মানুষের দাম কত–১

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সেদিন হঠাৎ করেই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অংশুর। ওর মেয়েবন্ধু। বান্ধবী বললে লোকজন মনে করে মেয়েটি বোধহয় অংশুর প্রেমিকা। আবার বন্ধু বললে কেমন যেন আক্ষরিক হয় না।

 অংশুও মেয়েটির ছেলেবন্ধু। কদাচিৎ দেখা হয়। বয়সের পার্থক্য বছর তিনেকের। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের হিসেবে অংশু তিন বছরের বড় মেয়েটির থেকে। অংশুর সাতাশ, আর ওর মেয়েবন্ধু চব্বিশের কোঠায়। নাম বাঁধন। বাঁধনের সঙ্গে অংশুর প্রথম দেখা হয় এক আড্ডাতে। ওর বোন অংশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ছাত্রী ছিল। যদিও ওর বোনটি অংশুর থেকে এক বছরের ছোট, তবুও মাঝেমধ্যে দেখা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।

 বাঁধন সব সময় ওর বোনের সঙ্গে লেপটে থাকে। বোন আছে মানে সঙ্গে বাঁধনও আছে। বাঁধন অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে। তবুও সবাই ওকে অংশুদের একজন হিসেবেই জানে। মেয়েটি সংগীত, নাটক, সাহিত্য, চারুকলা এসব কোনো কিছুতেই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে না, তবে ও একজন ভালো শ্রোতা ও দর্শক।

 খুব হাসে মেয়েটা, যেন জীবনের কোনো দুঃখ, সীমাবদ্ধতা ওকে স্পর্শ করেনি, করতে পারে না। কারণে অকারণে হাসে। হাসলে ওর চকচকে দাঁতগুলো যেন হাসিটাকে আরও সমৃদ্ধ করে, ওর হাসির সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দেয়। অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে হাসি আরও হাসি আনে, সুখ আরও সুখ আনে। মানুষের হাঁসি একটি সংক্রামক বিষয়। হাসি চারপাশ সংক্রমিত করে আরও হাসি নিয়ে আসে। কেউ যদি আপন আনন্দে হাসে, আশপাশে থাকা গোমড়ামুখগুলোরও মনের গভীরে হাসিহাসি ভাব হয়। যখন আশপাশের সবাই আড্ডা মেরে হাসাহাসি করে, বাঁধন সবার সঙ্গে এক ধাপ এগিয়ে আরও জোরে হেসে কুটিকুটি। এমন একটা ব্যাপার যে রসাত্মক কথাটা যেন ওর উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে!

 যারা অনেক হাসতে পারে তারা অনেক তাড়াতাড়ি বন্ধু হতে পারে। বাঁধনও এভাবেই অংশুর একজন মেয়ে বন্ধু হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে খেয়াল করেছে যে অন্যরা একটু আড়চোখে দেখে ওদের এই বন্ধুত্বটাকে। ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব হতে পারে—এ যুগেও অনেকের সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। আরও কষ্ট হয় যদি কি না বাঁধনের মতো প্রাঞ্জল সুন্দরি মেয়ের সঙ্গে একটা ছেলের বন্ধুত্বের বিষয় আসে। বাঁধন ডাকসাইটে সুন্দর না হলেও বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য বলতে আমরা যা বই পুস্তকে পড়ি, তার সবটাই তার আছে।

 ওর ভ্রু জোড়া স্রষ্টা দারুণভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার যেভাবে প্রতিটি ফুলগাছ কিংবা বাগানের গাছপালা যত্নের সঙ্গে ছাঁটাই করে শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো করে রাখে, প্রকৃতি সেভাবেই ওর ভ্রু জোড়ার একটা একটা চুলকে ঠিক ঠিক স্থানমতো লাগিয়েছেন। চোখ দুটি ফোলা ফোলা। দেখলে মনে হয় এইমাত্র দুপুরের দিবানিদ্রা শেষ করে উঠে এলো। সামনের ওপরের পাটির দাঁতগুলো সামান্য উঁচু। এতে ওর ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁকা থাকে, হাসি হাসি অধিকাংশ সময়। মডেলরা যেভাবে ইচ্ছা করে ক্যাটওয়াকে ঠোঁট খুলে হাঁটে, সে রকম। বাঁধন জানে ওর চোখ দুটো সুন্দর। তাই কাজল কিংবা চোখের কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করে না।

অংশু একদিন কৌতূহলবশত ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই বাঁধন, তুমি চোখের কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করো না কেন?’

