ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিশন, ‘অবৈধ অভিবাসী খেদাও!’
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে অবৈধ অভিবাসী খেদাও মিশন জোরেশোরে চলছে। বিপদে পড়েছেন হাজারো বাংলাদেশি, যাঁরা অবৈধভাবে এ দেশে থাকছিলেন। নিউইয়র্কে এ সংখ্যা প্রচুর। লস অ্যাঞ্জেলেস, বোস্টন, ফ্লোরিডাতেও শুনেছি প্রচুর অবৈধ বাংলাদেশি আছেন। রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি ইত্যাদিতে তাঁরা কাজ করে সংসার চালাতেন। দেশে টাকা পাঠাতেন। এখন আতঙ্কে আছেন, যেকোনো সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ এসে তাঁদের গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেবে।
তাঁদের অনেকেই আবার সংসারী মানুষজন। হয়তো বাচ্চাকাচ্চাদের জন্ম এ দেশে অথবা ওরাও অবৈধ। পড়াশোনা করছে, চোখে অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন। সব একঝটকায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। চেনাজানা পৃথিবী থেকে ওদের তুলে নিয়ে পুরোপুরি খালি হাতে নিজের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে যা এত দিনে ‘বিদেশ’ হয়ে গেছে।
সবার আগে বলি, আমেরিকায় অবৈধভাবে এসে কোনো লাভ নেই। অবৈধ পথে এ দেশে এসেই ওয়াল স্ট্রিটে চাকরি পেয়ে যাবেন না। আপনার জন্য ল্যাম্বরগিনি, ফেরারি নিয়ে সাদা চামড়ার সোনালি চুলওয়ালি কেউ বসে নেই যে আপনি কোনো রকমে এ দেশে এলেই সে ‘এত দিন কোথায় ছিলে’ বলে আপনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনাকে গ্রোসারি স্টোর, গ্যাসস্টেশন, কনস্ট্রাকশন (মিস্ত্রির কাজ) ইত্যাদিতে কাজ করতে হবে, যা অত্যন্ত পরিশ্রমের এবং বিনিময়ে টাকাও কম। এর চেয়ে কম পরিশ্রমে দেশে অনেক কিছু করে ফেলতে পারতেন।
কথাগুলো যা বললাম অনেক পুরোনো কিন্তু শতভাগ সত্যি। হাজারবার বলা হয়, তারপরও লোকজনের মাথায় ঢোকে না। এই সেদিনই এক লোকের খবর শুনলাম যে টেক্সাস-মেক্সিকো বর্ডার দিয়ে আমেরিকায় ঢুকেছে (গুলি খেয়ে মরতে পারত), ৫০ লাখ টাকার মতো খরচ করেছে (জানি দেশে টাকার দাম কমেছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত, ৫০ লাখ টাকা এখনো অনেক টাকা), তারপর পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে ডিপোর্টেড হয়ে এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায় ডিটেনশন সেন্টারে আছে। লাভটা কী হলো? যদি ভদ্রলোক ধরা না খেতেন, তাহলে কেমন চাকরি পেতেন? ঘাস কাটার অথবা ইট–সিমেন্ট বহন করার অথবা কোনো রেস্টুরেন্ট, গ্যাসস্টেশনে ঘণ্টাপ্রতি পাঁচ ছয় ডলারের চাকরি। দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ডলারকে টাকায় কনভার্ট করে হিসাব করা। যেমন ঘণ্টায় ৫ ডলার, মানে ৫০০ টাকা! দিনে তাহলে ৪০ ডলার, মানে ৪ হাজার টাকা। আর মাস শেষে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা! এ তো বিরাট উপার্জন! চলো আমেরিকা!
তাঁদের কে বোঝাবে যে আয় যেমন আমেরিকায় করছে, ব্যয়টাও আমেরিকাতেই হচ্ছে। এ দেশে সস্তা দোকানে চুল কাটতে গেলেও ১০-২০ ডলার চলে যায়। ঘিঞ্জি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করতে গেলেও মাসে ৫০০ ডলার যাবেই। খাওয়াদাওয়া বা অন্যান্য খরচ ধরতে গেলে দেখা যাবে আয় ১ হাজার ২০০ ডলার হলে ব্যয় ২ হাজার ডলার। এই হিসাব মেলাতে গেলে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়, দিনের ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজেই কাটে। তারপরও দেখা যায় হিসাব মিলছে না, টাকা তেমন জমছে না।
একটা পর্যায়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম, বিশ্রামের অভাব ও নিয়মিত খাওয়াদাওয়া না করার কারণে অকাল মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
অথচ দেশে ৫০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করে ১৬-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করলে কোথাকার লোক কোথায় চলে যেত!
বিদেশে এসে ঘাস কাটতে যদি সমস্যা না থাকে, তাহলে দেশে করতে সমস্যা কোথায়?
