মানুষের দাম কত—শেষ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘তাই কি? এ রকম কাউকে কি তুমি মনে মনে কল্পনা করতে?’ অংশু সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করল।

‘না, তা ঠিক না।’

‘তাহলে?’

‘আমার লম্বা, ফরসা ছেলেদের ভালো লাগে। তবে লম্বা ভুঁড়িওয়ালা লম্বা ছেলে না।’ বলে একটু মুচকি হাসল।

‘সজীব লম্বা হলেও গায়ের রং বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড রঙের চেয়ে একটু চাপা। কিন্তু শ্যামলা মুখে হাসলে ওকে দারুণ স্মার্ট ও চকচকে মনে হয়। মাথায় কোঁকড়া চুল সুন্দর করে কাটা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাত দিয়ে দাড়িগুলো নাড়তে নাড়তে ও যখন কথা বলে, আমার মুখে সুড়সুড়ির মতো একটা কিছু অনুভূতি হতো।’

‘তার মানে তুমি তখন তার মুখে হাত বুলিয়েছ?’

‘না, না, কী বলেন?’ বলেই লাজুক ভঙ্গিতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। এরপর আবার কথা বলা শুরু করল, ‘এভাবেই আমাদের প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনসহ সপ্তাহে দু-তিন দিন দেখা হতো। কখনো চায়ের দোকানে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তারপর মনের অজান্তেই একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছি।’

‘কে প্রথম প্রেমে পড়ল?’

‘সজীবই প্রথম আমাকে প্রস্তাব দেয়। যদিও আমরা দুজনই জানতাম যে এখানে প্রত্যাখ্যানের আর কোনো অবকাশ নেই।’

অংশু মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁধনের মিষ্টি প্রেমের কথা শুনছিল। মনের অজান্তেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বাহ, সুন্দর একটা তারুণ্যের আর প্রেমের উপাখ্যান শুনছি।’ বলেই আরও শোনার আশায় চুপ করে গেল।

‘হ্যাঁ, এভাবে ৯ মাস চলল। তারপর একবার আমার বাড়ির সবাই কোনো এক কাজে গ্রামের বাড়িতে গেলে আমি সজীবকে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসতে বলি। আমরা দুজন ভীষণ ভয়ে ভয়ে একে অন্যের সঙ্গে একান্তে দেখা করি। এ রকম একটু সুযোগ পেলেই সজীব আর আমি আমাদের বাড়িতে দেখা করতাম। ক্রমাগতভাবে আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ হলাম।’

একটু থামল বাঁধন, যেন কোনো এক জড়তা তাকে গ্রাস করতে আসছে। অংশু কোনো কথা বলল না। যতটুকু তার বোধগম্য হলো, তা বুঝে নিল।

বাঁধন বলতে থাকল, ‘তারপর সজীব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলো ও একটি বিমা কোম্পানিতে চাকরি পেল। চাকরির সুবাদে ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলো। আমার সবকিছু কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগত। এরপর থেকে শুধু ছুটির দিনে ও ঢাকা আসত। ঢাকা এলেই আমরা দুজনে রেস্টুরেন্টে খেতাম, কফি হাউসে কফি খেতাম, অনেক গল্প করতাম, খুনসুটি করতাম। অকারণে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতাম। ওর যেহেতু আর কোথাও থাকার ব্যবস্থা ছিল না, তাই আমরা এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে একান্ত সময় কাটাতাম।’

এভাবে আমাদের অনেক ভালোবাসা আর আনন্দে আরও বছরখানেক কাটল।

‘তাহলে সমস্যাটা হলো কোথায়? সবই তো ঠিক আছে বা ছিল’, অংশু ফোড়ন কাটল।

‘একদিন আমি সজীবকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে কোনো জবাব এল না। কয়েক মিনিট পরে আবার ফোন করলাম। এবার দুটি রিং হওয়ার পর একজন মহিলার গলা শুনলাম।’

আরও পড়ুন

‘হ্যালো কে বলছেন? আমি একটু ভড়কে গেলাম। বললাম, আমি বাঁধন, সজীবের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বলেই আমি ইতস্তত করলাম।’

‘বাঁধন? বাঁধন নামে কোনো বান্ধবীর কথা তো সজীব কখনো বলেনি। আমি সজীবের মা। কিছু বলতে হবে?’ রাগতস্বরে সজীবের মা বললেন।

‘সজীবের সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’

‘সজীব এখন গোসল করছে। বাথরুম থেকে বের হলে তোমার কথা বলব। বলেই সজীবের মা ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন।’

‘তারপর?’ অংশু বাঁধনকে জিজ্ঞেস করল।

‘সজীব পরদিন কল ব্যাক করল। অনেক রাগারাগি, তারপর গালিগালাজ করল।’ খুব মন খারাপের স্বরে বাঁধন বলে চলল, ‘কেন ফোন করেছিলাম, মা যখন ফোন তুলল তখন লাইন কেটে দিলাম না কেন বলে চিৎকার–চেঁচামেচি শুরু করল। ওই দিন আমি অনেক কাঁদলাম। রাতে মনটা আর মানছিল না। আমি আবার ফোন করলাম, কিন্তু সজীব আমাকে ফোনে, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে—সব জায়গায় ব্লক করে দিয়েছে। এভাবে প্রতিদিন সজীবকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করতাম। সপ্তাখানেক পরে ও আমাকে ফোন করে আবার অনেক বকাঝকা করল। আর যেন কখনো ফোন না করি তাই বলে শাসাল। তারপর ছয় মাস আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। এই ছয় মাসে ওর মা ওকে বিয়ে দিয়েছে। আর ও সেটা মেনে নিয়ে বিয়ে করেছে। আর ওই বিয়েটা একুশ দিন টিকেছে।’

‘তুমি কীভাবে জানলে?’ অংশু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

‘একদিন একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। আমি ভাবলাম কে না কে, তাই ফোন ধরিনি। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন। কৌতূহলবশত ধরলাম। ওপাশ থেকে সজীব ফোন করেছে। সে জেলখানার অফিসের ফোন থেকে কথা বলছে। আমাকে খুব অনুনয় করে বলল যে সে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে অনুমতি পেয়েছে ফোন করার জন্য। আমি যেন লাইন কেটে না দিই।’

‘জেল থেকে ফোন করেছ কেন?’

‘কারণ, সজীব তখন জেল খাটছে।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘মানে কী?’, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অংশু প্রশ্ন করল। তার কাছে সবই যেন অবিশ্বাস্য, বানানো একটি গল্পের প্লট মনে হলো। এত সব ব্যাপার অংশুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

নীরবতা ভেঙে গ্লাসের মধ্যে পানি নাড়তে নাড়তে বাঁধন বলল, ‘সজীবের নতুন বউ ২১ দিনের মাথায় বাপের বাড়ি চলে গেছে। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মামলা করেছে থানায়। আর ১০ লাখ টাকা দাবি করছে ক্ষতিপূরণ বাবদ।’

অংশু নড়েচড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এ মুহূর্তে তার নিজের বিয়ে করার ইচ্ছা বা শেরওয়ানি, পাগড়ি ইত্যাদি কেনার আকাঙ্ক্ষা এক্কেবারে গরম কড়াইয়ে এক ফোঁটা পানির মতো ফুস করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিজের কানকেও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তারপরও বাঁধনকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গেছে?’

‘না, মামলা চলছে। তিন মাস পর সজীব জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে।’

‘সেই বউয়ের কোনো পরিচয়, নামধাম তুমি জানো?’

‘না। তবে শুনেছি সেই মেয়েটা আমার থেকে লম্বা ছিল। মালয়েশিয়া থেকে কী যেন একটা ডিপ্লোমা করে এসেছে ম্যাসাজ থেরাপির ওপর।’

‘ইন্টারেস্টিং’, বলেই অংশু ঠোঁট বাঁকা করে চোখ বন্ধ করে মাথাটা ডানে-বাঁয়ে ঝাঁকাল।

‘ইন্টারেস্টিং কেন?’

‘দ্যাখো, এক বিংশ শতকের এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সময়ে একটা চাকরিজীবী যুবককে মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিল। আর সেও চোখ বুজে নিরুপায় হয়ে নিঃশব্দে বিয়ে করে ফেলল। কেন জানি এটা ঠিক মিলছে না।’

‘আমাকে সজীব তাই বলেছে।’

‘আমাদের সমাজে ঘটা করে একটা বিয়েতে অনেক পরিকল্পনা, আয়োজন, বিয়ের চিঠি ছাপানোর থেকে শুরু করে ফুলের মালা, গায়েহলুদ, বরযাত্রীদের যানবাহন, বউভাত ইত্যাদি অনেক বিষয় জড়িত। এখানে বিষয়টা ঝপ করে ব্যাঙ ধরার মতো হয়নি। সজীব আর কী কী বলেছে তোমাকে?’

‘বলেছে সে আমার সঙ্গে ফিরে আসতে চায়, আমাকেই সে বিয়ে করবে।’

‘বাহ বাহ বাহ। সে তো সেটা চাইবেই। কিন্তু বিষয়টা ওর বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল না?’

