বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া ও চীনের উত্থান-২

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ
ফাইল ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের ওপরও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর নির্ভরশীলতার হার অনেক। ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয়। সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ইউক্রেন শীর্ষে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন ওডেসা বন্দর ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে দেশটি তার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বা অন্যান্য পণ্য বাইরের দেশগুলোতে রপ্তানি করতে পারছে না। ইউরোপের বাজারে এখন আগুন, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম এ মুহূর্তে অত্যন্ত চড়া। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ এখন যে পর্যায়ে আছে তাতে মনে হচ্ছে, পুতিন এখন চাইছেন এ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করতে। অন্তত তিনি এ যুদ্ধকে শীতকাল পর্যন্ত টেনে নিতে বদ্ধপরিকর। শীতকালে স্বাভাবিকভাবে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যায়।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো রাতারাতি গ্যাস ও খনিজ তেলের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে, সেটি ভাবার কোনো উপায় নেই। যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিকল্প কোনো উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে চায়, তাহলে তাদের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। রাশিয়া থেকে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে গ্যাস আসে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে গ্যাস আনতে হলে সাগরপথে জাহাজের মাধ্যমে গ্যাস আমদানি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যাস পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি সময়ের প্রয়োজন। হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়ার মতো যেসব দেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই, ওই সব দেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সহজে গ্যাস সংগ্রহ করতে পারবে না।

মোটামুটিভাবে অক্টোবর থেকে ইউরোপে শীত পড়তে আরম্ভ করে। শীতের দিন ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মানুষ ঘর গরম রাখতে হিটার ব্যবহার করেন। হিটার চালাতে গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কোনো কারণে যদি রাশিয়া শীতকালে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ঘর গরম রাখতে না পারার দরুন হাইপোথার্মিয়ার প্রভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক মানুষের মৃত্যু হবে। তাই পশ্চিমা দেশগুলো এ যুদ্ধে যদি রাশিয়াকে পরাজিত করতে চায়, তাহলে আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রুশ সেনাদের ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর কী আদতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করার মতো প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি আছে? রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র এবং শক্তিমত্তার দিক থেকে রাশিয়া গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের চেয়েও অনেক ওপরে। কেবল যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে হয়তো রাশিয়াকে পরাজিত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি পারমাণবিক বোমার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আছে, রাশিয়ার সঙ্গে এ মুহূর্তে চীনের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। সি চিন পিং কয়েক দিন আগে ব্রিকসের সম্মেলনে সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, পশ্চিমা জোটকে প্রতিহত করতে তাঁর সরকার সব সময় রাশিয়ার পাশে থাকবে। তাই রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হলে চীন নিজের স্বার্থে সামরিক শক্তি নিয়ে রাশিয়ার পক্ষে এগিয়ে আসবে। তা ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পর দেশটির বেশির ভাগ মানুষ যাঁকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন করতেন, তিনি হলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জেরে তাঁকে কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাবেন।

যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ তিন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, থেরেসা মে ও ডেভিড ক্যামেরনের কেউই পূর্ণ মেয়াদে তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবা হচ্ছে, কিন্তু ঋষি সুনাক ইতিমধ্যে বিতর্কিত। লকডাউনের মধ্যে আইন ভেঙে পার্টিতে অংশ নেওয়ায় বরিস জনসনের মতো তাঁকেও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা তাঁর পলিসি থেকে কতটা লাভবান হবেন, সে নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেকে তাঁকে ইতিমধ্যে ধনী লোকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করেছেন। কাজেই ঋষি সুনাক কতটা সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন, সে প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে এমানুয়েল মাখোঁ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিকল্প কোনো অপশন না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে মেরি লোপেনের মতো একজন কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিহত করতে ফ্রান্সের বেশির ভাগ নাগরিক তাঁকে ভোট দিয়েছেন। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে এমানুয়েল মাখোঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।

জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বামপন্থী রাজনীতিবিদ। যাঁরা বামপন্থী রাজনীতিবিদ, তাঁদের মাঝে কিছুটা হলেও কমিউনিজমের প্রতি দুর্বলতা থাকে। রাশিয়াতে যদিও এ মুহূর্তে কমিউনিজমভিত্তিক শাসনব্যবস্থা নেই, তবে বলশেভিজমের আড়ালে একসময় গোটা বিশ্বে তাঁরা কমিউনিজমের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ ছাড়া জার্মানিতে বর্তমান সময়ে যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, সেটি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোটের সরকার। এ ধরনের সরকার যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তখন তাকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। ইসরায়েল যদিও পশ্চিমা কোনো দেশ নয়, তারপরও পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি উভয় ক্ষেত্রে এ দেশটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলও বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে এ মুহূর্তে জটিল সময় পার করছে। দেশটিতে এ মুহূর্তে কোনো সংগঠিত সরকার নেই, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইসরায়েলের শাসনকার্য পরিচালনা করছে। তাই এ সরকারের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন। পশ্চিমা জোটের নেতা হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে স্বস্তিতে নেই। যদিও এ মুহূর্তে ইউরোর চেয়ে ইউএস ডলার শক্তিশালী, কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিভিন্ন কারণে নিজ দেশের নাগরিকদের কাছে সমালোচিত হচ্ছেন। ডেমোক্র্যাটদের একাংশ ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন যে আগামী নির্বাচনে জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন সেটি তাঁরা চান না। করোনা–পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কারে তিনি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। গর্ভপাতকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টের রায়ও দেশটির অসংখ্য নাগরিককে হতাশ করছে। রাশিয়ার ওপর স্যাংশন আরোপের সিদ্ধান্তকেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবে নেননি।

অপর পক্ষে যুদ্ধের মধ্যেও পুতিন নিজ দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ইউএস ডলারের বিপক্ষে রুবলকে শক্তিশালী করেছেন। রাশিয়াকে অভ্যন্তরীণভাবে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছেন। চীনের ওপর বিশ্বের সব দেশ নির্ভরশীল। যেকোনো ইলেকট্রনিক জিনিসের নিচে লেখা থাকে ‘মেড ইন চায়না’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের থেকে ঋণ নিয়েছে। কোভিড-১৯ চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও চীন বেশ এগিয়ে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও উন্নত মানের গবেষণার জন্যও চীনের নাম আলাদাভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। চীনের সাধারণ মানুষের কাছে সি চিন পিং জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো একক আধিপত্য হারাচ্ছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে চীন ও রাশিয়াকে এখনো অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা ইসরায়েলের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স যেমন শক্তিশালী, চীন ও রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এখনো ওই পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার পরিবর্তনের পেছনে সিআইএ, এমআইসিক্স বা মোসাদের নাম শোনা যায়। চীন ও রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাকে ঘিরে এখনো এ ধরনের উল্লেখযোগ্য কিছু জানা যায়নি। রাশিয়া ও চীন যদি তাদের এ উত্থানকে ধরে রাখতে চায়, তাহলে তাদের পুতিন ও সি চিন পিংয়ের যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করতে হবে, যিনি জিওপলিটিক্যাল ইস্যুতে অসামান্য মুনশিয়ানা দেখাতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ কানাডা কিংবা মেক্সিকোর তেমন কোনো বিরোধ নেই। কানাডা ও মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। চীন ও রাশিয়াকেও তাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সব ধরনের বিবাদ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া ইউএস ডলারের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের জন্য নতুন কোনো কারেন্সি ব্যবহার করার প্রতি জোর দিচ্ছে। সুইফটের বিকল্প ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক তৈরির জন্যও এ দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। পুতিন আরও একটি কারণে এ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইছেন। যুদ্ধের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ইউরোপের দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। তখন এসব দেশের সরকার ইউক্রেনকে সাহায্য করার পরিবর্তে নিজের দেশের অর্থনীতিকে সাজাতে বেশি সচেষ্ট হবে। ইউক্রেন ইস্যু তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেন ইউরোপে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিদিন যুদ্ধ পরিচালনা করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে এককভাবে এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। সামরিক দিক থেকেও ইউক্রেন রাশিয়ার তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে। এ কারণে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে পুতিনের সঙ্গে আপসের পরামর্শ দিয়েছেন। জেলেনস্কি পুতিনের সঙ্গে সমঝোতায় বসবেন কি না, সেটা দেখার বিষয়। ইউক্রেনে যাঁরা নিজেদের ডানপন্থী ও জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচয় দেন, তাঁদের মাঝে রাশিয়াকে ঘিরে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ইউক্রেনের সর্বশেষ দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে তাঁরা ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা জেলেনস্কিকে কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন, সেটা দেখার বিষয়।

যুদ্ধ কখনো মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। ইউক্রেন ও রাশিয়া এ দুই দেশের মানুষ জাতিগতভাবে স্লাভিক হিসেবে পরিচিত। এ দুই দেশের ভাষার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। উভয় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটি। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এ দুই দেশের মাঝে তেমন একটা ফারাক নেই। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া কিংবা এস্তোনিয়াকে একসময় রাশিয়ার উপনিবেশ বলা হলেও ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক কখনো উপনিবেশের মতো ছিল না। সোভিয়েত শাসনামলে ইউক্রেন ছিল অর্থনৈতিকভাবে এ পৃথিবীতে প্রাচুর্যশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি। এ কারণে ইউক্রেনের অনেক সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা সোভিয়েত শাসনামলকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের অনেকে রাশিয়া ও বেলারুশের সঙ্গে একত্র হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। যুদ্ধের ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছে। ইউক্রেনের অনেক সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে রাশিয়াকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করেছে। যদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কিংবা এর আগের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরশেঙ্কো মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়ন করতেন এবং লুহানস্ক ও দোনেৎস্কে বসবাসরত রুশভাষী জনসাধারণকে পরিপূর্ণভাবে স্বায়ত্তশাসন দিতেন, তাহলে হয়তোবা এ যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হতো।

আরও পড়ুন

এখন পর্যন্ত যুদ্ধের যে অবস্থা, এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর লক্ষ্য অর্জনে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। পুতিন ইউক্রেনের শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল দনবাসকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছেন, হয়তো বন্দরনগরী ওডেসাকেও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য তিনি মনস্থির করেছেন। অন্যদিকে এ যুদ্ধ চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এ দুই দেশ যদি এক থাকতে পারে, তাহলে আগামী দিন তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীন ও রাশিয়ার উত্থান বিশ্বের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে গোটা বিশ্বে পশ্চিমাদের একক আধিপত্য কমে এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অসহায়ত্ব আজ সবচেয়ে বেশি প্রকট হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যেটা মনে হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউরোপের দেশগুলো আরও অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। নিকট ভবিষ্যতে আবারও স্নায়ুযুদ্ধ ফিরে আসতে চলেছে। তবে এ স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো কীভাবে চীন ও রাশিয়া অথবা পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে বাফার স্টেটের ভূমিকা পালন করে, সেটা দেখার বিষয়।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।