টিউলিপের দেশে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা: প্রথম পর্ব
নেদারল্যান্ডসে পা রাখার প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে করুণ অভিজ্ঞতা হলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু পারছি না। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এবং আমার বর দুজনেই বাক্শক্তিরহিত অবস্থায় আছি। আমার চার বছরের মেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে একসময় বাংলা–ইংরেজির মিশ্রণে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠল—আমরা কি আজ পুরো দিন এভাবেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব? হোটেলে যাব না? আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে উত্তর দিলাম, জানি না।
ঘটনা হলো, আমার স্যুটকেস হারিয়ে গেছে। ঠিক হারিয়ে গেছে তা না, ওটা আমার বর ভুল করে লোকাল একটি বাসে রেখে নেমে পড়েছে। সেই স্যুটকেসের ওপরে আমাদের নাম–ঠিকানা কিছুই লেখা নেই।
কাজেই ওটা যে ফিরে পাব, সেই আশাও করা সম্ভব না। ছোট ছোট দুটি হ্যান্ড লাগেজ এবং একটি মিনি স্যুটকেস নিয়ে আমরা আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে বসে অপেক্ষা করছিলাম। বুকিং করা হোটেল থেকে গাড়ি আসবে, আমরা সেই গাড়িতে যাব। হঠাৎ আমার মেয়ে স্বচ্ছ কাচের দরজা দিয়ে বাইরে একটি বিশাল লম্বা লাল রঙের সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা একটি বাস দেখে উত্তেজিত হয়ে বায়না করল, সে এই বাসে চড়বে। লন্ডনে আমরা এত লম্বা বাস কখনো দেখিনি। বাসটির আকৃতি যেমন মজার, দেখতেও দারুণ। ঝকঝকে পরিষ্কার। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারটি লাগল, তা হলো নিজেকে সে একমুহূর্তে ভাঁজ করছে, আবার পরমুহূর্তেই মেলে ধরছে। একদম সাগরের ঢেউয়ের মতো। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এই বাস আমাদের হোটেলের সামনে নামবে না। হোটেল থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে আমাদের নামিয়ে দেবে। বাকি পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে। মেয়ের ইচ্ছার দাম দিয়ে আমরা তাতে রাজি হয়ে সেই বাসে উঠে বসলাম।
নতুন দেশ, নতুন শহর দেখতে দেখতে যাচ্ছি। বেশ ভালো লাগছে। একটু পর আমার বর বলল, এখানে বাস মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামে। আমাদের তাড়াতাড়ি নামতে হবে। নামার সময় তুমি মেয়ের হাত ধরে নামাবে, আর আমি জিনিসপত্র নামাব। আমি মাথা নাড়লাম। যথাসময়ে বাস থামল এবং আমি তড়িঘড়ি করে মেয়েকে কোলে নিয়ে বাস থেকে নেমে দাঁড়ালাম। এই বাসগুলো এত দ্রুত চলে যে আমরা নেমে একে ওপরের দিকে তাকানোর আগেই মনে হলো, যেন মুহূর্তের মধ্যে বাস আমাদের রেখে হাওয়া হয়ে গেল। মেয়ের বাবাকে বললাম, এবার অনেকখানি হাঁটা আছে, তুমি একটা ব্যাগ কাঁধে নাও, একটা ব্যাগ হাতে নাও, আর আরেক হাতে মেয়ের হাত ধরো। আর আমার স্যুটকেস আমাকে দাও, ওটা আমি টেনে নিয়ে যাব। আমার কথা শুনে সে চমকে তাকাল। তারপর আর্তনাদের মতো করে বলল, হায় হায় স্যুটকেস তো বাস থেকে নামাতে মনে নেই।
আমার হতভম্ব ভাব কাটার পর বললাম, আমার সব কিছু ওই সুটকেসে। আমার কী হবে এখন?