 ‘কেন চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করলে কী হতো?’

 ‘অনেকেই ব্যবহার করে, তাই বললাম।’ বলেই অংশু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বিষয়টাকে হাল্কা করার চেষ্টা করল। চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করলে হয়তো আরও সুন্দর দেখাত— এটা বলার সাহস হলো না।

 ‘আমার চোখ এমনিতেই সুন্দর!’

 আড়চোখে তাকিয়ে বাঁধন বলেছিল, ‘আপনার চোখে আইশ্যাডো লাগালে যদি আরও সুন্দর দেখায়, তাহলে আপনি কি আইশ্যাডো লাগাবেন? দ্যাখেন, ছেলেদের চোখেরও অনেক সৌন্দর্য আছে।’

 ‘তাই নাকি? জানতাম না তো!’ বলেই বাঁধনের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার উৎসুকের মতো জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেদের চোখের সৌন্দর্যের বিষয় নিয়ে তেমন কিছু শুনি না, তুমি কি ছেলেদের চোখের এই বিষয় কোথাও শুনেছো বা পড়েছো?’

 জিজ্ঞাসা করেই হা করে বাঁধনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল উত্তরের অপেক্ষায়।

 ‘অবশ্যই শুনেছি, পড়েছি এবং দেখেছি। এই ধরুন, নায়কের মতো চোখ, ভিলেনের মতো চোখ, মিথ্যাবাদীর মতো চোখ, মাতালের মতো চোখ, টেরা চোখ, ইত্যাদি। তারপর বোকা বোকা চোখও আছে, যেমন, এই মুহূর্তে আপনার চোখ সে রকম মনে হচ্ছে!’ বলেই মিটমিট করে হাসল। অংশু গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কয়েক সেকেন্ড পরে বিষয়টা আঁচ করতে পারল যে তাকে নিয়ে বলা হয়েছে। আর বুঝেই হা হা করে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির তোড়ে চেয়ার কেঁপে মেঝের টাইলের ওপরে কুছ কাচ শব্দও হলো। আশপাশে তাকিয়ে অংশু দেখল বসা-দাঁড়ানো অনেক মানুষের চোখ ওর ওপরে। সবার দৃষ্টি কেন ওর ওপরে তা বুঝতে একটু সময় লাগল।

 তাই তো, বাঁধনের কথা অন্য আর কেউ তো শোনেনি। মনে মনে ভাবল, ওরা শুনলে নিশ্চয়ই অংশুর মতোই মজা পেত।

 ‘অনেক জোরে হাসলে আপনার চোখ জাপানি বাচ্চাদের মতো দেখায়।’ বলেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কুটিকুটি হেসে টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। মাঝে টেবিল না থাকলে হয়তো অংশুর গায়ের ওপরই আছড়ে পড়ত। অংশু ছেলেদের চোখের এ রকম আজব বর্ণনা জীবনে কখনো শোনেনি।

আজ অংশু ও বাঁধন ইউনিভার্সিটির পাশে একটা ক্যাফেতে একটা টেবিল নিয়ে সামনাসামনি বসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাখানা এই ক্যাফে। অংশু একটি সংস্কৃতি সংঘের সদস্য। ও মাঝেমধ্যে এখানে আসে, সবার সঙ্গে দেখা করতে বা আড্ডা মারতে। তাঁদের নাটকের কোনো রিহার্সাল থাকলে এখানে সবাই সমবেত হয়ে তারপর রিহার্সাল স্থানের দিকে রওনা হয়।

 অংশু দুটো কফির অর্ডার দিয়ে স্থির হয়ে বসল। আজ বাঁধনের মনটা অন্য দিনের মতো ফুরফুরে না। সঙ্গে ওর বোনটাও নেই। অংশুর একটু খটকা লাগলো। জিজ্ঞাসা করল, ‘কি বাঁধন সব ঠিকঠাক?’

