সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা: মানবিকতার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন
সুইডেন এমন একটি দেশ, যেখানে গণতন্ত্র কাগজে–কলমে নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হয়। রাষ্ট্রের অবকাঠামো মানুষের মৌলিক অধিকারকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত। বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা, বাক্স্বাধীনতা এবং নাগরিক মর্যাদা সবকিছুই মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে উঠেছে।
এই কারণে সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা কেবল কোনো খাত নয়, এটি একটি মানবিক প্রতিশ্রুতি। এখানে চিকিৎসা মানে শুধু অসুস্থতা সারানো নয়; এটি রোগীর নিরাপত্তা, আরাম, সম্মান, স্বচ্ছতা এবং আর্থিক নিশ্চয়তার সমন্বিত অভিজ্ঞতা। একজন মানুষ প্রথমবার চিকিৎসা নিতে গেলে যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন, সেখান থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি, পুনর্বাসন এবং বাড়িতে ফেরার পরবর্তী সহায়তা—সবকিছুই সুসমন্বিতভাবে আয়োজন করা থাকে।
এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে সমাজের প্রত্যেক মানুষ বয়স, পেশা, আয়, সামাজিক অবস্থান বা পরিচয় নির্বিশেষে সমান সেবা পায়। চিকিৎসা কখনো আর্থিক বোঝা হয় না, সিদ্ধান্ত কখনো অস্পষ্ট থাকে না, আর রোগী কখনো অবহেলার অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরে না।
কেউ অসুস্থ হলে প্রথমেই যায় প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। এটি বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো হলেও সুইডেনের ক্ষেত্রে আরও উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং সহজপ্রাপ্য। চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে সাধারণত ২০০ থেকে ২৭৫ ক্রোনা খরচ হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা।
আমি সুইডেনের এই পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো তুলে ধরছি শুধু তুলনার জন্য নয়; এটি একটি প্রয়োজনীয় আহ্বান। যাতে বাংলাদেশও চাইলে একদিন এমনই মানবিক, স্বচ্ছ, পরিকল্পিত এবং জনগণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যব্যবস্থা নির্মাণ করতে পারে। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা কোনো দেশের প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের পরিমাপ নয়; এটি সেই দেশের নাগরিককে কতটা মর্যাদা দেওয়া হয়, তার সবচেয়ে সৎ প্রতিফলন।
সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা বিশ্বমানের হওয়ার কারণ
নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা, সম্মান এবং আর্থিক সুরক্ষা একসঙ্গে নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সক্ষমতার পরীক্ষা। সুইডেন বহু বছর ধরে সেই পরীক্ষায় উজ্জ্বলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। এখানে চিকিৎসা মানে শুধু রোগ সারানো নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা, যেখানে পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা, মানবিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা একসঙ্গে কাজ করে। একজন মানুষ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা যাত্রা শুরু হয় প্রাথমিক পর্যায় থেকে এবং ধাপে ধাপে এমনভাবে এগোয়, যাতে কখনো মনে না হয় যে সে অবহেলিত বা বিপদের মুখে একা।
কেউ অসুস্থ হলে প্রথমেই যায় প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে। এটি বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো হলেও সুইডেনের ক্ষেত্রে আরও উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং সহজপ্রাপ্য। চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে সাধারণত ২০০ থেকে ২৭৫ ক্রোনা খরচ হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। শিশু ও কিশোরদের চিকিৎসা প্রায় সব সময় বিনা মূল্যে এবং ৮৫ বছরের ওপরের প্রবীণদের অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ফি দিতে হয় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ফি ২০০ থেকে ৪৬০ ক্রোনা, জরুরি বিভাগে খরচ কিছুটা বেশি হয়ে ৬০০ থেকে ৬২০ ক্রোনার মধ্যে থাকে। ভিডিও কলের মাধ্যমে চিকিৎসা তুলনামূলক কম খরচে পাওয়া যায়, এবং নির্ধারিত সময় বাতিল না করলে অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয়। চিকিৎসক রোগীকে দেখে সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসা ঘরে চলবে কি না বা হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন কি না। কোনো অবস্থাতেই জটিলতা তৈরি না হওয়ার বিষয়টি এই পর্যায়ের মূল লক্ষ্য।
হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন হলে রোগীকে নিবিড় চিকিৎসার পরবর্তী ধাপে নেওয়া হয়। সুইডেনে হাসপাতালে প্রতিদিনের খরচ মাত্র ১৩০ ক্রোনা, যা বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক ১ হাজার ৩০০ টাকা। এই খরচে রোগী পান চিকিৎসা, নার্সিং সেবা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধ, পরিষ্কার এবং নিরাপদ আবাস, পুনর্বাসন সেবা এবং তিন বেলা মানসম্মত খাবার। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় এই খরচ অত্যন্ত কম এবং এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের গভীর দায়িত্বশীলতা।
সুইডেনে নকল বা ভেজাল ওষুধের কোনো সুযোগ নেই। সব ওষুধ সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বছরে নির্দিষ্ট সীমার বেশি ওষুধ কিনলে অতিরিক্ত খরচ সরকারই বহন করে। শিশুদের চিকিৎসা সাধারণত সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এবং ৮৫ বছরের বেশি বয়সীরা প্রায় সব সময় বিনা মূল্যে সেবা পান। এক বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চিকিৎসা ফি দিলে রোগী একটি ফ্রি কার্ড পান, যার মাধ্যমে পুরো বছর আর কোনো ওপেন চিকিৎসা ফি দিতে হয় না। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে কেউ অর্থের অভাবে চিকিৎসার বাইরে না পড়ে।
হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় রোগী যে মানবিক যত্ন পান, তা সুইডেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও আলাদা করে চেনায়। প্রতিদিনের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনার এমনভাবে পরিকল্পিত হয়, যাতে রোগীর শরীর পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এবং পুষ্টি নিশ্চিত হয়। খাবারকে চিকিৎসার একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং রোগীর বিশেষ প্রয়োজন সব সময় গুরুত্ব পায়। প্রতিটি খাবার এমনভাবে তৈরি হয়, যাতে তা রোগীর শক্তি ধরে রাখে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এবং দ্রুত সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
এভাবেই সুইডেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একজন মানুষের অসুস্থতার প্রথম মুহূর্ত থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পাশে থাকে। স্বচ্ছতা, মানবিকতা এবং দায়িত্বশীলতার এই সমন্বয়ই সুইডেনকে এমন একটি দেশে পরিণত করেছে, যেখানে চিকিৎসা মানে কেবল রোগ সারানো নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানানো।
রোগীরা নিজেদের কখনো অবহেলিত মনে করেন না। তাঁরা বুঝতে পারেন যে তাঁদের সার্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স, ডায়েটিশিয়ান এবং পুরো হাসপাতাল টিম একসঙ্গে কাজ করছে। খাবার পরিবেশনে যত্ন রয়েছে, সময়নিষ্ঠা রয়েছে, আর রোগীর সম্মান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল হলে চিকিৎসক ছাড়পত্র দেন এবং এরপর শুরু হয় বাড়িতে পুনর্বাসনের পরবর্তী ধাপ। এই পর্যায়ে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা যেন আরামদায়ক এবং নিশ্চিন্ত হয়, তার জন্য রাষ্ট্র বাড়িতেই প্রয়োজনীয় সেবা পৌঁছে দেয়। ফিজিওথেরাপিস্ট বাড়িতে গিয়ে ব্যায়াম করান, নার্স নিয়মিত এসে ক্ষত পরীক্ষা করেন, ওষুধ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখেন এবং প্রয়োজন অনুসারে ফলোআপ নিশ্চিত করেন। কোনো আর্থিক চাপ রোগীর ওপর পড়ে না। ফলে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর চিকিৎসা বা সেবার মান একটুও কমে না। রোগী নিজের পরিচিত পরিবেশে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সুইডেনের মতো মানবিক স্বাস্থ্যসেবা নর্ডিক অঞ্চলের আরও কয়েকটি দেশে পাওয়া যায়। নরওয়েতে ভর্তি চিকিৎসার খরচ অত্যন্ত কম এবং অধিকাংশ ব্যয় রাষ্ট্র বহন করে। ডেনমার্কে চিকিৎসা এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকাও সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। ফিনল্যান্ডে হাসপাতাল ফি খুব কম এবং খাবার সাধারণত সেবার মধ্যেই থাকে। আইসল্যান্ডে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত উন্নত এবং ভর্তি চিকিৎসা প্রায় সব সময় বিনা মূল্যে। যুক্তরাজ্যের এনএইচএস পুরোপুরি বিনা মূল্যে চিকিৎসা এবং ভর্তি সেবা দেয়, তবে খাবারের মান সুইডেনের মতো উন্নত নয়। জাপানে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী হলেও দিনে কিছু খরচ থাকে এবং খাবার নির্ধারিত রেটে কিনতে হয়। জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হলেও সুইডেনের মতো কম খরচ নয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খাবার আলাদাভাবে কিনতে হয়।
সুইডেন এই সাফল্য অর্জন করেছে একাধিক যুক্তিসংগত কারণে। দেশের জনগণ নিয়মিতভাবে ট্যাক্স দেয় এবং সেই ট্যাক্স যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। নকল বা ভেজাল ওষুধ নেই। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা হয় না। চিকিৎসক এবং রাষ্ট্র উভয়ই তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে দেশে ট্যাক্স সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনিয়ম নেই এবং মানুষের জীবনের মূল্য রাষ্ট্রীয় নীতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়, সেই দেশই মানবিক এবং ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং পুরো নর্ডিক অঞ্চল সেই অভূতপূর্ব উদাহরণ হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত।
সুইডেন আমাদের দেখায় যে একটি মানবিক রাষ্ট্র কেমনভাবে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে। এখানে চিকিৎসা মানে শুধু ওষুধ বা প্রযুক্তি নয়; বরং মানুষের প্রতি সম্মান, স্বচ্ছতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের স্বাভাবিক প্রকাশ। বাংলাদেশও চাইলে পরিকল্পনা, ন্যায়বোধ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমন একটি পথ তৈরি করতে পারে, যেখানে প্রত্যেক মানুষ অনুভব করবে যে রাষ্ট্র তার পাশে আছে। স্বাস্থ্যসেবা তখন আর হাসপাতালের চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত থাকবে না, বরং মানুষের মর্যাদা রক্ষা করার জাতীয় প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হবে।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]