আমি কেন ইসরায়েলবিরোধী
ইহুদি ও জায়নবাদ দুটি আলাদা বিষয়।
ইহুদি একটি ধর্ম, জায়নবাদীরা ধার্মিক নয়, ওদের বেশির ভাগেরই ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই; কিন্তু একই সঙ্গে ওদের বিশ্বাস—ঈশ্বর ওদের ফিলিস্তিন অঞ্চলটি দিয়েছেন, তাই ওদের ওখানেই থাকতে হবে।
মাথা প্যাঁচ খেয়ে গেছে? যে ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, সেই ঈশ্বরেরই উপহার নিতে মানুষ খুন করে ফেলছে? জঙ্গিবাদীদের মাথার তার এমনই ছেঁড়া থাকে।
তা জায়নবাদীরা ইহুদি হতে পারে, খ্রিষ্টানও হতে পারে। ইহুদিবিদ্বেষ ও জায়নবিদ্বেষ এক না। আমাদের দেশের মানুষ দুটিই গুলিয়ে ফেলে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক ইহুদিও জায়োনিস্টদের দেখতে পারে না। যেমন লেখক ও ইন্টারন্যাশনাল স্পিকার মিকো পেলেড একজন ইসরায়েলি, যাঁর জন্ম কট্টরপন্থী এক জায়নিস্ট পরিবারে। ওর বাবা ইসরায়েলি জেনারেল ছিলেন, ষাটের দশকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ওর দাদা ইসরায়েল সৃষ্টির অন্যতম কারিগর ছিল (ওদের ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ সাইন করা ব্যক্তি)।
বুঝতেই পারছেন, মিকো সহিহ ইসরায়েলি নয়, বলার কোনো সুযোগই নেই। তা ওনার আপন ভাগনি ১৮ বছর বয়সে এক ফিলিস্তিনি মেয়ের আত্মঘাতী হামলার শিকারে মারা যায়। যেহেতু শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, তাই তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে ভাবতে বাধ্য করে, কেন একটি ১৮ বছরের তরুণী আরেকটি ১৮ বছর বয়সী তরুণীর প্রাণের শত্রু হয়ে যাবে? কী ঘটেছে তাঁর সঙ্গে?
এই সাধারণ একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি সামান্য পড়াশোনা করেন। এবং এর ফল হচ্ছে, আজ ইসরায়েল তাঁর প্রাণের শত্রু হয়ে গেছে। নিজের দেশে তিনি দেশদ্রোহী। কারণ, তিনি এখন বিশ্বব্যাপী বলে বেড়ান, ইসরায়েল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র! ওনার লেখা একটি বই পড়তে পারেন, The General’s Son: The Journey of an Israeli in Palestine.
আরেকজন ইসরায়েলির নাম নিতে পারি, ইলান পাপ্পে। তিনি একজন ইতিহাসবিদ, যিনি অক্সফোর্ডে গিয়েছিলেন ইসরায়েলি ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করতে এবং গবেষণা করতে গিয়ে ইসরায়েলের ইতিহাস জেনে ফেলেন। সত্য জেনে ফেললে একজন আদর্শ বিবেকবান মানুষ যা করে, তিনিও সেটিই করলেন। আজ পর্যন্ত তিনি নিজেও ইসরায়েলি হয়েও ইসরায়েলকে ঘৃণা করেন।
যে দুজনের নাম বললাম, ওনারা দুজনই কট্টর জায়নবাদী ইহুদি পরিবারে জন্মে ইসরায়েলেই বেড়ে উঠেছেন, এবং আজও ইহুদি আছেন। তারপরও ওনারা ইসরায়েলকে দেখতে পারেন না।
এমন সংখ্যা প্রচুর আছে।
আর এদিকে আমি সেদিন শুনি, বাঙালি নাকি জানেই না ইসরায়েলকে কেন বিরোধিতা করতে হবে! তাই ভাবলাম, কিছু ফ্যাক্ট তুলে ধরা যাক, দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে ভেরিফাই করে নেবেন, যদি ভুল হয়ে থাকে কান ধরে উঠবস করব।
আমি আমার লেখালেখিতে এমন ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে থাকি; কারণ আমি জানি, আমি আউলফাউল আবেগতাড়িত লেখা লিখি না।
ইসরায়েল নিয়ে কিছু কথা বলতে গেলেই একদল লোকে বলতে শুরু করবে ‘আপনি তাহলে হামাসের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন?’
আপনাদের বলে রাখি, এইটা বহু পুরোনো টেকনিক এবং এখানেই বেশির ভাগ মানুষ ধরা খায়। শুরু হয়ে যায় হামাস ভালো না মন্দ এই বিতর্ক; এবং এর ফলে মূল যে বিষয়টা, ইসরায়েলের দখলদারত্ব, সেটি পাশে পড়ে থাকে।
তাই শুরুতেই বলে দেবেন, ‘না, আমি হামাসের সমর্থক না। ইনফ্যাক্ট, ইসলামে ইনোসেন্ট সিভিলিয়ান হত্যাকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, কাজেই হামাসের হাতে নিহত হওয়া মানুষ যদি ইসরায়েলিও হয়, এতে সমর্থন করার কিছু নেই; কিন্তু তার অর্থ এই না যে ইসরায়েল ভালো হয়ে গেল এবং ওদের সমর্থন করতে হবে। তা আমি তো হামাসকে তিরস্কার করলাম, তা বাবাজি, তুমি কি ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে তিরস্কার করছ?’
এখানে ওদের মাথা গুলিয়ে যাবে
কারণ ওরা আশা করে না হামাসকে আমি তিরস্কার করব। মুখস্থ স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসছিল তর্ক করতে, প্রথমেই ধরা খেয়ে গেল। এখন আসবে নিজের দ্বিতীয় ও শেষ অবলম্বন নিয়ে আক্রমণ করতে।
‘ইসরায়েল নিজেকে রক্ষা করতে যা করার তা–ই করেছে। (They have the right to defend themselves.)’
এবার ওদের আরেকটা মার দিই চলেন। স্বীকার করে নিই ‘অবশ্যই! প্রতে৵ক মানুষেরই নিজেকে ডিফেন্ড করার অধিকার আছে। সেটি ইসরায়েল হলেও ঠিক আছে।’
এখন দেখবেন, ডুবন্ত মানুষের মতন হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কারণ, দুইটা অস্ত্র নিয়ে আসছিল আক্রমণ করতে, দুটিতেই আনএক্সপেক্টেড জবাব পেয়ে গেছে। লড়ার আর কোনো ভ্যালিড অস্ত্র নেই। এখন ওদের মুখের ওপর নিজের অস্ত্র ছুড়ে মারবেন; এবং সেটি হচ্ছে ফ্যাক্টস। একদম প্রমাণিত সত্য ঘটনা। দেখেন কী জবাব দেয়।
‘আপনি বলেছেন, নির্দোষ মানুষ মারা অন্যায়। আমি নিজে মানি অন্যায়। এখন আপনি কি স্বীকার করবেন যে ইসরায়েলও নির্দোষ নাগরিক হত্যা করছে? হামাস ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি খুন করেছে (সেটিও রমজান মাসে মসজিদে আকসার ভেতরে হত্যা করা ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি ফিলিস্তিনি হত্যার বদলা নিতে) এর জবাবে ইসরায়েল ২৬ হাজার সিভিলিয়ান হত্যা করে ফেলল, যার বেশির ভাগই শিশু। এ ক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কী? আপনি দাবি করছেন ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তাহলে গাজাবাসীর আত্মরক্ষার অধিকার নেই?’
এই যে ইসরায়েলের সমর্থকেরা, যারা ইতিহাসের ‘ই’ও পড়েনি; এদের ধারণা, ফিলিস্তিনিরা এমনিতেই, শখে। মন চায় তাই ইসরায়েলি হত্যা করে। ইসরায়েল কিছুই করে না, ওদের কোনো দোষই নেই।
আসেন এদের কিছু ইতিহাস শেখাই।
এবং সেই সঙ্গে আপনাদের বলি, একবার শুধু নিজেকে ওই অঞ্চলে ওই মানুষদের মাঝখানে বসিয়ে কল্পনা করুন।
ইসরায়েল যখন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে, সে সময়েও ওদের গাজা উপত্যকা দেওয়া হয়নি। আজও ইউনাইটেড নেশনস ওয়েস্ট ব্যাংক (পশ্চিম তীর) এবং গাজাকে ইসরায়েলের ‘অকুপাইড টেরিটরি’বা দখলকৃত অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করে। কিন্তু ওই উল্লেখ করা পর্যন্তই। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা ওদের নেই।
ইতিহাস বলে একটা সময়ে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল শতকরা তিন ভাগের মতন। ইসরায়েলিরা আল্লাহর নির্দেশেই (ওদের ধর্মমতে) বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকত; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওরা দলে দলে ফিলিস্তিন অঞ্চলে আসতে শুরু করে। তখন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলকে ৫৫ শতাংশ অঞ্চল দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের দেওয়া হয় মাত্র ৪৫ শতাংশ অঞ্চল। যদিও জনসংখ্যায় ইসরায়েলিদের চাইতে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি; এবং তারচেয়ে বড় কথা, এলাকাটি ফিলিস্তিনি জনসাধারণের চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছিল। রোহিঙ্গারা যদি মিয়ানমার থেকে আপনার বাড়িতে এসে দখল নিতে চায়, আপনি কেনই–বা হাসিমুখে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাবেন? ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সেটিই ঘটল।
ইসরায়েল শুরু থেকেই জমি দখলে মন দেয়। এবং এর জন্য নৃশংসতম কাজ করতেও ওদের হাত কাঁপেনি। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, কিছুদিন আগেই হিটলারের অত্যাচারে নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠী নিজেরাই তখন নাৎসি জার্মানদের আচরণ শুরু করে। ওদের নৃশংসতার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল যাতে বাকিরা ভয়েই এলাকা ত্যাগ করে।
এর ফলে লাখের ওপর ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আবার জমি দখল শুরু করে, সিক্স ডে ওয়ারে ওরা পশ্চিম তীর বা ওয়েস্ট ব্যাংককে দখলে নেয়; এবং এ সময়েই ওরা জেরুজালেম দখল করে ফেলে। ইউএন ঘোষণা করেছিল, জেরুজালেম নিরপেক্ষ অঞ্চল থাকবে, না মুসলিম, না ইহুদি না খ্রিষ্টানের একক আধিপত৵ থাকবে এই অঞ্চলে; কিন্তু ইসরায়েল সেটিরও তোয়াক্কা না করে এই পবিত্র শহরটিকে নিজের মুঠোবন্দি করে নেয়।
ব্যস, শুরু হয়ে গেল ইসরায়েলের বর্বরতা।
’৬৭–তে গাজার সেই ছোট্ট অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখ, আজ দুই মিলিয়নের বেশি। এটুকু অঞ্চলে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের বসতি মানে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে একে পরিণত করা।