 ‘হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক’। নরম সুরে বাঁধন বলল।

 প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বাঁধন অংশুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অংশু ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?

 ‘হ্যাঁ। কী প্রশ্ন?’

 ‘একটা মানুষের প্রাইস বা মূল্য কত?’

 হঠাৎ এরকম একটা জটিল প্রশ্ন শুনে অংশু আশ্চর্য হয়। বলে, ‘এটা একটা খুব দামি এবং আপেক্ষিক প্রশ্ন। যদি সত্যিই জানতে চাও তাহলে আমার মতে এরকম হবে…’ একটু থেমে আবার বলে, ‘প্রথমে আমার নিজের কত মূল্য সেটা দিয়ে শুরু করি।’

 ‘আপনার মূল্য কত?’

 ‘আমার মূল্য আমার মায়ের কাছে একরকম, আবার তোমার কাছে একরকম’, বলেই একটু মুচকি হাসল।

 বাঁধন জিজ্ঞাসা করে, ‘হুম, তাহলে সন্তানের কাছে বাবা বা মায়ের মূল্য কত?’

 ‘বাবা-মায়ের কাছে প্রতিটা সন্তান অমূল্য। অর্থাৎ একজন মা তাঁর গর্ভে ধারণ করা সন্তানকে যে মূল্য দেবেন, প্রতিটি মা ঠিক একই মূল্য দেবেন। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটার পরিমাণ বের করা যাবে না। অন্যভাবে বললে, তোমার কাছে তোমার মা-বাবার যে মূল্য, আমার কাছেও আমার মা-বাবার একই মূল্য।’

 একটু থেমে আবার বলল, ‘প্রতিটি জিনিসের মূল্য আবার স্থান, কাল, পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। একটা চেয়ারের লবণাক্ত, আর্দ্র জায়গায় বা দেশে যা দাম হবে, শুষ্ক মরুভূমি এলাকায় সেই একই চেয়ারের দাম ভিন্ন হবে। কারণ, ওই নির্দিষ্ট প্রকারের কাঠের চেয়ারের স্থায়িত্ব কম বা বেশি হবে আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদির প্রভাবে। তাই একই জিনিসের মূল্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে।

 একটি জিনিসের মূল্য হচ্ছে যে ওই জিনিসের কাছ থেকে ক্রেতা বা মূল্য নির্ধারণকারী কতটুকু উপযোগিতা পাচ্ছে তার ওপর। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসের একটা মূল্য আছে। মূল্য হলো একটি বস্তু পেতে গেলে কি পরিমাণ স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের সম্মুখীন হবে তার সমতুল্য। যদি স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে মূল্য বেশি হয় তবে সেই বস্তুটা হবে মাত্রাতিরিক্ত দামী বা ওভারপ্রাইসড।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

অংশু ইতস্তত করল। আজকাল বখাটে ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদের টিজিং করার সময় ‘জিনিস’ বলে। তবুও বলে চলল, কোনো জিনিস ক্রয় করার আগে তুমি সব সময় মূল্যের কথা চিন্তা করো। মূল্যটা যদি তোমার স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে বেশি হয় তবে ওই জিনিস কিনে তুমি খুশি হবে। আবার মূল্য যদি বেনিফিট বা উপযোগিতার চেয়ে কম হয়, তবে সেটা কিনে তুমি মনে করবে যে তুমি ঠকেছ।’

 ‘হ্যাঁ, বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখিনি।’

 বাঁধন আগ্রহভরে বলল, ‘মনে করো আমি একটা শাড়ি কিনে তোমাকে উপহার দেব। ধরো, সেই শাড়িটির মূল্য ১০০ টাকা।’

