প্যারিসের চিঠি
প্রিয় বাংলাদেশ,
তোমাকে লিখছি প্যারিস শহরের একটি ছিমছাম, চুপচাপ বিকেল থেকে।
আকাশে হালকা রোদ, জানালার ওপারে পাখির ডাক নেই,
তবু ভেতরে একধরনের চাপা শূন্যতা, যেটা বোঝা যায় না ছবিতে, দেখা যায় না আলোয়, শুধু টের পাওয়া যায় হৃদয়ে।
তুমি কেমন আছ? কীভাবে আছ?
তোমার রাস্তাগুলো কি এখনো কোলাহলে ভরে থাকে?
ভিড়ভাট্টা, ট্রাফিক, রাস্তার পাশের চা-দোকান,
আর সেই বিকেলের কাকডাকা—সব এখনো কি আগের মতো?
তুমি তো জানো প্যারিসকে সবাই ‘প্রেমের শহর’ বলে,
কিন্তু প্রবাসীর চোখে এ শহর অনেক সময় এক বিষণ্ন ভালোবাসার শহর।
ট্রেনের ভিড়, ভাষার দূরত্ব, আর মুখভরা অনভ্যাস—
সব মিলিয়ে এখানে কেউ তেমন আপন হয় না।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে কফিশপ,
তবু চেনা মুখ নেই বলেই চা খাওয়াটা এখানে একা বসে থাকাকে বোঝায়।
তুমি জানো, আমি এখানে প্রতি সকালে চা খাই—
কিন্তু সেই নরম তুলতুলে ‘শুধু দুধ-দিয়া লাল চা’র স্বাদ খুঁজে পাই না।
তুমি নিশ্চয় ভাবো—আমি ইউরোপে, আমি ভালো আছি।
বন্ধুরা ভাবে, ‘ও এখন প্যারিসে থাকে, ভাগ্যবান!’
কিন্তু কেউ কি বোঝে, আমি প্রতিদিন কাজের পর ক্লান্ত হয়ে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি—এই আমি কি সেই আমি?
আমি কি স্বপ্নের প্যারিসে এসেছি,
নাকি নিজের স্বপ্নটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছি?
এখানে সবাই ব্যস্ত, সবাই ছুটছে,
কিন্তু কোথায় যাচ্ছে—কেউ জানে না।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
রাতের শহর ঝলমলে,
তবু প্রবাসীদের ঘরে আলো জ্বলে,
পথঘাট পেরিয়ে যারা বাসায় ফেরে ক্লান্ত চোখে,
তাদের মধ্যে কেউ একজন সাভার থেকে ফোন পেয়ে বলে—
‘টাকা পাঠাইছ?’
আরেকজন ভাবছে, মা হয়তো মিছেমিছি বলেছে ‘ভালো আছি’,
কারণ, তার চোখে অপারেশন লাগবে,
আর ছেলে ইউরোপে থাকলেও সংসারে টান পড়ে গেছে।
তুমি কি জানো বাংলাদেশ,
এখানে মাটি আলাদা, গন্ধ আলাদা,
তবু আমি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চোখ বন্ধ করলে দেখি—
ঢাকার গলির ধুলো, ছাদে শুকানো কাপড়, পাখির শব্দ, আর মায়ের ডাক।
আমার এখানে বন্ধু আছে, সহকর্মী আছে,
কিন্তু ‘পাশে এসে বসে চুপচাপ গল্প শোনাবে’—এমন মানুষ নেই।
কখনো কখনো মনে হয়,
এই শহরে আমি শুধু একটি চলন্ত ছায়া,
যার শুরু আছে, শেষ কোথায় জানে না।
তুমি জানতে চেয়েছিলে, ‘প্যারিস কেমন?’
আমি বলি প্যারিস সুন্দর প্যারিস সফল কিন্তু প্যারিস নিঃসঙ্গ।
তবু এখানেই আমি বাঁচি, এখানেই স্বপ্ন দেখি—
কারণ, আমার রুটির সঙ্গে একটুখানি দেশের স্বাদ থাকে,
আর মাঝে মাঝে চিঠির মতো করে তোমাকে লিখতে পারি,
এই শহরের অলিগলির কষ্ট, সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর না-বলা কথা।
তাই এই চিঠি শুধু শহরের নয়,
এটা একজন মানুষের, যিনি প্রিয় দেশটাকে খুব মিস করেন।