স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং নিয়তির এক অনন্য যাত্রা

উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার

ইংল্যান্ডের শান্ত ছোট্ট শহর স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভনের তীরে জন্ম হয় এক সাধারণ পরিবারের শিশু, উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের। জন্মের সময় কেউ ভাবতে পারেনি, এই ছেলেটি একদিন পৃথিবীর অন্যতম মহান নাট্যকার হয়ে উঠবে। তার গল্প শুধুই সাফল্যের নয়; এটি স্বপ্ন দেখার, হার না মানার এবং বাস্তবতার মধ্যেও নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার গল্প।

শৈশব ও কৈশোরের ধাক্কা

শেক্‌সপিয়ারের বাবা ছিলেন গ্লাভস নির্মাতা, মা একজন পরিশ্রমী কৃষক পরিবার থেকে। বাড়িতে বই কম ছিল, গল্পের অভাব ছিল না। ছোট উইলিয়াম মানুষের কথা শোনা, বাজারে যাওয়া, প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার মাধ্যমে ভাষার সৌন্দর্য শেখা শুরু করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। স্কুল ছাড়তে হয়, ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হতো। অনেকেই বলেছিল সে বড় কিছু করতে পারবে না। তবু তার হৃদয়ে জন্ম নিয়েছিল একটি স্বপ্ন। সে জীবনে হার মানতে চায়নি।

তরুণ উইলিয়ামের পথচলা

কিশোর বয়সেই নাটক ও অভিনয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়। ছোট শহরে বড় স্বপ্নের জগৎ না থাকায় সে চুপচাপ লন্ডনে চলে আসে। লন্ডন তখন ছিল এক জীবন্ত শহর, নাট্যশালা, কবি, রাজনীতি, অভিনয়শিল্পী—সব মিলিয়ে মাথা ঘোরানো পরিবেশ। শুরুতে কাজ পেয়েছিল সাধারণভাবে, কেউ বলে ঘোড়ার দেখাশোনা, কেউ বলে মঞ্চ সাজানো। কিন্তু তার মন ছিল লেখার প্রতি।

মঞ্চের পেছনে কাজ করতে করতে শিখতে থাকেন

মানুষের হাসি, কান্না, আবেগ, বিশ্বাসঘাতকতা, মানবস্বভাবের অন্ধকার কোণ এবং ভালোবাসার আলো। এই অভিজ্ঞতা দ্রুত তাঁর লেখা নাটকে প্রতিফলিত হয়।

শেক্‌সপিয়ারের খ্যাতি ও প্রভাব

লন্ডনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক নাটক লিখতে শুরু করেন—রোমিও এবং জুলিয়েট, হ্যামলেট, ওথেলো, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার। এই নাটকগুলো মানুষের হৃদয় ভেঙে দেয় এবং আবার গড়ে তোলে। যে মানুষটি একসময় পরিবারের চাপের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই মানুষটিই ইংরেজি সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ভ্রমণের স্মৃতি: অতীত থেকে বর্তমান

প্রায় ৪৫৯ বছর আগে শেক্‌সপিয়ারের জন্মগ্রাম স্ট্র্যাটফোর্ডে পা রেখে ভাবতে হয়, এক সাধারণ মানবজীবনের শক্তি কতটা বিশাল হতে পারে। গ্রামের শান্ত নদী, প্রাচীন গৃহ ও চারপাশের সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে আজও জীবন্তভাবে মনে করায়, যে মানুষটি নিজের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন এখনো কোটি মানুষের মনে আলো জ্বালায়।

আর তিন বছর আগে, ২০২৩ সালের বিলেতভ্রমণে যখন আমি লন্ডন ও স্ট্র্যাটফোর্ডের পথ বেছে চলেছি, মনে হলো সেই অতীতের শক্তি আর আমার অভিজ্ঞতার আনন্দ এক হয়ে উঠেছে। লন্ডনের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম, দুর্ঘটনা, প্লেন মিস হওয়া, সবই আমাকে স্মরণ করাল জীবনের অপ্রত্যাশিত বাঁকগুলোকে কীভাবে সহ্য করতে হয়। থিয়েটারে মিউজিক্যাল শো ‘মুলা রুস’ দেখে মনে হলো, প্রাচীন অভিজ্ঞতা আর বর্তমান জীবনের আনন্দ একই ছন্দে মিলিত হতে পারে।