পরিশ্রমকে সম্মান করবেন, শ্রমও বিনিময়ে আপনাকে সম্মানী দেবে।
তো যা বলছিলাম, অবৈধ পথে এ দেশে এসে খুব একটা লাভ নেই। বরং বৈধ পথে এসে পড়াশোনা করলে, ব্যবসা বা চাকরিতে পরিশ্রম করলে এ দেশ আপনাকে যা দেবে, পৃথিবীর আর কোনো দেশ তা দিতে পারবে না। এটা নিশ্চিত। নিউইয়র্কের এক ভদ্রলোকের ঘটনা শুনেছিলাম, ডিভি পেয়ে এসেছিলেন। ভিক্ষা করে আমেরিকায় আসার টিকিটের খরচ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। সেই লোকের কয়েকটা সন্তান ডাক্তার, কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আজকে তিনি ও তাঁর পরিবার টাকার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে আছেন। দেশে থাকলে হয়তো তিনি আজও সিলেটের কোনো গ্রামে ভিক্ষাই করতেন। এমন ঘটনা প্রচুর আছে।
বৈধ পথে এ দেশে আসার বহু উপায় আছে। পরিশ্রমই যদি করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে আগেই করুন। পড়াশোনা করে IELTS, TOEFL ইত্যাদিতে স্কোর তুলুন অথবা দক্ষ শ্রমিক হন এবং বৈধ পথে আসুন। সবচেয়ে সহজতম উপায় হচ্ছে মার্কিন কোনো নাগরিককে বিয়ে করে এ দেশে আসা। আর যদি কেউ অবৈধ পথের সন্ধান দেন, তাঁদের এড়িয়ে চলুন।
আর পরিশ্রমের পরও আমেরিকা আসতে না পারলে ধরেই নেবেন আপনার রিজিক অন্য কোথাও লেখা আছে।
তা এখন যাঁরা অবৈধ অভিবাসী, তাঁরা কী করতে পারেন?
এক নম্বর শর্ত হচ্ছে, খবরদার, এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে আপনি পুলিশের রাডারে চলে আসেন। মানে আইন ভাঙবেন না। সেটা চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু করে ট্রাফিক আইন, ভুল পার্কিং পর্যন্ত সবকিছুই। একদম বেতের মতো সোজা থাকবেন। নাহলে মহা বিপদে পড়বেন। একবার পুলিশের তালিকায় নাম চলে এলে আপনাকে খুঁজে বের করা ওদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে শুধু শুধু প্যানিক করবেন না। হয়তো আপনার কোনো অ্যাসাইলাম কেস পেন্ডিং আছে, হয়তো অন্য কোনো কিছু আছে, যা আইনতভাবে আপনাকে আমেরিকায় থাকার সুযোগ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি কাগজপত্র নিজের কাছে রাখবেন। খবরদার, ওসব কাগজপত্র হারাবেন না। হারালেই বিপদ। আর সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন যদি নার্ভাস হয়ে যান। মাথা ঠান্ডা রাখলে অনেক বিপদ এমনিতেই কেটে যাবে।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিই।
গত ডিসেম্বরে আমরা সাউথ পাদ্রে আইল্যান্ডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় আমেরিকান বর্ডার সিকিউরিটির একটি চেকপোস্ট আছে, সেখানে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করে যে ভেতরের যাত্রীরা আমেরিকান নাগরিক কি না।
আমাদের গাড়িতেও একই প্রশ্ন করল। আমরাও জানালাম যে আমরা সিটিজেন এবং আমার শ্বাশুড়ি ভিজিটর ভিসায় এসেছেন।
কিন্তু আমার বউ ও শ্বাশুড়ির চেহারা দেখেই ওদের মনে সন্দেহ হলো। ওরা এমন নার্ভাস কেন? নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। আমাকে বলল, ‘ওই চিপায় গাড়ি পার্ক করো, আমরা আসছি।’
চার–পাঁচজনের দল এসে তখন আমাদের সবার আইডি চেকিং শুরু করল। আমার শ্বাশুড়ির পাসপোর্ট এমনভাবে দেখল যেন তাঁর নামের পেছনে ‘লাদেন’ শব্দ আছে।
প্যাঁচানোর মতো কিছুই না পেয়ে ওদের হতাশ মনে হলো। ওরা ভেবেছিল আমরা মানব পাচারকারী। মেক্সিকো বর্ডার দিয়ে অবৈধ অভিবাসীকে মার্কিন মুলুকে প্রবেশ করিয়েছি।
অথচ আমি লিখে দিতে পারি, ওই একই চেকপোস্টে বহু মানুষ আছে যারা অবৈধ, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় নার্ভের ওপর কন্ট্রোল রাখে বলেই আরামসে পার পেয়ে যায়।
স্টুডেন্ট যাঁরা আছেন, তাঁরা নিজেদের স্টুডেন্ট আইডিসহ ক্লাস রেজিস্ট্রেশনের কাগজ সঙ্গে রাখবেন।
রাস্তাঘাটে পুলিশ আপনাকে ধরে ‘তুমি কি বৈধ/অবৈধ’ ইত্যাদি প্রশ্ন করতে পারবে না। কাজেই রিল্যাক্সড থাকুন। স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যান।
ইমিগ্রেশন পুলিশ বা আইস কিন্তু চাইলেই আপনার বাড়িতে ঢুকে যেতে পারবে না।
আর সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশ গ্রেপ্তার করলে নিজের মুখ দিয়ে একটা কথা, একটা শব্দও করবেন না। শুধু বলবেন আপনি আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলতে চান। এবং যা বলার উকিল বলবে। আদালত আপনার মুখ ফস্কে বলা একটা কথা, একটা শব্দ আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। কাজেই এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন।
আবারও বলি, এ দেশে অবৈধ উপায়ে আসবেন না। কাউকে আসতে উৎসাহিতও করবেন না। নিজে বিপদে পড়বেন, অন্যকেও বিপদে টেনে আনবেন। লাভটা কী? বরং বৈধ পথে আসুন, জীবন গড়ুন।
সাবধানে থাকবেন। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।