শুধু তা–ই নয়, ইসরায়েলের হাতেই ওদের ইলেক্ট্রিসিটি, পানি, খাদ্য, জীবিকা, এমনকি বাড়িঘর নির্মাণের অধিকারও ন্যস্ত। ইসরায়েল চাইলে কেউ সমুদ্রে মাছ শিকারের লাইসেন্স পাবে, নাহলে বেকার বসে থাকতে হবে। ইসরায়েল চাইলে কেউ বাড়ি নির্মাণ করতে পারবে, নাহলে মাথার ওপর ছাদহীন থাকতে হবে। ওরা চাইলে আপনার বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছাবে, নাহলে না খেয়ে মরেন, কিছুই আসে যায় না। আপনার মায়ের চিকিৎসা প্রয়োজন, আপনার শিশু না খেয়ে আছে, আপনার কিছুই করার নেই। কারণ, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে ইসরায়েল।
অর্ধেক জনসংখ্যাই বেকার। আপনি স্থানীয় নাগরিক, আপনি আপনার এলাকার সমুদ্রে মাছ শিকারের লাইসেন্স পাচ্ছেন না, অথচ ইউরোপ আমেরিকা থেকে আগত নব্য ইসরায়েলিরা পারমিট পাচ্ছে। আপনার চোখের সামনে ট্রলারভর্তি মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি ছিপ ফেলেন, আপনাকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করবে।
আপনার বাপ–দাদার ভিটা দখল করে সেখানে চাষবাস করছেন।
আপনাকে আপনারই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ, বাড়ি দখল করাটা ওদের দৃষ্টিতে ধর্মীয় লড়াই। ঈশ্বর এই এলাকা ওদের দিয়েছেন, ওরা সেটা পুনরুদ্ধার করছে।
আপনি দিনের পরদিন হোমলেস। মাথার ওপর ছাদ নেই বা কারোর বাড়িতে আশ্রিত। যদি ‘অবৈধভাবে’ (অ্যাপ্লাই করার বছরখানেক পরেও যদি দেখেন অ্যাপ্রুভ হয়নি) বাড়ি নির্মাণ করে ফেলেন, ওরা এসে সেই বাড়ি গুঁড়িয়ে দেবে।
আপনি বিচার নিয়ে কার কাছে যাবেন? আমেরিকা? সে নাক সিঁটকে বলবে, ‘বৈধ বাড়ি নির্মাণ করলে ইসরায়েল তো ভাঙবেই। এখানে আমাদের কী করার আছে?
‘কিন্তু আমাদের অ্যাপ্লিকেশন ওরা ছুঁয়েও দেখে না।’
‘দাপ্তরিক কাজ একটু দেরিতে হবেই। আপনাদের ধৈর্য ধরা শিখতে হবে।’
রসিকতা ভাই, অতি নির্মম রসিকতা চলছে ওদের সাথে।
আপনি জানেন, গত ৩০–৪০ বছর ধরে পয়োনিষ্কাশনের লাইনের কোনো মেরামত করা হয়নি; কারণ, ইসরায়েল ওটা নিয়ন্ত্রণ করে। ওদের ইচ্ছাই নেই ওটা মেরামতের।
ইউরোপ আমেরিকায় একটা কুকুরের জীবনও ওদের চেয়ে আরামদায়ক হয়ে থাকে।
গাজার চারদিকে আকাশছোঁয়া উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপরে কাঁটাতারের বেড়া। ফটক দিয়ে বাইরে কাউকে বেরোতে হলে ইসরায়েলের অনুমতি নেওয়া লাগে। অনুমতি পেলে বেরোতে পারবেন, না হলে বন্দি। ওদের কারোরই কোন পাসপোর্ট নেই। ওদের নিজেদের কোনো রাষ্ট্র নেই। ওদের কোনো চাকরি নেই।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ফিলিস্তিনিরা (গাজা ও পশ্চিম তীর) সহ্য করতে না পেরে আন্দোলনে নামে। ওদের অস্ত্র একটাই, পাথর। ইসরায়েলও জবাব দেয় বুলেট দিয়ে। এদিক থেকে পাথর যায়, তো ওদিক থেকে মেশিনগান ছোটে। আশির দশকে ইসরায়েল ‘আইন পাস করে’ যেকোনো ফিলিস্তিনি শিশুকে পাথর ছুড়তে দেখলে ওদের হাত ভেঙে দিতে হবে। এটা ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল। আর বড় কেউ হলে তো সরাসরি গুলি।
আপনি যদি বলেন ‘ওদের পাথর ছোড়ার দরকার কি?’ তাহলে বলব, ‘আপনি নিশ্চই মজা করছেন। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হলো কেন? আমার তোমার রক্ত রক্ত, আর ওদের রক্ত পানি? ওদের অধিকার নাই স্বাধীনভাবে বাঁচার? প্রায় সাত দশক হলো, আর কত?’