‘সে হোক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’

‘ওদের ডিভোর্সের দরখাস্ত বা মামলার দরখাস্ত কখনো দেখেছ?’

মাথা নাড়িয়ে বাঁধন ‘না’–সূচক জবাব দিল।

‘তাহলে তুমি কি ওর সঙ্গে দেখা করো?’

‘হ্যাঁ, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রায়ই দেখা করতে আসত। মামলা শেষ হলেই ও আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।’

‘সেটা কত দিন লাগবে?’

‘তা তো জানি না। বলেছে শিগগিরই হবে। তা–ও প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে সজীব খুব রেগে যায় আর খুব খারাপ ব্যবহার করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।’

‘শেষ কবে দেখা হয়েছিল?’

‘এক মাস আগে। তারপর আমাকে ব্লক করে রেখেছে। তারপরও আমি ওকে প্রতিদিন ফোন করার চেষ্টা করি। সেদিন হঠাৎ ওকে ফোনে পেয়েছিলাম।’

‘কী কথা হলো?’

‘আমাকে অনেক গালিগালাজ করল। ওকে ফোন করতে নিষেধ করল। আর বলল, আমার মূল্য তার কাছে ৫ টাকার সমান।’

অংশু খানিক চিন্তা করল। সে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছে মনে হলো। ভ্রু কুঁচকে আবার ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মাথার মধ্যে অনেক পাজল বা ধাঁধা ছুটে লাফিয়ে ভিডিও গেমসের মতো ছোটাছুটি করতে লাগল। প্রতিটা পাজল খণ্ড তার আকৃতির বা ডিজাইনের সঙ্গে মেলে, এ রকম আর একটা ডিজাইনকে খুঁজছে। একটা খণ্ডের সঙ্গে আরেক খণ্ডের মিল নেই। কিন্তু তারা তাদের সঙ্গে খাপ খায় এ রকম অন্য খণ্ড খুঁজছে। যদি না মেলে, তবে একে অন্যকে চুম্বকের বিকর্ষণের মতো এক খণ্ড অন্য খণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিপরীত দিকে সরে যাচ্ছে। অংশু যখন প্রাত্যহিক জীবনের বিষয়গুলোর জটলা ছাড়াতে পারে না, তখন তার মাথার মধ্যে এ রকম হয়। মাথার মধ্যে অনেক রং–বেরঙের আকৃতি, নম্বর ইত্যাদি উড়ে বেড়ায়। এসব আকৃতি উড়ে বেড়ানোর সময় যদি একটা আকৃতি আর একটার সঙ্গে ঠোকর খায়, তবে সে ভিডিও গেমের মতো ‘টিটিং’ একটা শব্দ মাথার মধ্যে অনুভব করে বা শুনতে পায়।

অনেক দিন আগে অংশু একবার তার মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া অত্যধিক স্মার্ট একটা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার এ বিষয়টা কেন হয়। বন্ধুটি বলেছিল যে এ বিষয়টা মানুষের অবচেতন মনের একটি অধ্যায়। যেখানে সে জেগেই তন্দ্রার মধ্যে চলে যায়। এর নাম সাইনেসথেসিস। সাইনেসথেসিস হলো মানুষের একটি অবচেতন মনের ক্ষমতা বা অবস্থা যখন সে স্বাদ, গন্ধ, দৃশ্যমান রঙিন ইত্যাদি মিশ্রিত করে অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে ও অনুভব করে। বন্ধুটি আরও বলেছিল, পৃথিবীর প্রায় ৭ শতাংশ মানুষের এমন ক্ষমতা থাকে। অংশুর মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি ক্ষমতা নাকি অক্ষমতা, কে যানে? সমাজে সাধারণকে সাধারণ দেখতে না পারা একধরনের অক্ষমতা বৈকি।

‘হ্যালো, আছেন?’

মুখের সামনে বাঁধনের হাত নাড়ানো আর ডাক শুনে অংশুর মাথার মধ্যের ডিজাইন আর রং–বেরঙের নকশাগুলো মুহূর্তে পালিয়ে গেল।

‘ও হ্যাঁ, আছি’। বলে মুচকি হাসি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ শুনছি বলো।’

বলেই অংশু বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থাকল।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘আমি বলছি না তো! আরে আমি শুনছিলাম। আমার মূল্য ৫ টাকা কীভাবে হলো সেইটা বলছিলেন।’

‘Oh yes, that’s right.’

