দীপার বেড়ে ওঠা - দ্বিতীয় পর্ব
সময় যে কত দ্রুত যায়! এরই মাঝে দুই বছর পেরিয়ে গেছে। দীপা শেষ করেছে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট মাস্টার ডিগ্রি। এ প্রোগ্রামের শুরুর দিকে দীপা বেশ অস্বস্তি বোধ করত। এযাবৎকাল ও সব সময় দেখেছে, ক্লাসের সবাই সমবয়সী। কিন্তু এখানে সদ্য স্নাতক থেকে বিভিন্ন বয়সী অভিজ্ঞ পেশাজীবী, যেমন সরকারি চাকরিজীবী, এনজিও কর্মী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ যাঁরা শিশুশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বা আগ্রহী, তাঁরাই দীপার সহপাঠী-সহপাঠিনী। ডিগ্রির প্রায় শেষ পর্যায়ে দীপা দেশের কয়েকটা নামকরা এনজিও আর আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিল। ওর অনাগ্রহ দেখে ওরই প্রায় বছর দশেকের বড় এক সহপাঠিনী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
‘দীপা, আমি তো ভাবতে পারি না যে তুমি এ ধরনের ভালো চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারো? সমস্যা কী?’
‘দেখুন আপা, আমি আসলে চাকরি করতে চাই না।’
‘কিন্তু কেন? এই সময়ে চাকরি পাওয়া কঠিন, তার মধ্যে কর্মজীবনের শুরুতেই ভালো চাকরি, সে তো সোনার হরিণ! তাহলে আমি কি ধরে নেব যে তুমি বিয়ে করে গৃহিণী হয়ে জীবন কাটানোর পরিকল্পনা নিয়েছ?’
‘কেন আপা, চাকরি আর বিয়ে ছাড়া আর কি কিছু করতে পারি না?’
‘তা কী সেটা? যদি না বলো তাহলে বুঝব কী করে?’
‘আমি আসলে আমার জেলা শহরে ফিরে গিয়ে একটা বেসরকারি শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র খুলতে চাই।’
সহপাঠিনী এবারে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
‘তুমি আজ আমাকে বেশ অবাক করলে! সারা দেশ থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে যেখানে রাজধানীমুখী হয় আর তুমি জেলা শহরে ফিরে যাচ্ছ। তোমার জন্যে রইল আমার শুভ কামনা।’
সত্যি বলতে কি দীপার কখনোই ভালো লাগেনি তিলোত্তমা ঢাকা নগরীকে। প্রতিনিয়ত যানজট, পানি-বায়ু আর শব্দদূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ—কেন জানি ধীরে ধীরে রাজধানীকে করে তুলেছে বসবাসের অনুপযোগী। আর তা ছাড়া ওর জানামতে, তিন পুরুষের আবাসস্থল, অধিকাংশ আত্মীয়স্বজনকে ত্যাগ করে ও কখনোই কল্পনা করতে পারে না অন্যত্র গিয়ে বসবাস করবে। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার যে উন্নতি দিন দিন হচ্ছে, তাতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসা আর জরুরি কাজ সারা এক দিনেই সম্ভব, যদি রাজধানীতে যানজট না থাকে।
অবশেষে দীপা তার স্বপ্নের শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র গড়ে তুলেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীপা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে। জনা দুয়েক নারী কর্মীও সে নিয়োগ দিয়েছে আর সেই সঙ্গে ওর গৃহিণী মা-ও সময় পেলে ওকে সাহায্য করে থাকেন। আর ডাক্তারের প্রয়োজন হলে দীপার ডাক্তার বাবা তো আছেনই। এভাবেই ধীরে ধীরে দীপার প্রতিষ্ঠান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে সেদিন এক দম্পতি তাদের দেড় বছরের কন্যাশিশুকে নিয়ে এলেন দীপার কাছে ওর এখানে ভর্তি করানোর জন্য। দীপা বলল,
‘তা আপনাদের বাচ্চার নাম কী?’
জবাবে শিশুটির মা বললেন,
‘ওকে আমরা দীপা বলে ডাকি।’
দীপা একটু চমকে উঠলেও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল,
‘জানেন তো, আমার নামও দীপা!’
কিছুদিন পরের কথা। শ্রাবণের কোনো একদিন সারা দিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। দীপার দিবাযত্নকেন্দ্রসহ শহরের অনেক রাস্তাঘাট ততক্ষণে বর্ষার পানিতে তলিয়েছে। আর ঠিক এই দিনেই দীপা নামের শিশুটি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীপা শিশুটির মা-বাবা উভয়কেই মোবাইল করে, কিন্তু তাঁরা কেউই তার ফোন ধরেননি। দীপা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। এরই মধ্যে শিশুটির মা মোবাইল করে আর দীপা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মোবাইলটা ধরে বলল—
‘আপা, আপনার বাচ্চাটা বেশ অসুস্থ বোধ করছে। আপনারা কি ওকে দ্রুত নিয়ে যেতে পারেন?’