স্ট্র্যাটফোর্ডে পৌঁছে অনুভব করলাম, প্রায় পাঁচ শ বছর আগে এক মহামানব এখানে জন্মেছিলেন। তিনি মরেছেন, কিন্তু তাঁর সাহিত্য আজও জীবন্ত। প্রতিদিন হাজারো মানুষ বিশ্বজুড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি দেখেন। সেই একই অনুভূতি আজ আমার হৃদয়েও জাগ্রত হয়েছে, কীভাবে একজন মানুষের স্বপ্ন ও শ্রম পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে।

উপসংহার ও অনুপ্রেরণা

শেক্‌সপিয়ারের জীবন ও আমার ভ্রমণ উভয়ই শেখায়: স্বপ্ন যদি সত্য হয়, জন্ম, দারিদ্র্য বা বাধা কিছুই থামাতে পারে না। পরিশ্রম, ধৈর্য ও প্রতিভার বিশ্বাস মানুষকে বিশাল উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে। জীবনের ছোটখাটো ঘটনা, আনন্দ ও দুঃখ, সবই মানুষের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। যেমন শেক্‌সপিয়ারের শব্দ মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালায়, তেমনি আমাদের নিজস্ব ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতা নতুন আশা এবং অনুপ্রেরণার আলো হয়ে উঠতে পারে। অতীত ও বর্তমান মিলিয়ে, মানুষের জীবন সর্বদা সম্ভাবনাময়, প্রাণবন্ত এবং স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য উন্মুক্ত।

এ লেখা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং ধৈর্য—এই তিনটি শক্তিই মানুষকে অপ্রত্যাশিত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। এই তিনটির ওপর ভিত্তি করেই আমরা সততা, নিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প তৈরি করতে পারি। কারণগুলো এতটাই স্পষ্ট যে চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে:

১. স্বপ্নের শক্তি

শেক্‌সপিয়ারের মতো সাধারণ মানুষের স্বপ্নও পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। আমরা যদি প্রত্যেক বাংলাদেশির মধ্যে স্বপ্ন দেখার মানসিকতা জাগ্রত করি, চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা বা সমাজসেবায়, তবে আমাদের দেশও নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে। স্বপ্ন দেখা মানেই শুধু আশা নয়, এটি এক নতুন যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।

২. সংগ্রাম ও ধৈর্য

শেক্‌সপিয়ারের জীবন দেখিয়েছে, বাধা যতই বড় হোক, ধৈর্য এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে জয় সম্ভব। বাংলাদেশের নাগরিকেরা যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের সুযোগ এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামে উৎসাহিত হয়, তাহলে ধীরে ধীরে দুর্নীতি ও অবহেলা কমে আসবে। সংগ্রামের মধ্যেও যখন আমরা ধৈর্য ধারণ করি, তখন দেশের মাটিতে সততার চিরন্তন বীজ বপন হয়।

৩. অতীত থেকে শিক্ষা

আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যেমন অতীত ও বর্তমানকে একত্রিত করেছে, তেমনি বাংলাদেশিরাও অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন নৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে। সমাজে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করলেই একটি শক্তিশালী ও দায়বদ্ধ জাতি গড়া সম্ভব।

৪. আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অনুপ্রেরণা

বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ আমাদের দেখায়, সততা, নিষ্ঠা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে উন্নতি করা যায়। এই অনুপ্রেরণাকে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে, আমরা একটি শক্তিশালী দেশীয় রূপকল্প তৈরি করতে পারি, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের কণ্ঠ স্বাধীন, প্রতিটি পদক্ষেপ ন্যায়বিচারিক।

৫. সংলাপ ও প্রকাশের শক্তি

শেক্‌সপিয়ারের শব্দের শক্তি প্রমাণ করেছে, সাহিত্য ও শিক্ষা মানুষকে ভাবতে শেখায়, সচেতন করে তোলে। বাংলাদেশে আমরা জনসচেতনতা, পাঠ্যক্রম, গণমাধ্যম এবং স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে এই শক্তিকে ব্যবহার করে দুর্নীতি কমাতে এবং নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে পারি। শব্দের প্রতিটি সঠিক প্রয়োগ নতুন আশার আলো জ্বালাতে সক্ষম।

এভাবেই আমরা শেক্‌সপিয়ারের অনুপ্রেরণা থেকে শুরু করে আমাদের নিজেদের সংগ্রাম ও স্বপ্নের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, একটি নিষ্ঠাবান, সততাপূর্ণ এবং দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারি। এটি কেবল একটি স্বপ্ন নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এটি বাস্তবও হতে পারে।

  • লেখক: রহমান মৃধা, লেখক, সুইডেন