জামাকাপড় থেকে শুরু করে আমার ঘড়ি, চশমা—কাজের সবকিছু ওখানে। আমি চলব কী করে? মেয়ের বাবা নানাভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। লাভ হলো না। আমি অবুঝের মতো জেদ ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। বললাম, হয় আমার স্যুটকেস ফেরত এনে দাও, নয় এখনই ইংল্যান্ড ব্যাক করো।
এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ পেছন থেকে একটি পুরুষের গলা শুনতে পেলাম। তিনি বললেন, থ্যাঙ্ক গড, তোমরা এখনো এখানে আছ। আমি ভেবেছিলাম, তোমাদের পাব না। তাকিয়ে দেখি, ২৭–২৮ বছরের এক যুবক, আর তাঁর হাতে আমার স্যুটকেস। তিনি যা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, তিনি বাসে আমার বরের পাশে বসেছিলেন। তিনি খেয়াল করেছেন, আমার বর স্যুটকেস ছাড়া নেমে যাচ্ছে। তিনি পেছন থেকে ডাক দিয়েছেন; কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। তখন তিনি স্যুটকেসটি নিয়ে পরের স্টপেজে নেমেছেন। সেখানে ১৫ মিনিট পরপর বাস যাওয়া–আসা করে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুক্ষণ পরবর্তী ফিরতি বাসের জন্য অপেক্ষা করেছেন, যাতে সেটিতে চড়ে এই স্টপেজে আবার আসতে পারেন। একবার তাঁর মনে হয়েছিল, আমরা হয়তো এতক্ষণ অপেক্ষা করব না...তারপর তিনি একটি চান্স নিয়েছেন। তিনি খুশি যে আমরা এতক্ষণ ধরে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, না হলে তার পক্ষে আমাদের খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না। কারণ, আমরা কোন হোটেলে উঠছি সেটি তিনি জানেন না।
খুশি এবং কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ছলছল করে উঠল। কে বলে দুনিয়াতে নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করার লোক বিলুপ্ত হয়ে গেছে? ভালো মানুষ, শুদ্ধ মানুষ এখনো প্রচুর আছেন...যাঁরা কোনো লাভের আশা ছাড়াই অন্য মানুষের জন্য করেন, ভাবেন। ভিনদেশে বেড়াতে গিয়ে প্রথমেই এ রকম অসাধারণ একজনের দেখা পেয়ে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠল। এ আনন্দ একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই হল্যান্ড দেশটিকে ও দেশের মানুষদের ভালোবেসে ফেললাম। যুবককে বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা হোটেলে চেক–ইন করলাম।
নেদারল্যান্ডসে দেখার মতো বহুকিছু আছে। তবে আমাদের এবারের ট্রিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল রংবেরঙের ফুলের মাঠ দর্শন। বছরের শুধু কয়েক মাস নেদারল্যান্ডসে দিগন্তবিস্তৃত এই রঙের মেলা দেখা যায়।
আমরা সেই দিনক্ষণ হিসাব করে এসেছি। কিউকেনহফ গার্ডেন নামের যে বিখ্যাত বাগান এদেশে আছে, সেটির জন্য আমরা পুরো একটি দিন আলাদা করে রেখেছি। ওটায় আমরা আগামীকাল যাব। আপাতত প্ল্যান হচ্ছে, গ্রামের ফুলের মাঠগুলো দেখা। নেদারল্যান্ডস টিউলিপের জন্য জনপ্রিয়, এ কথা সবারই জানা। তবে এ সময় টিউলিপ ছাড়াও হরেক রকম ও বাহারের ফুলের চাদর এদেশের মাঠ বিছানো হয়েছে। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার পর আমরা আর সময় নষ্ট করলাম না। রিসিপশন থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য জোগাড় করে অন্য আরেক টাউনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
আমাদের হোটেল ছিল আমস্টার্ডাম শহরে। সেখান থেকে বাসে করে আমরা লিসি (Lisse)–তে পৌছালাম। ইচ্ছা করলে ট্রেনে করেও সেখানে যাওয়া যায়...আমরা বাস প্রেফার করেছিলাম। বাস আমাদের একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল। সেখানে আমরা একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। ট্যাক্সিওয়ালা জানালেন, প্রতি ঘণ্টায় তিনি ৪০ ইউরো করে নেবেন। এর বিনিময়ে যতগুলো ফুলের মাঠ আছে সেগুলোতে এক এক করে আমাদের নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ করে থামাবেন, যাতে আমরা নেমে ছবি তুলতে পারি। আমাদের তখন এত দামাদামি করার মতো অবস্থা নেই। তাই এতেই রাজি হয়ে গেলাম।
Flower field–গুলোতে নামার অভিজ্ঞতা লিখে ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়, তাই সে চেষ্টা করব না। এত রং জীবনে একসঙ্গে দেখিনি। কী সুন্দর! কী সুন্দর! একবার মনে হলো, ইশ এখানে যদি প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে পারতাম, বেশ হতো! চালক আমাদের মোট ছয়টি মাঠে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। প্রথম তিনটিতে আমরা নেমে কিছুক্ষণ ছিলাম, ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু পরের তিনটিতে নামার সময় হয়নি। গাড়ির মধ্যে থেকেই তাড়াহুড়া করে বাইরের দৃশ্যের ছবি তুলেছি। দৌড়ে দৌড়ে একেকটি জায়গায় গেছি, কোনোরকমে মুঠোফোন টিপেছি, আবার দৌড়ে গাড়িতে এসে বসেছি। সঙ্গে ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেটি যে আরাম করে ব্যবহার করব, সেই অবকাশ ছিল না। মুঠোফোনের ছবিও ভালো হয়নি। তবু আফসোস নেই। ওপরওয়ালা যে চোখ দিয়েছেন, তার ব্যবহার যে যথাযথভাবে করতে পেরেছি, সেটিও কম কি? আর তা ছাড়া সব অপূর্ব জিনিস মানুষের বানানো যন্ত্র দিয়ে ধরা সম্ভবও নয়, তা সে যত আধুনিক আর শক্তিশালীই হোক না কেন। কিছু সৌন্দর্য এমন থাকে, যাকে সামনাসামনি দেখতে পারাই এক বিরাট প্রাপ্তি হয়ে রয় জীবনে। সে প্রাপ্তির সুখ তুচ্ছ করার মতো নয়। চলবে...
আগামীকাল পড়ুন ২য় পর্ব...
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]