নভেম্বর ও ডিসেম্বরে নর্ডিক দেশগুলো অন্ধকারে আলো খোঁজে

নরডিক দেশগুলোর সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছেছবি: ট্রিপ সেভি

নর্ডিক দেশগুলো ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড। পৃথিবীর মানচিত্রে উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই দেশগুলো নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এক ভিন্ন বাস্তবতায় প্রবেশ করে। এই সময় প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের মন একসঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

অন্ধকার এখানে শুধু রাত নয়। নভেম্বর থেকে সূর্যের আলো দ্রুত কমে আসে। সুইডেন ও নরওয়ের বড় অংশে দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আলো থাকে। ফিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল ও নরওয়ের আর্কটিক এলাকায় সূর্য একেবারেই ওঠে না। এই দীর্ঘ অন্ধকার মানুষের শরীর ও মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

এই অন্ধকার মানুষকে ধীর করে দেয়। জীবনযাত্রা কম গতির হয়। পরিবার, ঘর ও ব্যক্তিগত সময়ের গুরুত্ব বাড়ে। বই পড়া, ঘরে রান্না, আলো জ্বালিয়ে গল্প করা এগুলো নর্ডিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি মানুষকে শেখায় থামতে।

আরও পড়ুন
কোনো নরডিক দেশের নাগরিক অন্য কোনো নরডিক দেশে বসবাস ও ভ্রমণ করতে পারে
ছবি: ডেনমার্ক এম্বাসি বাংলাদেশের ফেসবুক থেকে

একই সঙ্গে এই অন্ধকার বিপদেরও কারণ। ভিটামিন ডি–এর ঘাটতি, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি ও মনোযোগে হ্রাস দেখা যায়। রাস্তা পিচ্ছিল হয়। দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। অনেকের মধ্যে মৌসুমি বিষণ্নতা দেখা দেয়, যাকে এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয় এবং চিকিৎসা ও সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকে।

এই সময় বাইরে জীবন কমে আসে, কিন্তু ঘরের ভেতরের জীবন সমৃদ্ধ হয়। মানুষ কম কথা বলে, কিন্তু গভীরভাবে। মিডিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বাড়ে।

আলোচনায় আসে শীতকালীন বিষণ্নতা, আত্ম যত্ন ও সামাজিক সংযোগের গুরুত্ব।
এই সময় মানুষ নিজের ভেতরের জগতে ফিরে যায়। সম্পর্কগুলো গভীর হয়।

কর্মজীবনে চাপ তুলনামূলক কম থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে একধরনের নীরব সংলাপ তৈরি হয়। নর্ডিক সমাজে বিশ্বাস আছে, শীত মানুষকে শক্ত করে তোলে।

এখানকার নতুন প্রজন্ম মনে করে, শীতকাল গভীর সম্পর্কের জন্য উপযুক্ত সময়। কারণ, এই সময় মানুষ বাহ্যিক আনন্দ নয়, বরং মানসিক সংযোগ খোঁজে। সামার উচ্ছ্বাসের, শীত আন্তরিকতার। অনেক সম্পর্ক শীতে শুরু হয়ে সামারে পূর্ণতা পায়।

একই সঙ্গে একাকিত্ব বাড়ে। অভিবাসী ও নতুন আসা মানুষের জন্য এই সময় সবচেয়ে কঠিন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বিষণ্নতা ও কিছু ক্ষেত্রে আত্মহানির ঝুঁকি বাড়ে। তাই নর্ডিক দেশগুলোতে এই সময় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়।

এই বাস্তবতায় মানুষ কিছু বিষয় মেনে চলে। প্রতিদিন বাইরে কিছু সময় কাটানো, পর্যাপ্ত আলো ব্যবহার, ভিটামিন ডি গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা এবং সাউনা ও উষ্ণ পরিবেশে সময় কাটানো শীতকে সহনীয় করে তোলে। একই সঙ্গে মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে না নেওয়ার, দিনরাতের ঘুম এলোমেলো না করার, অতিরিক্ত মদ্যপান এড়িয়ে চলার এবং সমস্যাগুলো লুকিয়ে না রাখার।

এই সময় মানুষের মন দ্বৈত অনুভূতিতে থাকে। কেউ গভীর শান্তি অনুভব করে। কেউ আবার বিষণ্নতায় ভোগে। নর্ডিক সংস্কৃতিতে অনুভূতি প্রকাশ দুর্বলতা নয়, বরং সচেতনতা হিসেবে দেখা হয়। তাই মানসিক চাপ নিয়ে কথা বলা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।