আমাকে জবাব দিতে হবে না, এখন আপনি একটু নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ইসরায়েলের যেমন আত্মরক্ষার অধিকার আছে, দুনিয়ার সব দেশের সব জাতিরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে, ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকারের বেলায় আপনি কেন হাত কচলান? আর কত নির্যাতন সহ্য করবে? আর কত রক্ত দেবে? দিনের পর দিন পরিবারের পর পরিবার নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ওরা কত দিন মুখে আঙুল চেপে রাখবে? আপনাকে নিজের সন্তানকে কবর দিতে হয়েছে? ওদের ঘরে ঘরে এ ঘটনা ঘটে। এই যে সাম্প্রতিক হামলা চলছে, কত হাজার শিশু মারা গেছে জানেন?
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সাপোর্টার আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি ধরে রাখতে হলে ওর একটা বিশ্বস্ত মিত্র দরকার, ইসরায়েল সেটা। সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একবার গাজাকে বলেছিলেন ‘এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ছাদহীন কারাগার।’
নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি নিজেই এপারথাইড রেজিমের শিকার ছিলেন, তিনি ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি দেখে বলেছিলেন ‘এদের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ। এটিই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়!’
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন ‘আমি সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদের সঙ্গে মেলালে বলব, ফিলিস্তিনের অবস্থা অনেক খারাপ।’
সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত বর্ণবাদের একটি ছিল। কালোদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা, আলাদা রাস্তা, আলাদা যানবাহন, চাকরি, স্কুল ইত্যাদি ছিল, কিন্তু সাদারা ওদের পশু–পাখির মতন খুন করত না। ওদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিত না। মূল পার্থক্য ছিল এই যে কালোদের নিজেদের এলাকায় স্বাধীনতা ছিল। গাজাবাসীদের নিজেদের শহরের ভেতরেই স্বাধীনতা নেই।
সেই সাউথ আফ্রিকা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আদালতে টেনে নিয়ে গেছে। গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। ওরা নিজেরা একসময় এপারথাইড স্টেট ছিল, ওরা তাই ইসরায়েলের এই আচরণ মেনে নিতে পারছে না। পুরোনো পাপের প্রায়শ্চিত্যও বলা যায়।
তবে সাউথ আফ্রিকানরা স্থানীয় কালোদের ঘৃণা করলেও নিশ্চিহ্ন করতে চায়নি। ইজরায়েলের টার্গেটই তো ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
আপনি বলতেই পারেন, সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন?
উত্তরটাও সহজ, কারণ ইসরায়েলই চাচ্ছে না সমস্যার সমাধান। কারণ, সমস্যার সমাধান ইসরায়েলের কাছেও নেই।
ওয়ান স্টেট সলিউশন ওরা মানবে না। কারণ, স্থানীয় ফিলিস্তিনির সংখ্যা ওদের চেয়ে বেশি। ‘ডেমোক্রেসি’ হলে ভোটে ওরা জিতবে না। তাই এই রিস্ক ওরা নেবে না।
টু স্টেট সলিউশন ইসরায়েলই মানছে না। কারণ, ওদের আরও ল্যান্ড চাই, পুরো এলাকাটা চাই। সেটিই ওরা করছে। মাত্র ৫৫ শতাংশ ল্যান্ড দিয়ে ওদের চলবে কীভাবে?
তাহলে সমাধান কী?
জি, ফিলিস্তিনিদের একেবারে শেষ করে ফেলা; কিন্তু ২২ লাখ মানুষকে এক ঝটকায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথাটা ভদ্রসমাজে বলা সম্ভবও না। ঠিক এই কারণেই আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা বিশ্বমাতবরদের কারোর কাছেই কোনো সমাধান নেই।
এই যে কথাগুলো বললাম, এগুলো সবই ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট। চেক করেন, তারপরে আমার ভুল খোঁজার চেষ্টা করেন। পাবেন না। তবে লাভ একটা হবে, কিছুটা পড়াশোনা হবে। সঠিক তথ্য জানার পরে ইসরায়েলকে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সাপোর্ট করতে পারে না। সম্ভব না।
*লেখক: মঞ্জুর চৌধুরী, ডালাস, টেক্সাস, ইউএসএ