বাঁধন লক্ষ করেছে, অংশু সিরিয়াস কিছু বললে ঠুসঠাস আমেরিকানদের মতো করে ইংরেজি বলে। বাঙালিরা সাধারণত ব্রিটিশ ইংরেজি শুনতে অভ্যস্ত। অংশু বিষয়টি সামলে নিয়ে বলে, ‘তোমাকে একটা দিক বলা হয়নি। কারণ, ওই দিকটি আমি জানতাম না। এইমাত্র জানলাম।’

বিস্ময়ে বাঁধন জিজ্ঞেস করে, ‘কোন দিকটি?’

‘ক্রেতা বা দরদামকারীর দিকটি। এখানে সজীব হলো দরদামকারী। দেখো, পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের একটি মূল্য আছে। সেই মূল্য স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আগেও বলেছি তোমাকে। তবে দরদামকারী ও জিনিস—এ দুটোরই গুরুত্ব আছে। কারও গুরুত্ব কম বা বেশি নয়।’

‘কী রকম?’

‘জিনিসের যেমন উপযোগিতা আছে, তেমনি জিনিসের দরদামকারীরও যোগ্যতার বিচার আছে। এ যোগ্যতা হলো শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান আর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বা আর্থিক ক্ষমতা।’

‘সজীব তো এখন বেশ আয় করে, তাহলে তার ক্রয়ক্ষমতা কি মাত্র ৫ টাকা?’ অভিযোগের সুরে বাঁধন অংশুকে প্রশ্ন করে।

‘বিষয়টা সে রকম না।’

‘তাহলে কী?’

‘বিষয়টা বলতে একটু দ্বিধা হচ্ছে।’

‘আচ্ছা বাবা, বলুন তো। আমি কিছু মনে করব না।’

অংশু সোজা হয়ে বসল। ঘাড় সোজা করে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ‘জানো, আমেরিকানদের মধ্যে প্রচলিত উক্তি আছে—Someone’s trash is someone else’s treasure’ অর্থাৎ, এক ব্যক্তির কাছে যা অকেজো, মূল্যহীন তা অন্যের কাছে মূল্যবান।’

‘অনুবাদ করতে হবে না, বুঝতে পেরেছি।’

‘আবার এমনও হতে পারে যে তুমি বেশ সহজলভ্য। এখানে তোমার মূল্য ও সজীবের স্যাকরিফাইস ৫ টাকার সমতুল্য। সে ক্ষেত্রে ৫ টাকার সমান অর্ঘ্য বা স্যাক্রিফাইসে তোমাকে কেনা বা পাওয়া যাবে, বলেই বিষয়টাকে হালকা করার জন্য অংশু হেসে ফেলল।

‘কী বলেন? ৫ টাকা কোনো অর্ঘ্য হলো? আজকাল মানুষ ভিখারিকেও ৫ টাকার বেশি ভিক্ষা দেয়’, বলেই রেগে এদিক-ওদিক তাকাল।

‘আচ্ছা বিষয়টা তাহলে অন্যভাবে বলি। Say for example, if we turn the table, আমরা যদি টেবিলটা ঘুরিয়ে দিই তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে?’

‘মানে কী?’

‘মানে হলো, মনে করো, তোমার জায়গায় সজীব আর সজীবের জায়গায় তোমাকে বসালে কেমন হবে?’

‘কিন্তু আমি তো ওকে অনেক লাভ করি। ও তো আমার এই পরিমাণ লাভ কখনোই করতে পারবে না।’

বাঁধন অবুঝের মতো বাদ সাধল। অংশু বিষয়টা কীভাবে অসীম প্রেমে পড়া মেয়েটাকে বোঝাবে তার কূলকিনারা পেল না। তবুও বলল, ‘আচ্ছা, তোমার কথা বাদ দিলাম। মনে করো, একটি শিক্ষিত সাধারণের চেয়ে সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়ে তোমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। তোমার এই বেস্টির কাছে একটা ছেলে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এল। ছেলেটা একবার বিয়ে করেছিল অন্য একটি অবিবাহিত মেয়েকে। আপাতত ছাড়াছাড়ি হয়েছে। সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক ওই স্ত্রী শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ করেছিল স্বামীর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে ছেলেটার জেল হয়েছিল। এখন জামিনে মুক্ত আছে। তবে যখন-তখন সে খোঁয়াড়ে ঢুকে যেতে পারে। ছেলেটার তেমন অর্থবিত্তও নেই। তোমার বান্ধবী ছেলেটাকে কী বলবে? প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করবে নাকি প্রত্যাখ্যান করবে? মেয়েটার কাছে ওই জেলফেরত ছেলেটার এক্সচেঞ্জ ভ্যালু বা বিনিময় মূল্য কত? সোজা কথায়, ওই অবিবাহিতা সুন্দরী বান্ধবীর কাছে ওই বিবাহিত জেলফেরত বিচারাধীন ছেলেটির মূল্য কত?’