 ‘মাত্র ১০০ টাকার শাড়ি?’ বলেই বাঁধন অংশুকে থামিয়ে দিল।

 ‘তুমি কি আমার এতক্ষণের বকবক শুনেছিলে, নাকি হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে?’, বলেই অংশু বাঁধনের দিকে আবার তাকিয়ে মুচকি হাসল। ‘শুনছিলাম আর ভাবছিলাম’। ‘কি ভাবছিলে’? ‘একি গোলকধাঁধা? মূল্যের সঙ্গে উপযোগিতার সম্পর্কের কথা। মানুষের যদি উপযোগিতা থাকে তবে সজীবের কাছে আমার উপযোগিতা কি তা–ই ভাবছিলাম।’ সজীব বাঁধনের প্রেমিক, তবে এখন একটু মন–কষাকষি চলছে।

 ‘হুম, সেটা একটা ভাবার বিষয় বটে। যেমন বললাম, মূল্য নির্ধারিত হয় স্থান, কাল, পাত্র ভেদে। এখানে সজীব হলো পাত্র বা দরদামকারী। কিন্তু এর সঙ্গে স্থান ও কাল জড়িত আছে।

 ‘তবে সজীব সম্পর্কে আমি তেমন বিশেষ কিছু জানি না। জানলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখতে পারতাম।’

 ‘সজীবের সম্পর্কে দেখি বলবো আপনাকে।’, বলেই বাঁধন অন্যমনষ্কের মতো অংশুর দিকে তাকিয়ে আবার তাড়া দিল, ‘আপনি কিন্তু আমার মূল্যায়ন শেষ করলেন না।’

 ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, বলেই বিজ্ঞের মতো বর্ণনা শুরু করল। মনে করো একটি শাড়ির মূল্য তাহলে ১০ হাজার টাকা, যেটা আমি দোকানে কিনতে গিয়েছি তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য। এখন ওই শাড়িটার বিনিময় মূল্য হলো ১০ হাজার টাকা। তার মানে আমার পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে উপহার দেব। এখন ওই শাড়িটা ক্রয়ের ফলে আমি কি উপযোগিতা পাবো?’

 ‘হ্যাঁ, ১০ হাজার টাকার শাড়ি কিন্তু দেখতে সুন্দর হবে। কিন্তু আমার কাছ থেকে আপনি কি উপযোগিতা পাবেন বলে আপনার মনে হয়?’

 ‘এখানে উপযোগিতা বলতে শাড়িটা পেয়ে তুমি খুশি হবে। শাড়িটা কি উপলক্ষে পরা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করবে। এটির সঙ্গে রং মিলিয়ে ব্লাউজ বানাবে, চুড়ি কিংবা মাটির মালা কিনবে। হয়তো জুতা বা হিল স্যান্ডেল কিনবে। এসব চিন্তা করে তোমার কিছু ভালো সময় কাটবে। এসব ভালো সময় কাটানোরও কিছু মূল্য আছে।’

 ‘আর এ ক্ষেত্রে আপনার উপযোগিতা?’

 ‘আমার উপযোগিতা হলো তুমি আরও বেশি করে খিল খিল করে প্রাণ খুলে হাসবে। তোমার গায়ে শাড়িটা তোমাকে আরও উজ্জ্বল করবে, এই আর কি।’

 বাঁধন ভাবে, এভাবে তাকে কেউ কখনো বলেনি। এ রকম কারও ভাবনা হতে পারে, একটু উদ্ভট। যাকগে।

 ‘হ্যাঁ, এবার বলুন শাড়ির বিষয়টা।’

 ‘মূল্য হচ্ছে, ওই শাড়িটা কতটুকু উপযোগিতা দিতে সক্ষম হবে। যদি বিনিময় মূল্য উপযোগিতার চেয়ে কম হয়, তবে দোকানি আমার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে।’

 ‘তা কী করে হবে?‘, বাঁধন জিজ্ঞাসা করে।

 ‘ধরো, শাড়িটি উপহার হিসেবে পেয়ে তুমি বললে, রঙটা কচি কলাপাতার রং না হয়ে গাঢ় নীল হলে ভালো হতো। অথবা পাড়-আঁচল গোলাপি না হয়ে মেরুন হলে ভালো হতো। তাহলে আমি বুঝতাম শাড়িটি তোমার পছন্দ হয়নি। তার মানে শাড়িটার উপযোগিতা ১০ হাজার টাকার সমান নয়। আমি ঠকেছি শাড়িটা কিনে।’

