বিদেশে যেভাবে মাংস বিক্রি হয়
বাংলাদেশের মাংসের দাম নিয়ে সম্প্রতি একটা পোস্ট দেখলাম, যথেষ্ট যৌক্তিক লেগেছে। যদিও দেশে থাকি না বলে যাচাইয়ের উপায় নেই। পোস্টের মূল বিষয় হচ্ছে, দেশের খামারিদের সাহায্য করতে সরকার ভারত, থাইল্যান্ড বা বিদেশ থেকে গরু আমদানি বন্ধ করেছিল। প্রচার করা হয়েছিল, গরু-ছাগলে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রচুর ভিডিও দেখলাম যে প্রচুর যুবক, মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেছেন। সরকার আমেরিকা থেকে ব্রাহমার বীজ নিয়ে গেল, দেশি গরুর সঙ্গে সংকর করে ঘোষণা দিল, দেশের মাংসের চাহিদা শুধু পূরণই হবে না, সারপ্লাস থাকবে।
কিন্তু বাজারের রিপোর্ট দেখাল, মাংসের কেজি দুই শর ঘর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে আট শ টাকায় চলে গেল।
কোথায় গেলেন এত এত দেশি খামারি? কোথায় তাঁদের উন্নত জাতের গরু? এত দাম কেন? অনেকেই অতিরিক্ত দামের কারণে গরু কোরবানি দিতে পারেননি।
ব্যবসায়ী বলেন, সিন্ডিকেট বলেন, চাঁদাবাজ বলেন—দোষ যার ওপরই চাপান, মরেছে আমাদের সাধারণ মানুষ। ভারতে এখনো মাংসের কেজির দর স্থিতিশীল। তাহলে দেশি ভাইয়েরা এভাবে পিঠে ছুরি চালালে ভারত থেকে গরু আমদানিই ভালো। আমার তো কোরবানি দেওয়া নিয়ে কাজ। গরু ভারত থেকে এল, নাকি আফগানিস্তান থেকে—কি আসে যায়?
গরুর খামারিরা বলেন, গরু বিক্রি করে লাভ হয় না। কারণ ফিডের দাম অনেক বেশি।
কি ফিড দেন?
ভুট্টা।
ভুট্টার ফিড দিতে হবে কেন?
আমেরিকান গরু। ব্রাহমা, এঙ্গাস ইত্যাদি ভুট্টার ফিড খায়।
তা বাংলাদেশে থেকে আমেরিকান গরু পালনের সুবুদ্ধি কোন চাচা চৌধুরীর মাথা থেকে এল? আমেরিকায় কর্ন ফিড হচ্ছে বাইপ্রোডাক্ট। এ দেশে কর্ন হয়, মানুষ খায়। বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে যা থাকে, সেটা গরু খায়। বাংলাদেশের গরুর খাওয়া উচিত আমাদের খাবারের বাইপ্রোডাক্ট। যে গরু সেটা খায় না, সেই গরু পালনের কোনোই মানে হয় না। একজন ব্যবসায়ীকে সব সময়ে দেখতে হবে, সে কীভাবে খরচ কমাতে পারবে। তাহলে সে প্রোডাক্টের দামও রিজনেবল রাখতে পারবে। যেমন আমি যত দূর জানি, বাংলাদেশের জন্য অন্যতম সেরা গরু হচ্ছে ফ্রিজিয়ান জাতের। দুধ, মাংস সবই বেশি দেয়। খায়ও দেশি গরুর মতোই। সমস্যা হয়েছে এই, সবাই হুজুগের ঠ্যালায় কোরবানি টার্গেট করে বড় জাতের গরু লালন-পালন করেছে। সেই সাইজের বড় গরুর ক্রেতা সমাজের অতি কম পার্সেন্টেজের লোক। তাঁরা তাঁদের মতো গরু কিনে কোরবানি দিয়ে ফেলেছেন। মাঝে যে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাঁরা ছোট বা মাঝারি গরু দেন, তাঁদের কেউ টার্গেট করল না। কাজেই সবাই ধরা খেল একসঙ্গে। অথচ বুদ্ধিমান হলে লোকে তাঁদেরই বেশি টার্গেট করতেন। কাস্টমারের অভাব নেই—ভালো প্রোডাক্ট দিতে পারলে কামড়াকামড়ি করে নিয়ে যেতেন।
দেশের বাজারে আরেকটা বিরাট সমস্যা হচ্ছে, ঢালাওভাবে গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা। কোনো জাত-পাতের বালাই নেই, গরুর ক্ষেত্রে আমরা গাহি সাম্যের গান! অথচ একেক জাতের গরুর মাংসের স্বাদ আলাদা। গরু পালনে খরচও আলাদা। ব্রাহমার মাংস আমাদের দেশি রান্নায় দারুণ টেস্টি হয়। কারণ চর্বি থাকে। এঙ্গাসে কিন্তু সেই স্বাদ পাই না। চর্বি কম। এঙ্গাসের মাংস দিয়ে গ্রিল, বারবিকিউ, স্মোক করলে বেস্ট হয়। এঙ্গাসের বার্গার, ব্রিসকেট, স্টেক তুলনাহীন। দেশি গরুর মাংস দিয়ে স্টেক বানালে সেই স্বাদ না-ও আসতে পারে। চর্বির যে মার্বেলিং, সেটাই মূল।
আমেরিকায় যেমন ঘাস খাওয়া গরুর মাংসের দাম সবচেয়ে বেশি। অর্গানিক ফুড খেয়ে বড় হয়, ওটার স্বাদ ফার্মের গরুর চেয়ে বেশি। বিফের জন্য প্রাইমগ্রেডের কোয়ালিটির দাম সবচেয়ে বেশি। তারপর বিভিন্ন পার্টসেরও দাম ভিন্ন। প্লেন মাংসের এক দাম, হাড্ডিসহ মিক্সড মাংসের দাম আরেক, সিনার মাংসের দাম আলাদা, রানের দাম আলাদা। আপনি হয়তো দেখবেন অমুক দোকানে প্রতি পাউন্ড মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫ ডলারে, আবার পাশের দোকানেই মাংসের পাউন্ডের দাম ১০ ডলার। একই দোকানে আরেক ট্রেতে বিক্রি হচ্ছে ২৫ ডলার পাউন্ডের মাংস। ভাবতেই পারেন ডাকাতি করছে। কিন্তু ওই যে বললাম, মাংসের জাত, কোয়ালিটির ওপর দাম নির্ভর করে। এর ফলে যে যার আর্থিক সংগতি অনুযায়ী মাংস খেতে পারেন।
একটি প্রাইমগ্রেডের স্টেক কিনতে গেলে আপনার ৪০ থেকে ৫০ ডলার খরচ হতে পারে। জাপানিজ ওয়েগুর স্টেকের দাম এক থেকে দুই শ ডলার, তা-ও আপনাকে বাসায় এনে রান্না করতে হবে। সাধারণ স্টেক হয়তো সাত থেকে আট ডলারেই পেয়ে যাবেন। এখন আপনি সাত ডলারের স্টেক এনে বানাতেই পারেন, সমস্যা নেই। শক্ত রবারের মতো লাগলে আপনি গালাগাল দিয়ে বলবেন, ‘এই জিনিস মানুষ খায়?’
ঠিক এ কারণেই ওই সব স্টেকের দাম বেশি। মুখে দিলে মাখনের মতো গলে যাবে।
আমাদের দেশে দাম এক হওয়ায় গিট্টু পাকিয়ে যায়। আমাকে যদি ব্রাহমা-এঙ্গাস বেচতে হয় ৮০০ টাকা কেজি দরে এবং সাধারণ গরুও বেচতে হয় ৮০০ দরে, তাহলে কোথাও ক্রেতা ঠকবেন তো কোথাও ব্যবসায়ী। কোনো কসাইই বেশি দাম দিয়ে উন্নত জাতের গরু এনে নিজে কম লাভ রাখবেন না। তাই ‘ব্রাহমার মাধ্যমে দেশের মাংসের অভাব দূর হয়ে যাবে, উল্টো সারপ্লাস থাকবে’—প্ল্যানটা মার খেয়ে যায়।
আমার মতে, যে গরু লালন-পালনে কম খরচ হয়, সেটার কেজি ২০০-এর ঘরে রাখলে সমস্যা কি? লাভ নাহয় একটু কম করলাম, কিন্তু আমার প্রোডাক্ট তো বিক্রি হবে। কোনো ব্যবসায়ীই চান না তাঁর প্রোডাক্ট ইনভেন্টরিতে পড়ে থাকুক। যার ব্রাহমা-এঙ্গাস খাওয়ার শখ হবে, সে কিনুক দাম দিয়ে। যার সামর্থ্য নেই, সে সাধারণ মাংস কিনুক। এর ফলে দেশের গরিব মানুষও নিয়মিতই মাংস খেতে পারবেন।
উপসংহারে এসে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে, তা হচ্ছে—
১. ব্যবসায়ীদের সততা, এঙ্গাস/ব্রাহমার নাম দিয়ে অন্য জাতের মাংস দেবে না।
২. কর্তৃপক্ষের নজরদারি। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিতই তদারক করবেন পণ্যের মান, দাম ইত্যাদি সঠিক নিয়ম মেনে চলছে কি না।
৩. আইনের প্রয়োগ। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাঁকে যেন বিচারের আওতায় আনা হয়।
একটি সুন্দর সুষ্ঠু সমাজ গঠনে যেমন সব শ্রেণির মানুষেরই ভূমিকা রাখতে হয়, বাজার নিয়ন্ত্রণেও তা-ই।