উত্তরে শিশুটির মা বললেন,
‘অবশ্যই, সেটাই করা উচিত। কিন্তু একে তো প্রচণ্ড বৃষ্টি চলছে আর অন্যদিকে শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমাদের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও কীভাবে যে আসব, বুঝতে পারছি না।’
আর দীপাও বুঝে উঠতে পারছিল না কী করা উচিত। হঠাৎই ওর মনে হলো তাই তো, ও তো ওর ডাক্তার বাবার সঙ্গে পরামর্শ নিতে পারে আর ও তাই বলল—
‘ঠিক আছে আপা। আপনি হয়তো জানেন যে আমার বাবা একজন ডাক্তার আর উনার চেম্বার হলো আমার এ শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রের দোতলায়। আমি এখনই বাবার সঙ্গে আলাপ করে আপনার মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।’
দীপার বাবা শিশুটিকে পরীক্ষা করে একটা তরল ওষুধ খাইয়ে দিলেন আর ১০-১৫ মিনিট পরই শিশুটি ঘুমিয়ে গেল। ঘুমন্ত শিশুটির দিকে দীপা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর উপলব্ধিতে এল, ও নিজেও একদিন শিশুটির মতো ছোট্ট ছিল। ও কল্পনাতে দেখতে পেল, ও যেন কয়েক মাসের শিশু, কাউকেই সে চেনে না, ক্ষুধা পেলেও বলতে পারে না, সে এক ভয়ানক প্রতিকূল অবস্থা! কোনো এক অষ্টাদশী নারী ওকে প্রচণ্ড রকম আদরযত্ন করে আর দীপাকে বারবার বলতে থাকে—
‘জানো, আমি তোমার মা।’
মাঝেমধ্যে এক যুবা পুরুষ দীপার কাছে আসে আর ওর উদ্দেশে বলে,
‘জানো, আমি তোমার বাবা।’
আর ঠিক এভাবে ওদের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই দীপার কাছে আসে আর পরিচয় দিয়ে থাকে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে দীপা বারংবার শুনতে শুনতে বুঝতে শেখে ওর সঙ্গে অন্যদের বন্ধন আর পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে।
দীপার বেশ মনে পড়ে, শিশুবেলায় ও বেশ দুরন্ত ছিল। ওর সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে ওর প্রায়ই ঝগড়া আর মারামারি হতো খেলনা নিয়ে, ওর বয়স যখন তিন-চার বছর ছিল। বড়রা, বিশেষ করে ওর মা-বাবা বিষয়টা নিয়ে ওকে খুব করে বোঝাতেন। তাঁরা দীপাকে প্রায়ই বকাবকি করতেন আর বলতেন,
‘দীপা, ওরা তোমার বন্ধু, তোমরা একে ওপরের ভাইবোনের মতো। তোমার উচিত ওদের সঙ্গে তোমার খেলনা ভাগাভাগি করা। একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে সহযোগিতা করা।’
কিন্তু কে কার কথা শোনে! দীপা সব সময়ই কেন জানি প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ত। ওর ভালো লাগত খেলনা গাড়ি, প্লেন আর বাচ্চাদের তিন চাকার ছোট্ট সাইকেল। অথচ ওর মা-চাচিরা প্রায়ই বলতেন,
‘দীপা, তুমি খেলবে পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল এসব নিয়ে। তুমি কেন ছেলেশিশুদের পছন্দের খেলনা নিয়ে খেলবে?’
দীপা কিন্তু ওই বয়সে কখনোই বুঝতে পারত না খেলনা পছন্দ আর অপছন্দের সঙ্গে মেয়ে আর ছেলেশিশুর কী সম্পর্ক। আরও একটু বড় হওয়ার পর দীপা বুঝতে শেখে, সমাজ কেন জানি চায় মেয়েরা পুতুল আর হাঁড়ি-পাতিল খেলার মাধ্যমে গৃহস্থালির কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত হোক। সেটা তাদের ভালো লাগুক আর নাই-বা লাগুক!
দীপার বয়স তখন ১০ কি ১১ বছর হবে। বার্ষিক পরীক্ষায় দুই-তিনটি বিষয়ে ও একটু খারাপ ফল করেছিল। আর তাই ওকে পড়তে হয়েছিল মা-বাবার বকুনির মধ্যে। তাঁরা বলেছিলেন,
‘দেখো দীপা, সারা দিন হইহই না করে তোমার উচিত পড়াশোনায় বেশি বেশি মনোযোগ দেওয়া।’
‘কেন, আমি তো ঠিকমতোই পড়াশোনা করি!’
‘তুমি যা করো, তা যথেষ্ট নয়। আর তা ছাড়া পৃথিবীটা হলো এক মহা প্রতিযোগিতার জায়গা। এখানে তোমাকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই অন্যদের থেকে ভালো করতে হবে।’
বাবা-মায়ের এ ধরনের কথার উত্তরে দীপা কী বলবে, তা বুঝতে পারল না। ওর মনে হলো, এই না কয়েক বছর আগে মা-বাবা সব সময় বলতেন দীপার উচিত ওর সমবয়সীদের সঙ্গে খেলনা ভাগাভাগি করা আর প্রতিযোগিতা না করে পরস্পরকে সহযোগিতা করা। আর এখন কিনা অবলীলায় ঠিক তার উল্টোটাই বলছে, হয়তো বড়রা এমনই হয়! চলবে...