বেকার গ্র্যাজুয়েট, অদক্ষ শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় দায়

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা আজ এক গভীর সংকটে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ দশমিক ৮৫ থেকে ৯ লাখ বিশ্ববিদ্যালয় পাস তরুণ–তরুণী বেকার এবং এই শ্রেণির বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো দেশে এখন প্রতি তিনজন বেকারের একজনই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত। এই চিত্র কেবল বেকারত্বের নয়, এটি আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রতিফলন।

গত দুই দশকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে অর্থনীতি, শিল্পায়ন ও শ্রমবাজারের চাহিদার কোনো সামঞ্জস্য তৈরি হয়নি। ফলস্বরূপ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন, অথচ তাঁরা না পারেন কারিগরি কাজ, না পারেন কৃষি বা উৎপাদনমুখী পেশা, না পারেন শ্রমনির্ভর বাস্তব কাজে যুক্ত হতে। তাঁরা কাগজে শিক্ষিত, কিন্তু বাস্তবে কর্মদক্ষতা ও জীবিকাযোগ্য দক্ষতাহীন।

দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। এটি ধীরে ধীরে নৈতিক ও সামাজিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। হতাশ শিক্ষিত তরুণদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতি, দালালি, চাঁদাবাজি, অবৈধ ব্যবসা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসে। সবাই নয়, কিন্তু ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা অনেককে সেই পথে ঠেলে দেয়। এটি ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।

চার দশকের বেশি সময় ধরে চারটি মহাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছি যে এই সংকটের সমাধান কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোতে নয়। এর মূল নিহিত ভিত্তিমূলক শিক্ষায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকেই যদি কারিগরি দক্ষতা, বিশ্লেষণী চিন্তা, সৃজনশীলতা ও বাস্তব সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা গড়ে তোলা না হয়, তবে উচ্চশিক্ষা শেষ পর্যন্ত ডিগ্রি উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়। এর সঙ্গে সমানভাবে জরুরি নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের সংযোজন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখায়, যেসব দেশ দক্ষতা ও নৈতিকতার সমন্বয় ঘটাতে পেরেছে, তারাই দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই পথই একমাত্র টেকসই পথ।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি অনিবার্য। আমাদের কি এত বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, নাকি আমাদের দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। বাস্তবতা হলো শক্তিশালী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, আধুনিক পলিটেকনিক ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনমুখী খাতে হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সংখ্যা চাহিদাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সরকারের উচিত, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন স্থগিত করে মানোন্নয়নে জোর দেওয়া, উচ্চশিক্ষাকে সরাসরি শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত করা, প্রতিটি ডিগ্রির সঙ্গে বাধ্যতামূলক স্কিল ও ইন্টার্নশিপ চালু করা এবং শিক্ষানীতির কেন্দ্রে ডিগ্রি নয়, দক্ষতাদর্শন প্রতিষ্ঠা করা।

আজকের বেকার গ্র্যাজুয়েটরা আগামী দিনের বড় সামাজিক ঝুঁকি, যদি এখনই দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। একটি রাষ্ট্র যদি তার শিক্ষিত তরুণদের সম্মানজনক কর্মসংস্থান দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে আগায়। অতএব প্রশ্নটি স্পষ্ট, আমরা কি ডিগ্রিধারী বেকার তৈরি করব, নাকি দক্ষ, নৈতিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে তুলব। এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

এই পরিবর্তন বাস্তবায়নে শিক্ষাব্যবস্থাকে সরাসরি কর্ম ও পেশার সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে সহজ শর্তে রাষ্ট্রীয় ঋণ প্রদান এবং সেই ঋণ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পরিশোধের একটি ঘূর্ণায়মান কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যাতে একই তহবিল পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার করা যায়। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুস্পষ্ট যোগাযোগ, দীর্ঘমেয়াদি কমিটমেন্ট এবং তাদের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বিদেশি বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট খাতে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা ও কর্মসংস্কৃতির প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং একই সঙ্গে দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট সব সরকারি কর্মকর্তার জন্য দুর্নীতিমুক্ততা নিশ্চিত করা কোনো বিকল্প নয়, এটি অবশ্যপালনীয় শর্ত। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থে একটি স্পষ্ট নীতিগত বার্তা প্রয়োজন। যদি কোনো দুষ্কৃতি গুরুতর অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি না হয়ে পালিয়ে যান এবং প্রমাণিতভাবে পরিবার বা নিকট আত্মীয়রা তাঁকে আশ্রয়, সহায়তা বা সম্পদ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখেন, তবে সেই দায়ভার তাঁদের ওপরও আইনানুগভাবে ন্যস্ত করা হবে। এর উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয়, বরং অপরাধের সামাজিক সহায়ক কাঠামো ভেঙে দেওয়া, যাতে কেউ আর রাষ্ট্রকে দুর্বল ভেবে অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়ার সাহস না পান। প্রকৃত শিক্ষা সংস্কার তখনই কার্যকর হবে, যখন তা একযোগে দক্ষতা, নৈতিকতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তন আনতে পারলে বাকি সব খাত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে বাধ্য হবে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন