নদীগুলোর কি শেষ রক্ষা হবে না, দখলদারেরা জিতবেন?

এককালের প্রমত্তা করতোয়া নদী এখন দূষণে বিপন্নপ্রায়। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীতে বিভিন্ন স্থান থেকে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ছবিটি আজ রোববার বগুড়া শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকা থেকে তোলাছবি: সোয়েল রানা

ইউরোপের রাইন নদী নয়, ইংল্যান্ডের টেমস নদী নয়, সুইডেনের লিলসো নয়, বাংলাদেশের যে দুটি নদীর কাছে আমি ঋণী হয়ে আছি তার একটা হচ্ছে চিত্রা নদী। চিত্রা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নড়াইল ও গোপালগঞ্জের একটি নদী। নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত গঙ্গা-পদ্মার একটি বিশাল উপকূলীয় নদী। চিত্রা নদীটি চুয়াডাঙ্গা ও দর্শনার নিম্নস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নড়াইল, কালিগঞ্জ, মাগুরার শালিখা ও কালিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গাজীরহাটে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলেছে এবং এর মিলিত স্রোত খুলনার দৌলতপুরের কাছে ভৈরব নদে মিশেছে। চিত্রা নদীর পাড়ে আমার নানাবাড়ি। ফলে সেখানকার অনেক স্মৃতি রয়েছে মনে গাথা। তখনকার সময় চিত্রা নদী অত্যন্ত খরস্রোতা থাকলেও বর্তমানে কিছু প্রাকৃতিক কারণ, কালভার্ট নির্মাণ ও মূলত দখলদারির কারণে তা মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে।

আর অন্যটি হচ্ছে আমার প্রাণপ্রিয় নবগঙ্গা নদী। আমার মনে হয় শুধু ক্যামেরায় নয়, মনের মধ্যে যে বিবেক রয়েছে, সেখানেও নাড়া দেবে নবগঙ্গা নদীর এই করুণ অবস্থা দেখে। অথচ নাড়া দেয়নি সেখানকার প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের। মাথাভাঙা নদীর একটি শাখা, চুয়াডাঙ্গা শহরের কাছে এর উৎপত্তি। মাথাভাঙা থেকে নবগঙ্গা নামকরণ করে চুয়াডাঙ্গার পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে মাগুরার কুমার নদ, নড়াইলের চিত্রা নদীর জলধারাসহ এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব নদে পড়েছে।

আমার নানা ও দাদাবাড়ির পাশ দিয়ে নদী দুটি প্রবাহিত হয়েছে। আমার ছোটবেলার সঙ্গে আজ সেই চিত্রা ও নবগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়! কোথাও হারিয়েছে অস্তিত্ব, কোথাও সরু খালের মতো, আবার কোথাও মাঝনদীতে হাঁটুপানি, কিছু এলাকায় নদীর বুকে চাষাবাদও চলছে।

অবৈধ দখলদারেরা স্থাপনাও নির্মাণ করছেন। এতে নদীকেন্দ্রিক ইকোসিস্টেম ও আশপাশের পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। নদীর বুকে বাড়িঘর, মাছের ঘের নির্মাণসহ নানাভাবে যেন অবৈধ দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে দখলমুক্ত করে নদী খননের দাবি এলাকাবাসীর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সিএস জরিপ অনুসরণ করার কথা বলছেন জেলা প্রশাসকেরা। সেই বহু বছর ধরে শুধু আশ্বাস নয়, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে একসময়ের খরস্রোতা চিত্রা ও নবগঙ্গা নদীকে তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। নদী দুটি এখন খালে পরিণত হয়েছে বা বিলীন হওয়ার পথে, অথচ নদী মন্ত্রণালয় দিব্বি চাকরি করে যাচ্ছে যার যার জায়গা থেকে! দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মতো এককভাবে কোনো প্রচেষ্টা (মন্ত্রণালয়, কমিশন, অধিদপ্তর) নেই। মন্ত্রণালয় রয়েছে বটে, তবে সমন্বয়ের ভীষণ অভাব। যার যত বেশি ক্ষমতা, আনুপাতিক হারে সে তত বেশি সর্বনাশ করছে নদীগুলোর। ফলে মাঝেমধ্যে কেউ নদী সুরক্ষার তাগিদ দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন যে ফিরিয়ে দিতে হবে, সেটা কেউ এখনো বুঝতে চেষ্টা করছেন না।

নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। নদীর ব্যবহার বহুমাত্রিক, যখন যেভাবে যাঁর প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে তাঁরা ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট এই দেশের মধ্য দিয়ে ছোট-বড় ৭০০-এর মতো নদ-নদী বয়ে গেছে। মানুষের জীবন-জীবিকা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি—সবকিছুই নদীর ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। নদী আমাদের সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষা করে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর এসবের জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের ঐক্যের মধ্য দিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে। নদীভাঙন দেশবাসীর জন্য মহাসংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার নদী রক্ষার দায়ভার এড়াতে পারেন না। উপজেলা ও জেলায় ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও জেলা প্রশাসকের। এই দুই কর্মকর্তা উপজেলা ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। কেউ অবৈধভাবে নদী দখল, দূষণ, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করলে এ দুই কর্মকর্তার তা বন্ধ করার কথা। এমনকি নদী থেকে কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলেও তা বন্ধ করা তাঁদের দায়িত্ব। পাউবোর আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, কিন্তু তাদের সে সময় নেই। অনেক নদী খনন করা হচ্ছে, তবে খননের সময়ে কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখার প্রয়োজন কেউ মনে করছে না। আবার অনেক নদীকে খাল হিসেবেও খনন করা হচ্ছে, কিন্তু কেন, উত্তর নেই।

সিলেটের দীর্ঘতম নদী সুরমা। নগরের পাশ দিয়ে প্রবহমান এই নদী সিলেট নগরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। বর্ষায় সুরমার সৌন্দর্য মুগ্ধ করলেও শুকনো মৌসুমে দূষণে সৌন্দর্য হারায় এই নদী
ছবি: আনিস মাহমুদ

দেশে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে, তারা আবার সব নদীতে কাজ করে না। তাদের কাজও সামগ্রিকভাবে নদীবান্ধব নয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কোনো নদীর ওপর দিয়ে যখন সড়ক, তথা সেতু নির্মাণ করে, তখন নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট করে সেতু নির্মাণ করে। আর অবৈধ দখলদারেরা সেতুর মাপ ধরে নদীর প্রস্থ চিহ্নিত করেন। নদীর সর্বনাশকারীরা এভাবে নদীর সর্বনাশ করে চলছেন অথচ কোথাও কেউ নেই সেটা দেখার! প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের এত বড় সর্বনাশ হওয়ার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কেন? যদি কোনো সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সাবরেজিস্ট্রার, ইউএনও, জেলা প্রশাসক, প্রকৌশলী, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করা হয়, তবে দেশকে দেশের নদীকে রক্ষা করা যাবে না। আইনে ফাঁক রয়েছে, ক্ষমতায় দুর্নীতি রয়েছে।

দখল ও দূষণে ক্ষয়িষ্ণু বুড়িগঙ্গা নদী
ফাইল ছবি

ফলে সবাই এই অপরাধ করেই চলেছেন। নদীর স্বার্থ রক্ষায় মন্ত্রণালয়ের যথেষ্ট সচেতন হওয়ার কথা, কিন্তু কী করছে তারা? প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। নদী ভরাট ও অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করাও দরকার। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পাউবো নদী বাঁচাতে পারবে না। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবার জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের সব নদ-নদীই এখন দূষিত। দূষিত নদ-নদী পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কার্যকর কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে! বর্তমানে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা নদী দখল করছেন। স্থানীয় প্রশাসক, রাজনীতিক, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অনেক সময় জোটবদ্ধ হয়েও নদীর সর্বনাশ করছেন। বিশেষ করে কোথাও নদ-নদী উদ্ধারে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে দলমত-নির্বিশেষে অবৈধ দখল বজায় রাখার স্বার্থে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লুটপাট করছেন।

নদীর সর্বনাশকারীরা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের এত বড় সর্বনাশ করার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। সব মন্ত্রণালয়ের জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে যেভাবে কাজ করার কথা, দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরও সেটা তেমন চোখে পড়ছে না। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার পর দেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তোলার যে গুরুদায়িত্ব অনেকই পেয়েছেন, তা শুধু অবহেলা, অনাদর, অসম্মানের সঙ্গে হারিয়ে ফেলা হচ্ছে। জীবনে এ সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে কি না, জানি না। তবে এসেছিল জীবনে একবার, মনে রাখা দরকার।

সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন যদি থেকেই থাকে, তবে নদী সুরক্ষায় এমন অবহেলা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। নদী-প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে বাংলার মানুষ ভালো থাকতে পারে না, পারবে না। চরম বিপদে পড়ে একদিন সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তেমন একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে আসুন নদী রক্ষা করতে শুরু করি। আর দেরি নয়, আর দুর্নীতি নয়, এবার দেশের কথা ভাবুন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, বুড়িগঙ্গা, নবগঙ্গা ছাড়া সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টা যত বিলম্বে হবে, ততই সর্বনাশ হবে নদ-নদীর।

চিত্রা ও নবগঙ্গা তোমরা কি জানো, আমি যেখানে থাকি, সেখানে একটি লেক আছে। সেটা দেখতে তোমাদের মতো এবং আমি যখন গোসল করি, তখন তোমাদের কথা মনে হয়। তখন অপলকে তাকিয়ে তাকে দেখি আর তোমাদের কথা ভাবি। শৈশব-কৈশোরের কিছুটা বেলা তোমাদের সঙ্গে কেটেছে আমার। শান্ত-শীতল ছোঁয়ায় ক্লান্তি কমিয়েছি আমি তোমাদের মধ্যে, আমার অনেক ঋণ আছে তোমাদের কাছে।
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন

আরও পড়ুন