে!
-তোমার টাকাও চাই না তোমারেও চাই না, বুঝলা। তালাক দিলাম। তালাক তা....
-দোহাই তোমার রনির বাবা, থাম থাম!
ওই ভোররাতে কুসুমের স্বামী থামেনি। তালাকের বজ্রাঘাতে কুসুম কি মরে গেল? কেউ তা জানে না। শুধু ঈদের নামাজগামী মানুষ দেখল ট্রাকের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছেন এক নারী।
পলাতক
নিউইয়র্ক শহরে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। ম্যানহাটানের ১১৬ নম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এখান থেকে ৭২ নম্বর ম্যানহাটানে হোটেলে ফিরতে হবে। ট্যাক্সি করে ফিরবে ভাবছে। সাউথ আফ্রিকার ফরসা অ্যালেন, কালো সারাফিনা ও দুধ মেশানো কফিরঙা অন্য আরেকজন। ট্যাক্সি দাঁড়াতেই ওরা উঠে পড়ল। কফিরঙা অন্যজন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। কথা হলো সামান্যই। সারাফিনারা মাঝপথেই নেমে যাবে।
‘তোমরা ট্যুরিস্ট?’
‘আমরা বিদেশি, কনফারেন্সে এসেছি।’
‘জানি, এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা—সব মহাদেশ থেকেই?’
‘কি করে জানলে?’
‘দুদিন ধরে যাত্রী তুলছি এখানে তাই; তা তোমরা?’
‘আমরা সাউথ আফ্রিকা থেকে।’
‘আমি এশিয়ার বাংলাদেশ থেকে।’
‘বাংলাদেশ!’
উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত চালক তার দিকে চকিতে তাকাল।
‘কেন চেন কাউকে?’
চালকের গলায় দ্বিধা।
‘নাহ্। ঠিক তা নয়।’
চালকের দিকে অন্যজন ভালো করে তাকিয়েও দেখল না। ট্যাক্সি থামল। সারাফিনা ও অ্যালেন ওদের ভাগের যা ভাড়া, সে পয়সা অন্যজনের হাতে দিয়ে নেমে গেল। ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। কিছু দূর গিয়েই হঠাৎ আবার ট্যাক্সি থামল। চালক দ্রুত দরজা খুলে নামতে নামতে বলল, ‘Just a second, I will be back soon.’
অপেক্ষা করতে করতে সে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা ছবিসহ চালকের পরিচিতি দেখতে পেল। ঝুঁকে পড়ে দেখল। একে কোথাও দেখেছে কি? এবার আগ্রহ নিয়ে নামটা পড়ল। ব্যথাহত মন নীরব আর্তনাদে ভেঙে পড়ল, ‘আরে এ তো সেই! আশ্চর্য, কেন সে রইল না আমার জীবনে? তার সঙ্গে প্রথম দিন স্কুলে যাওয়া হতো। সে আমার সঙ্গে কলেজে ভর্তির ফরম তুলতে যেতে পারত। আরও আরও অনেক কিছু করা যেত। মায়ের ছুটি মিলত না সহজে, তাই পাশের বাড়ির পাতানো নানু ছিল আমার সাথি। একা একা কত কাজ করতে হয়েছে। মায়ের কাছে আমি উধাও বাবার গল্পই শুধু শুনেছি, ছবিই দেখেছি। কেন বাবা চলে গেল? কী করেছিলাম আমি? কষ্ট দিয়ে কিছু কি বলেছি কখনো? আমার তো কথাই ফোটেনি তখন! কষ্ট দেব কি...’
গাড়ির জানলায় টোকা পড়তেই চমকে মুখ তুলে তাকাল। পুলিশ দাঁড়ানো। স্বগতঃ কথন থেমে গেল। কাচ নামাল।
‘এটা গাড়ি থামানোর জায়গা নয়, নেমে আস, গাড়ি টো (Tow) করে নেবে,’
শাড়ি পরা মেয়েটি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ক্লান্ত দেহে, ব্যথাহত চোখে ট্যাক্সিচালকের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইল।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]