টিউলিপের দেশে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা: দ্বিতীয় পর্ব
এক ভুতুড়ে বাড়ি। শহরের সবচেয়ে নির্জন জায়গা সেটা। গা ছমছমে এক ভাব বাড়িজুড়ে। বাড়ির রান্নাঘরের জানালা খুললে বিশাল এক জমি, যেখানে বাড়ির মালিক দম্পতি ফল ও সবজির চাষ করেন। একসময় তাঁদের মনে হলো এখানে ফল আর সবজির সঙ্গে সঙ্গে ফুলের চারা রোপণ করলে কেমন হয়? ঘটনাটা পনেরো শতকের। আর যেই জায়গাটির নাম বলছি, সেটি সাউথ হল্যান্ড এর জগদ্বিখ্যাত গার্ডেন কিউকেনহফ। কিউকেনহফের ইংরেজি অর্থ হলো কিচেন। আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে এক দম্পতি তাঁদের কিচেনের সামনে যে ফুলের বাগান এর স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ সেটাই Keukenhof (কিউকেনহফ), যাকে বলা হয় Garden of Europe... এটা পুরো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ফুলের বাগান।
গল্পটি আমাদের ট্যুর গাইডের কাছ থেকে শোনা। খুব সুন্দর করে কিউকেনহফ সৃষ্টি ও সৃষ্টি–পরবর্তী ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে যাচ্ছিল সে। সময়টা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ভোরবেলার বাসে উঠেছি। গন্তব্য কিউকেনহফ গার্ডেনস। যাত্রাপথে গাইডের কাছ থেকে এই গার্ডেন সম্পর্কে দারুণ সব গল্প ও তথ্য জানতে পেরে যাওয়ার আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল আমাদের। গার্ডেনটি প্রতিবছর শুধু মার্চের মাঝামাঝি থেকে মের মাঝামাঝি পর্যন্ত খোলা থাকে। এ দুই মাস এদের ফুলের মৌসুম। প্রতিবছর সাত মিলিয়ন ফ্লাওয়ার বাল্ব লাগানো হয় এখানে। ৮০০ রকমের শুধু টিউলিপই আছে, এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন রকমের ড্যাফোডিল, লিলি, গোলাপ ইত্যাদি। এত বড় জায়গা যে সারা দিন ঘুরেও শেষ হবে না। বাগান পরিদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে নানা রকমের ইনডোর ফ্লাওয়ার শো, আর্টওয়ার্ক, এক্সিবিশন, ইভেন্টস বহু কিছুর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে প্রতিবছর এ সময় হাজারো পর্যটক এখানে আসেন।
আমি আগে ভাবতাম এ আর এমন কী? সব দেশেই সুন্দর সুন্দর গার্ডেন আছে। কেন কিউকেনহফেই যেতে হবে? ঘুরে আসার পর আমি বুঝেছি যাঁরা ফুল আর রং ভালোবাসেন, তাঁদের জীবনে একবার হলেও কেন কিউকেনহফে যাওয়া উচিত। কোনো জিনিস পৃথিবীতে এমনি এমনি বিখ্যাত হয় না। অসম্ভব সুন্দর বলেই তা জনপ্রিয়তা পায়। টিউলিপ ফুলের দৃশ্য আরও অনেক জায়গায় গেলেই হয়তো দেখতে পাওয়া সম্ভব, যেমন এপ্রিল মাসে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল, কানাডায়, ভারতের কাশ্মীরে, আমেরিকায়, এমনকি খোদ ইংল্যান্ডেই কয়েকটি সুন্দর টিউলিপ ফিল্ড আছে, যা দেখে হল্যান্ডের ফ্লাওয়ার ফিল্ড না দেখার দুঃখ পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কিউকেনহফ গার্ডেনসের কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত আর কোথাও তৈরি হয়নি। এটার জন্য আপনাকে হল্যান্ডেই আসতে হবে।
হল্যান্ডের আরেকটি বিখ্যাত জিনিস হলো উইন্ড মিল। আমাদের এবারের ট্রিপে আমরা Zaanse Schans নামের একটি ছোট্ট একটি গ্রামে গিয়েছিলাম উইন্ড মিল দেখার জন্য। গ্রামটি ভীষণ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে। তিনটি সবুজরঙা উইন্ড মিল আছে এখানে। সেই সঙ্গে গ্রাম্য ঘরবাড়ি, গাছপালার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু হ্রদ, গ্রামের মার্কেট ও বেশ কিছু খাবারের দোকান। সেই সঙ্গে রয়েছে শত বছর আগেকার ডাচ লোকেরা যে কাঠের জুতো পরত সেগুলোর একটি মিউজিয়াম। জুতাগুলো অদ্ভুত রকমের।
শোপিস হিসেবে ইন্টারেস্টিং সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামের যত দোকানপাট আছে সব কটিতে ওই জুতা কেনাবেচা চলছিল আর পর্যটকেরা দেদার সেগুলো কিনে কিনে নিজেদের ব্যাগ বোঝাই করে যাচ্ছিল। সবার মতো আমরাও কিছু কেনাকাটা করলাম। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে এখানকার চিজ মেকিং ফ্যাক্টরি দর্শন। কীভাবে চিজ বানানো হয়, তা জানার অভিজ্ঞতা দারুণ ছিল। পুরো ফ্যাক্টরি চিজের সুগন্ধে ম–ম করছিল। এক শ রকমের চিজ দেখে আর অসাধারণ গন্ধে লোভ সামলানো দায়। তাই কিনব না কিনব না করেও কিছু কিনে ফেলেছিলাম।
পরের দিনে আমরা ক্যানাল ক্রুজে করে আমস্টারডাম শহর ঘুরব ঠিক করেছিলাম। অনেক নাম শুনেছি।
যারা এই শহরে ঘুরে গেছে সবাই বলেছে ক্যানাল ক্রুজে চড়তে। পানির মধ্যে দিয়ে শহর দেখার মজাই আলাদা। আমরা ইচ্ছে করে শেষ বিকেল বেলারটা নিয়েছিলাম। দুই ঘণ্টার ক্রুজে শহরের শেষ বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের শুরু সব একসঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এই পরিকল্পনা ছিল। এটি একদম সিটির প্রাণকেন্দ্র দিয়ে পার হয়। কাজেই রাতের আলোঝলমলে শহর দেখতে দারুণ লাগবে মনে হয়েছিল। লেগেও ছিল তা–ই।
আরেকটি জিনিসটির জন্য হল্যান্ড পরিচিত, তা হলো এখানকার রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট। আমাদের সঙ্গে চার বছরের কন্যা আছে, কাজেই ওপথে পা বাড়ানো মুশকিল। কিন্তু যারা নব্য বিবাহিত, মধুচন্দ্রিমায় এসেছে তাদের তো পোয়াবারো। ব্যাচেলর, সিঙ্গেল, যাঁরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্যও এন্টারটেইনিং, সন্দেহ নেই। আমাদের হোটেলে এক আমেরিকান দম্পতি তাঁদের মা এবং এক বছরের মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। তাঁরা জানালেন তাঁরা মা, মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই রেডলাইট ডিস্ট্রিক্ট ঘুরে এসেছে। ওদের বাবু প্র্যামে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল তাই ওদের কোনো অসুবিধা হয়নি। আর মা খুবই আধুনিক। মায়ের সঙ্গে এসব জায়গা ঘুরতে তাদের কোনো অস্বস্তি নেই। নারী খুবই অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল এত জনপ্রিয় প্লেস, তোমরা কেন যাচ্ছি না? আমি হালকা হেসে উত্তর দিলাম এবার সময় হবে না, আমরা পরে যখন আবার হল্যান্ড আসব তখন ওখানে যাব। আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য ছিল আমস্টারডাম লুক আউট।
সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার থেকে পুরো শহর এবং সূর্যাস্ত দেখা। সূর্যাস্ত দেখার যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর পছন্দের কাজ...আমরাও ব্যতিক্রম নই। জীবনে অনেকবার এই অপরূপ দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু এবারেরটা একটু অন্য রকম ছিল। মুগ্ধতায় অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।
কিছু স্মৃতি খুব গভীরভাবে মনে গেঁথে থাকে। নেদারল্যান্ডসের এই ছোট্ট ট্রিপ মনে সেভাবে জায়গা করে নিয়েছে। যদি আর কখনো যাওয়া হয় তখন হয়তো আরও অনেক কিছু দেখব, জানব, উপভোগ করব। কিন্তু আমি নিশ্চিত, প্রথমবারের মতো আবেগ আর কখনোই ফিরে আসবে না। কিছু অনুভূতি জীবনে একবারই হয়। এবারের ভ্রমণটি ঠিক যেন সে রকম। (শেষ)
দূর পরবাস-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]