 ‘আরে কি বলেন? কচি কলাপাতা রং আমার খুব পছন্দ। তার ওপর গোলাপি পাড়, আঁচল হলে তো সোনায় সোহাগা!’ বলেই বাঁধন মিটমিট করে হাসল। বলল, ‘তাহলে না হয় কচি কলাপাতা রংয়ের শাড়িটা পেলাম। কিন্তু ওটা তো বস্তু। প্রশ্নটা হচ্ছে আমার মূল্য নিয়ে, মানুষের মূল্য নিয়ে। মানুষের মূল্য তাহলে কীভাবে নির্ধারণ করবেন?’

 ‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে চাচ্ছি, প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট মূল্য আছে!’ বলেই অংশু বাঁধন এর মুখের দিকে তাকাল।

 বাঁধনের মুখটা বেশ শুকিয়ে গেল। এতক্ষণ সে যেভাবে অংশুর দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ব্যাগের ফিতা আঙ্গুল দিয়ে খুঁটতে লাগল। অংশু ক্ষণিকের জন্যে চুপ হয়ে গেল। নিঃসঙ্গতা ভেঙ্গে বাঁধন বলল, ‘কি থেমে গেলেন যে?’

 ‘হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষের মূল্য আলাদা। তোমাকে একটি উদাহরণ দিই। ধরো, তুমি তোমাদের বাড়িতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। দ্বিতীয়ত, উপজেলা চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। তৃতীয়ত, তুমি একজন সংসদ সদস্যকে দাওয়াত দিলে। চতুর্থত, তুমি একজন মন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। পঞ্চমত, তুমি প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। এই দাওয়াতগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে তুমি কিন্ত একই রকম আয়োজন করবে না।’

 বাঁধন টুঁ শব্দও করছে না, যেন গোগ্রাসে অংশুর কথা খাচ্ছে।

অংশু আবার শুরু করল, ‘তুমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের জন্য যে আপ্যায়ন করবে, উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য তার চেয়ে ভালো আয়োজন করবে। আবার উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অনেক বেশি আয়োজন করবে। কারণ, তুমি জানো যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ঘরে দাওয়াত করে আনার যে পরিমাণ মূল্য বা উপযোগিতা তা সাময়িক। তার তুলনায় উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বেশি অনুভূত মূল্য পাবে। সংসদ সদস্য হলে আরও বেশি, মন্ত্রী হলে তার চেয়ে বেশি, প্রধানমন্ত্রী আরও অনেক বেশি অনুভূত উপযোগিতা পাবে।’

 ‘আমি জানি আমি কোনো চেয়ারম্যান বা এমপি নই। কিন্তু তাই বলে আমার মূল্য ৫ টাকা কীভাবে হলো? আজকাল পাঁচ টাকায় একটা দিয়াশলাইও পাওয়া যায় না।’

 মনে হলো বাঁধন বেশ রাগতস্বরেই প্রতিবাদ করল। অংশু জিজ্ঞাস করল, ‘৫ টাকার কথা আসছে কেন?’

 ‘আমাকে একজন বলেছে যে আমার মূল্য নাকি ৫ টাকা।’

 ‘হ্যাঁ, সেটা জানি যে তুমি চেয়ারম্যান বা এমপি নও। তবে তোমাকে কি ধরনের মানুষের সঙ্গে তুলনা করব, তুলনা করা আদৌ ঠিক হবে কি না, তা–ই ভাবছি।’

 ‘আপনি যা খুশি তার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি আমি কি ধরনের মেয়ের সঙ্গে তুলনীয়।’

 ‘হাত নাড়িয়ে অংশু বাঁধনকে থামানোর ভঙ্গিতে বলল, আমি আসলে তোমাকে কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে চাইনি।’

 ‘না ঠিক আছে’, বলে মাথা নাড়িয়ে বাঁধন সায় দিল।

 এবার একটু রসিকতার ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখে অংশু বাঁধনকে বলল, ‘তুমি কি জানো, বিভিন্ন দিয়াশলাইয়ের দাম বিভিন্ন রকম হয়?’

