মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৩
লন্ডন থেকে মরক্কো আসার আগে বন্ধু তানভীর মরক্কোর একজন ট্যাক্সিচালকের ফোন নম্বর দিয়েছিল, যাতে আমি সহজেই মারাকাশ থেকে আগাদির শহরে যেতে পারি। আগাদির হচ্ছে মরক্কোর পর্যটন শহর। অনেকটা কক্সবাজারের মতো। ফোন করলাম ট্যাক্সিচালককে। সে বলল, ১ হাজার ৭০০ দিরহাম লাগবে। প্রায় ২০ হাজার টাকা। ফোন দিলাম মারাকাশ শহরের যে ফ্ল্যাটে উঠেছি, তার মালিককে। তিনি তাঁর পরিচিত এক চালকের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, ১ হাজার ৫০০ দিরহাম লাগবে। আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি, তার পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোকের নাম আদিল। উঠতে-নামতে পরিচয়। তিনি জানালেন, যদি ৯০০ দিরহাম দিই, তাহলে তিনি নিজেই নিয়ে যাবেন।
আদিল পেশায় একজন আইটি কনসালট্যান্ট। তাঁর চাকরি ভালো লাগে না। চাকরি ছেড়ে এখন বেকার। স্ত্রী ভালো চাকরি করে। আদিলকে নিয়ে রওনা দিলাম আগাদিরের উদ্দেশে। তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটি বেশ সুন্দর। তিনি বললেন, আগাদির পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা লাগবে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটছে। খুব সুন্দর চার লেনের রাস্তা। অনেক দূরে একটি-দুটি বাড়ি দেখা যায়। লাল রঙের ভবন। মরুভূমির লাল বালু দিয়ে বানানো বলেই মারাকাশ শহরের অধিকাংশ ভবনই লাল। মরক্কোতে আছে অ্যাটলাস পর্বতমালা, সাহারা মরুভূমি। কোথাও কোথাও জলপাইয়ের বাগান, কমলার বাগান। সবুজ তেমন চোখে পড়ে না। চারদিকে ধু ধু প্রান্তর। দেখলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ভাবি, আমরা কত সৌভাগ্যবান। কী বিস্তৃত সবুজ আমাদের। গাছ, নদী, শস্যক্ষেত্র, পাখি। মরুভূমির বিস্তৃত প্রান্তর দেখে বউ বলল, আহারে, এখানে যদি কিছু জমি থাকত আমাদের; লাউ, শিমের ভালো ফলন হতো। যে যে রকম, তার চিন্তাও সে রকম।
আদিল অ্যারাবিয়ান মিউজিক ছেড়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁকে বললাম, তোমাদের দেশে আফ্রিকার অন্য দেশ থেকে লোক আসে না? আসে। আফ্রিকার অনেক গরিব দেশ আছে, যাদের কাছে মরক্কো অনেকটা আমেরিকার মতো। ওরা মরক্কো আসতে পারলে ভাবে আমেরিকায় এসেছে।
পথে একটা রেস্তোরাঁয় যাত্রাবিরতি হলো। রেস্তোরাঁর পাশেই ছোট একটা মসজিদ। আজ জুমাবার। আমি আর বউ গেলাম জুমা পড়তে। মসজিদে ঢুকেই দেখি, নামাজ প্রায় শেষের দিকে। শেষ সিজদায়। ইমামের সঙ্গে সংযুক্ত হলাম। তারপর রেস্তোরাঁয় বসে সবাই খেলাম। আদিল খুব বন্ধুবৎসল। হেল্পফুল। ছেলে কিছু কিনতে চাইলেই, তিনিও তার সঙ্গে দৌড় দেন। বলেন, আমিও যাই, বিদেশি ভেবে তোমাদের ঠকিয়ে ফেলতে পারে। আগাদির পৌঁছলাম বিকেল চারটায়। আদিল ব্যাগ টেনে ফ্ল্যাট পর্যন্ত নিয়ে এলেন। ফ্ল্যাটটা অনেক আধুনিক। ভাড়া প্রতিদিন সাড়ে সাত হাজার টাকা। আদিলকে ৯০০ দিরহামের পরিবর্তে ১ হাজার দিলাম। তিনি খুব খুশি। বললেন, দুই দিন পর তোমাদের কি আবার নিতে আসব?
এসো।
কোলাকুলি করে আদিল বিদায় নিলেন। এসেই চুলায় খিচুড়ি রাঁধতে শুরু করল আমার বউ। সঙ্গে ডিমভাজি। খাওয়াদাওয়া করে ৭টায় বেরোলাম। যে মরক্কোর গরম আবহাওয়া নিয়ে ভয়ে ছিলাম, আগাদির এসে দেখি সেখানে ঠান্ডা। মাত্র ২০ ডিগ্রি। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে প্রথম গেলাম ক্যাশ মেশিন থেকে টাকা তুলতে। টাকা তুলে গেলাম সেই বিখ্যাত বাজারে। সোকলিহার মার্কেট, যেখানে ৬ হাজার দোকান। গিয়ে তো থ। যেন ঢাকার বঙ্গবাজারে এসেছি। মানুষের ঠেলাঠেলি। চারদিকে বহু বর্ণিল দোকান। উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। দেশ-বিদেশের লোক। আমরা টুকটাক কেনাকাটা করলাম। তারপর স্ট্রিট ফুড খেলাম। মাছের বার্গার, মরক্কোর স্যুপ, পিৎজা—এসব। এক স্যুপ বিক্রেতা মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের খুব খাতির হয়ে গেল। ছেলে খুশিতে ১০ দিরহামের বদলে ২০ দিরহাম দিয়ে দিল। কিরে, প্রেমে পড়ে গেলে নাকি?
ছেলে লাজুক হাসে—না, বাবা।
মার্কেটে শপিং করা অবস্থায় দেখি, ছেলে তার এক মেয়েবন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞেস করছে—তোমার জন্য কী গিফট আনব? মেয়ে বলছে—কিছু লাগবে না, পারলে আগাদিরে আমার জন্য একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়ো। রুমে ফেরার পর, ওই মেয়ে, ভিডিওতে তার গিফট দেখতে চাইল। ছেলে যখন গিফট দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তাকে বললাম—বল, ফ্ল্যাট কিনেছি।
ছেলে তখন হেসে মেয়েকে বলল—দেখো, আমার বাবা কী বলে!
রুমে ফিরে আবার কিছু খেলাম। কাল যাব আগাদির সমুদ্রসৈকতে। এই শহরটা বেশ সুন্দর। ১৯৬০ সালে, এক বিরাট ভূমিকম্পে এই শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শহর পুনর্নির্মাণ করেছে তারা। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। এই আরকি। ওহ, আরেকটা কথা। মরক্কোর রাজার নাম মোহাম্মদ। সবাই আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, মোহাম্মদ। সবাই তখন আমার মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকায়। তখন নিজেকে রাজা রাজা লাগে। চলবে...
* আগামীকাল পড়ুন: মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৪
দূর পরবাসে ভ্রমণ, ভিডিও, ছবি, ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]