‘দেখেন জেলফেরা সব আসামিই খারাপ না’, বলেই বাঁধন খুব গম্ভীর হয়ে গেল ওর মুখ–চোখের ওপর একটা মেঘলা ছায়া ছাপিয়ে গেল। আবার বলল, ‘প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যায় না।’

‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি অনেক সিরিয়াস দাগী আসামিকেও অনেক মেয়ে ভক্ত থাকে’, বলেই অংশু হো হো শব্দ করে হেসে উঠল।

বাঁধন বেশ রাগতস্বরেই অংশুকে বলল, ‘দেখেন, এভাবে আমাকে নিয়ে তামাশা করে হাসবেন না’, বলেই স্যান্ডেল খুলল। বাঁধন টেবিলের ওপরে একটু ঝুঁকল। অংশু বেশ ভয় পেয়ে গেল। আজকালকার মেয়েদের কাণ্ডকারখানা বোঝা মুশকিল। ভাবল, স্যান্ডেল হাতে ওঠালেই ঝেড়ে দৌড় মারবে। পেছনে তাকাবে না। বিপদ বলেকয়ে আসে না। বাঁধন ডান পা–টা বাঁ হাঁটুর ওপরে উঠিয়ে জোরে জোরে পায়ের তলা চুলকাল। বলল, ‘আমাকে নিয়ে কেউ হাসি–তামাশা করলে আমার পায়ের তলা চুলকায়।’

অংশু অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে হাত দুটি গুটিয়ে বসে থাকল। ভাবল, মেয়েটিকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া প্রয়োজন। তাই গম্ভীর গলায় বলল, ‘একজন ব্যক্তির মূল্য আর্থিক বা মুদ্রাবিষয়ক বা অন্য কোনো পরিমাণগত ইউনিটে পরিমাপ করা যায় না। প্রতিটি ব্যক্তি অনন্য এবং তাদের মূল্য অপরিমেয়। মানুষের সহজাত মর্যাদা এবং মূল্য আছে কেবল মানুষ হওয়ার কারণে।’

বাঁধন এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে টালুমালু হয়ে তাকাল। বাতাসের মধ্যে তাকে কোন ছকে ফেলা যায়, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করল। নিজেকে জগতের কোনো ছকে ফেলা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। সে তার ছক খুঁজে পেল কি না, বোঝা গেল না। যখন তার চোখ অংশুর দিকে ফিরে এল, অংশু আবার বলতে শুরু করল, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির তার প্রতিভা, দক্ষতা এবং ক্ষমতার মাধ্যমে তার নিজস্ব উপায়ে বিশ্বে কিংবা মহাজগতে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির ভালোবাসার, তৈরি করার, শেখার, বেড়ে ওঠার এবং তাদের চারপাশের লোকদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলার ক্ষমতাও রয়েছে।’

‘অতএব একজন ব্যক্তির মূল্য অপরিমেয় এবং কোনো বাহ্যিক কারণ, যেমন তার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান বা শারীরিক চেহারা দ্বারা তার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। প্রতিটি ব্যক্তিই মূল্যবান এবং কেবল পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের কারণেই সে সম্মান ও মর্যাদার যোগ্য।’

‘এটা তো রাজনীতিবিদদের মতো কথা বললেন।’

অংশু ছদ্ম গাম্ভীর্যে ইতস্তত করে বলল, ‘বিষয়টা সে রকম নয়, তবে যা বললাম, ওটা সর্বজনীন। আর যদি নির্দিষ্ট করে তোমার কথা বলতে হয়, তাহলে তোমার কাছেও সজীবের মূল্য এক জায়গায় স্থির থাকবে না। সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করবে। ওই যে মনে আছে তোমাকে দেশলাইয়ের উপমাটা বলেছিলাম? আমার মনে হয়, তোমাদের সম্পর্কের স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গের মাত্রা কমেছে। ফলে সম্পর্কের মূল্য কমে এসেছে, মানুষের মূল্য নয়।’

এই যে জীবনের এক্সচেঞ্জ ভ্যালু আর ক্রেতা বা দরদামকারীর স্থান নিয়ে বাঁধন যেন হতবিহ্বল। হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাঁধন উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন উঠি, বড্ড গরম পড়েছে।’

‘চলো, তোমাকে রিকশা ডেকে দিই’, বলেই অংশু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

অংশু উঠে দাঁড়ানোর সময় লক্ষ করল, বাঁধনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে চক চক করছে। আর একটু দেরি হলে হয়তো টপটপ করে কপাল বেয়ে মাটিতে পড়বে।

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র