 ‘তাই?’, বাঁধন বিস্ময় প্রকাশ করে।

 ‘হ্যাঁ, তা–ই। জানো কোনো কোনো দিয়াশলাই দিগুণ দামেও বিক্রি হয়।’

 ‘কীভাবে?’

 ‘এই যেমন এক রকম দিয়াশলাই কাগজের, কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো। কাগজের ওই খাপের মধ্যে বাতাস বা জলীয়বাষ্প ঢুকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি উদায়ে যায়। অনেক বার দিয়াশলাইয়ের গায়ে কাঠি ঘষলেও আগুন জ্বলে না।’

 ‘আপনি সিগারেট খান?’

 ‘হঠাৎ এ রকম অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছ কেন?’

 ‘দিয়াশলাই জ্বালাতে আপনার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না’, বলেই হা হা কোরে হেসে উঠল বাঁধন।

 ‘হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে মন উদাস হলে তখন খাই’

 ‘মন উদাস কমে সিগারেট খেলে?’

 ‘না। সিগারেট খাওয়া খারাপ—এটা মনে হলে মন আরও উদাস হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি আর সিগারেট খাব না, মায়ের বাধ্য ছেলের মতো হয়ে যাব। সবাই আমাকে পছন্দ করবে। বলবে, অংশুর মতো অমায়িক ছেলে হয় না। এমনকি বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত খায় না।’

 ‘বাধ্য ছেলেদের সবাই পছন্দ করে—এই কথা ঠিক নয়। মায়ের বাধ্য ছেলে, তার বউয়ের কাছে ভালো নয়’, বাঁধন প্রতিবাদ করল।

 ‘হুম, বুঝলাম না’, বলেই অংশু অন্যমনস্ক হলো ক্ষণিকের জন্য।

 বাঁধন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা বলুন।’

 সম্বিত ফিরে পেল অংশু বাঁধনের আবদার মেশানো প্রশ্নে।

 ‘দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা বলতে বলতে থামলেন কেন?’

 ‘ও হ্যাঁ, মনে কর যদি কাগজের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাই, যার গায়ে দিয়াশলাইয়ের বারুদ লাগানো কাঠি দিয়ে ঘষলেও আগুন জ্বলল না। আবার প্রায় কাগজের মতো পাতলা করে কাটা শিমুলগাছের কাঠ দিয়ে বানানো দিয়াশলাই যা জলীয় বাষ্প রোধ করে। এ রকম কাঠের দিয়াশলাইয়ের মধ্যে রাখা বারুদ মাখানো কাঠের কাঠি দিয়ে বাক্সের গায়ে ঘষা দিলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাঠিতে আগুন জ্বলে উঠল। এ ক্ষেত্রে কাঠের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাইয়ের মূল্য কাগজের খাপের দিয়াশলাইয়ের তুলনায় বেশি হবে।’

 ‘এই তুলনা করাটাই আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়।’

 অংশু ভয়ে ভয়ে বাঁধনের দিকে তাকাল। ভাবল, এ বোধ হয় একটা ঝামেলা বেধে গেল। চুপ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত।

 বাঁধন বলল, ‘আমি কখনো সজীবকে কারও সঙ্গে তুলনা করিনি। সজীব ওর বিয়ের পর থেকেই আমাকে সব সময় তুলনা করে। কিন্তু আমার কাছে ও তো অমূল্য। ওকে যে আমি অনেক লভ করি।’

 আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রকৃত ভালোবাসাকে ‘লভ’ বলে। লভ শব্দটা টেনে একটু লম্বা করে বলে, ইংরেজি শব্দ লাভ আরকি। যার মানে ‘ভালোবাসা’ সেটার গভীরতম একটা অবস্থা। এসব বিষয়গুলো অংশু খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে; কারণ, বাহ্যিকভাবে ভালোবাসা, প্রেম, লভ, লাভ, ইত্যাদির মানে একই হলেও ইদানীং প্রকৃতভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণভঙ্গির ওপর নির্ভর করে শব্দটির মানে ও গভীরতা। অংশু ভাবে শেক্‌সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথের সময়ে এই শব্দার্থের পার্থক্য হলে নিশ্চয়ই তারা কবিতার ছন্দে শব্দগুলোর মর্মার্থ বুঝিয়ে দিতেন।

 ‘বিয়ের পর থেকে, মানে কী?’ অংশু যেন আকাশ থেকে পড়ল। বাঁধন চোখ নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে হাতেপরা স্বর্ণের ব্রেসলেটটি নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছে।

 অংশু আবার কৌতূহলি স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি বিয়ে করেছ?’

 ‘আরে না, ও আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল।’

অংশু কী বলবে, ঠিক বুঝতে পারল না। বাঁধনের সঙ্গে প্রায় বছরখানেক মাঝেমধ্যেই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা মেরেছে, কিন্তু এ রকম একটা বিষয় কখনো সে আকার-ইঙ্গিতেও বলেনি। অবশ্য কারও মুখ দেখে তার ভেতরে কি হচ্ছে বোঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অপারগ হয়ে অংশু ‘বাঁধন, তুমি একটু ঝেড়ে না কাশলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’ বলেই চুপ হয়ে গেল। কেউ একটা কথাও বলছে না। বাঁধন মাথা ঝুকিয়ে হাতের ওপর থুতনি ঠেশ দিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। অংশু বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, বাঁধনের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তি অংশুকে স্পর্শ করছে বলে মনে হচ্ছে। এই বিরক্তি যে কিসে, তা অংশু নিজেও বুঝতে পারল না। বিরক্তিটা এতক্ষণ বকবক করার জন্য নাকি বাঁধনের বিষয়টা এতদিন বুঝতে না পারার জন্য?

 বাঁধন মাথা তুলল। বলতে শুরু করল, ‘আমার সঙ্গে সজীবের পরিচয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের যারা শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী তাদের একটি গ্রুপ আছে। মাঝেমধ্যেই আমাদের চ্যাটিং রুমে কথোপকথন হতো, আলোচনা হতো। সেই গ্রুপে সজীবও একজন সদস্য ছিল। আলাদাভাবে আমি সজীবকে কোনো কথা লেখার বা বলার প্রয়োজন অনুভব করিনি। যেহেতু সবাই সংস্কৃতিমনা তাই বিভিন্ন কবিতার বই, উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হলিউড, বলিউড, বাংলা সিনেমা—এসব নিয়ে কথোপকথন হতো।

 ‘সজীব কি তোমার একই বয়সী?’, বলেই অংশু চুপ করে বাঁধনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 ‘না, ও আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। অন্য বিভাগে পড়ত।’ বাঁধন আবার বলতে শুরু করল, ‘এভাবে বেশ কিছুদিন ফেসবুকে কথোপকথন হওয়ার পর সজীব আমাকে একদিন সরাসরি ফেসবুকে মেসেজ করল, প্রাইভেটলি। কয়েক দিন পর আমি জবাব দিলাম। এভাবে আবার বেশ কিছুদিন চলল। ছেলেটাকে আমারও বেশ ভালো লাগতে শুরু করল একজন বন্ধু হিসেবে। হঠাৎ করেই একদিন ও আমাকে কফি খাওয়ার দওয়াত করল। আমরা বনানীর একটি কফি হাউসে দেখা করলাম। অনেক কথা হলো, হাসি-ঠাট্টার মধ্যে আমাদের প্রথম সামনাসামনি সাক্ষাৎ শেষ হলো। কিন্তু তার রেশ রয়ে গেল আমার মাঝে। মনে হচ্ছিল আমি কি এত দিন এমনি কারও অপেক্ষাতে ছিলাম?’ চলবে...

 লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র