ডিসেম্বরের লুসিয়া উৎসব আলো ও আশার প্রতীক। ক্রিসমাস পরিবারকেন্দ্রিক, শান্ত এবং আবেগী। নতুন বছরের বিদায়বেলায় আনন্দ আর বিষাদের মিশ্রণ থাকে; কারণ, একটি অধ্যায় শেষ হয়। নতুন বছরের প্রথম সকালে সবাই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, কারণ আগের রাতটি ছিল দীর্ঘ, আবেগপূর্ণ এবং সামাজিক।

এখানকার নতুন প্রজন্ম মনে করে, শীতকাল গভীর সম্পর্কের জন্য উপযুক্ত সময়। কারণ, এই সময় মানুষ বাহ্যিক আনন্দ নয়, বরং মানসিক সংযোগ খোঁজে। সামার উচ্ছ্বাসের, শীত আন্তরিকতার। অনেক সম্পর্ক শীতে শুরু হয়ে সামারে পূর্ণতা পায়।
নভেম্বর ও ডিসেম্বরেই দেখা যায় নর্দার্ন লাইট। আকাশের এই আলো মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, অন্ধকারের মধ্যেও সৌন্দর্য আছে। আইস হোটেল, স্কি আর বরফে ঢাকা বনভূমি এখানে শুধু পর্যটন নয়, বরং জীবনের অংশ।

সাউনা এখানে শুধু শরীর গরম করার জায়গা নয়। এটি মানসিক শুদ্ধতার স্থান। ক্যাফেতে বসে কফি আর নীরব কথোপকথন শীতের আত্মা। নাইটক্লাবগুলো এই সময়েও খোলা থাকে; কারণ, মানুষ আনন্দকে থামাতে চায় না।

ডিসেম্বরের লুসিয়া উৎসব আলো ও আশার প্রতীক। ক্রিসমাস পরিবারকেন্দ্রিক, শান্ত ও আবেগী। নতুন বছরের বিদায়বেলায় আনন্দ আর বিষাদের মিশ্রণ থাকে; কারণ, একটি অধ্যায় শেষ হয়। নতুন বছরের প্রথম সকালে সবাই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে; কারণ, আগের রাতটি ছিল দীর্ঘ, আবেগপূর্ণ ও সামাজিক।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নর্ডিক শীত মানুষকে পরীক্ষা করে। এই সময় টিকে থাকা শুধু শরীরের নয়, মনের শক্তির প্রশ্ন। যারা এই শীতকে বুঝতে শেখে, তারা জীবনের গভীর অর্থ আবিষ্কার করে। অন্ধকার এখানে শত্রু নয়। এটি আলোকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়।

এই কারণেই নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে নর্ডিক দেশগুলো শুধু ঠান্ডা নয়, বরং জীবনের এক গভীর পাঠ।

এই শীতকালেই নর্ডিক অঞ্চলে ঘটে এমন কিছু ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ডিসেম্বর মাসে স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শুধু একটি পুরস্কার বিতরণ নয়, বরং মানব সভ্যতার জ্ঞান, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ সম্মান উদ্‌যাপনের এক বিশাল উৎসব। বিশ্বজুড়ে নজর থাকে এই সময় নর্ডিক দেশগুলোর দিকে।

পাশাপাশি এই অঞ্চলের অসাধারণ অভিজ্ঞতাগুলো মানুষের কল্পনাকে স্পর্শ করে। বরফে নির্মিত আইস হোটেলে রাত কাটানো, নর্দার্ন লাইটের নিচে প্রিয় মানুষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, নিঃশব্দ তুষারাবৃত বনভূমিতে হাঁটা কিংবা ফিনল্যান্ডের সাউনা সংস্কৃতিতে শরীর ও মন উজাড় করে দেওয়া এসব অভিজ্ঞতা নর্ডিক দেশগুলোকে অনন্য করে তোলে।

প্রেমের স্বর্গ হিসেবেও নর্ডিক অঞ্চল আলাদা স্থান দখল করে আছে। সুইডেন ও ডেনমার্ক সম্পর্কের স্বাধীনতা ও সমতার জন্য পরিচিত, নরওয়ে ও আইসল্যান্ড প্রকৃতি আর একান্ততার কারণে প্রেমকে গভীর করে তোলে, আর ফিনল্যান্ডে নীরবতার মধ্যেই ভালোবাসা সবচেয়ে শক্তভাবে জন্ম নেয়। এখানকার নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে, ভালোবাসা মানে নাটক নয়, বরং পারস্পরিক সম্মান, নিরাপত্তা ও মানসিক আশ্রয়। এই সবকিছু মিলিয়েই নর্ডিক শীত বিশ্বকে শেখায়, কীভাবে অন্ধকার, জ্ঞান, উৎসব, প্রকৃতি ও প্রেম একসঙ্গে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন