এক কাপ কফির দাম, এক চুমুক নিঃসঙ্গতা

কফি

প্যারিস শহরে এক কাপ কফির দাম ৩ থেকে ৫ ইউরো। আবার কিছু ক্যাফেতে দাম ১০ ইউরো পর্যন্তও পৌঁছে যায়। টাকার অঙ্কে দেখলে দামটা হয়তো বেশি, কিন্তু জানেন কি, এই এক কাপ কফির ভেতরে যে এক চুমুক নিঃসঙ্গতা মিশে থাকে, তার মূল্য কোনো মুদ্রায় পরিমাপ করা যায় না।

সেই কফির প্রতিটি চুমুকে যে অভিবাসীর একাকিত্ব, না-পাওয়া আর নীরব কান্না লুকিয়ে থাকে, সেটা কেউ বোঝে না। এই শহরে বসে কফি খাওয়া যেন একরকম রেওয়াজ। কিন্তু প্রবাসজীবনে সেই রেওয়াজটা হয়ে ওঠে অভিনয়ের অংশ—যেখানে মুখে হাসি, হাতে কাপ আর ভেতরে অনেকখানি শূন্যতা।

প্যারিসের ক্যাফেগুলো অনেক সুন্দর। রাস্তায় বসে কফি খাওয়া, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখা—সব খুব সিনেমার মতো লাগে। কিন্তু আমি যখন একা একা বসে থাকি, চারপাশে যত হাসি দেখি, তত বেশি আমার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমি চোখের সামনে এক জোড়া হাত দেখেছি—প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরা। তাদের চুমুক, হাসি, গল্প...আর আমি? আমি শুধু এক কাপ কফি আর কিছু না-বলা কথা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি।

আরও পড়ুন

প্রবাসের ভিড়ে একলা আমি—

প্রতিদিন কাজ, ছবি তোলা, ক্লায়েন্টের রিকোয়েস্ট—সবকিছুই চলে নিয়মে। তবে সেই নিয়মের ফাঁকে একটু থেমে যখন কফির দোকানে ঢুকি, তখন যেন মুখোশ খুলে পড়ে যায়। চারপাশে সবাই কারও না কারও সঙ্গে এসেছে। আর আমি?

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আমি এসেছি নিজের নিঃসঙ্গতা নিয়ে, যা এক কাপ কফির পাশে বসে আরও বেশি করে অনুভব হয়। দেশ থেকে অনেকেই বলেন, তুমি তো প্যারিসে, নিশ্চয় খুব ভালো আছো! তাদের বোঝাতে পারি না—এই আলো ঝলমলে শহরে, একটা মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ হতে পারে। প্যারিসে কফির কাপ গরম থাকে, তবে মানুষের সম্পর্কগুলো অনেকটাই ঠান্ডা।

ছবিতে রং, জীবনে সাদা-কালো—

আমি ফটোগ্রাফার। আমার ক্যামেরায় ধরা পড়ে অনেক ভালোবাসার মুহূর্ত, হাসিমাখা মুখ, আলোর খেলা। তবে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমি জানি, আমার নিজের জীবনে সেই রংগুলো নেই। আমার ফ্রেমে প্রেম আছে, পরিবার আছে, বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু আমি নিজেই সেই ফ্রেমে নেই। আমি শুধু দেখে যাই, তুলে যাই, রেখে যাই—নিজেরটা রেখে আসি প্রতিবার। প্রবাসের জীবনে একটা কফির দোকান অনেক সময় আশ্রয় মনে হয়।

এক কাপ কফি মানে—একটু থামা, একটু নিশ্বাস নেওয়া, একটু নিজের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু সেই কাপটাতে শুধু কফি থাকে না, থাকে ভেতরে জমে থাকা শূন্যতা, স্মৃতি, না-পাওয়া আর অনেক না–বলা গল্প। প্যারিসে কফি খাওয়া একধরনের স্টাইল হতে পারে, কিন্তু আমাদের মতো প্রবাসীদের জন্য তা অনেক সময় চোখ ভেজানো অভ্যাস। এই শহরে এক কাপ কফির দাম হয়তো ৫ ইউরো, কিন্তু তার সঙ্গে ভেতরে গিলে ফেলা এক চুমুক নিঃসঙ্গতার দাম—তা শুধু হৃদয়ই বুঝতে পারে।