দীপার বেড়ে ওঠা—প্রথম পর্ব
দীপার বেড়ে ওঠা—প্রথম পর্ব
দীপাকে ওর বন্ধু-বান্ধবীরা দীপশিখা বলে ডেকে থাকে! আর কেনইবা ডাকবে না! ওরা তখন জেলা শহরের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। এমনই একটা সময়ে দীপাদের বাড়িতে ওর একটা বিয়ের ভালো প্রস্তাব এসে ছিল—পাত্র পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। দীপার মা তো মহাখুশি, আনন্দে আটখানা। পারলে যত দ্রুত সম্ভব দীপাকে পাত্রস্থ করে। আর দীপার বাবা? উনার প্রতিক্রিয়া যে কী, তা ঠিক বোধগম্য নয়। এদিকে দীপা একেবারেই নিশ্চুপ—বাসায় কারও সাথেই কোনো কথা বলে না। এরই মাঝে দিন দুয়েক পার হয়ে গেছে। দীপার মা রাতের খাবারের টেবিলে দীপার উদ্দেশে বললেন,
‘শোনো দীপা, এভাবে চুপচাপ থাকবে না। আমি জানতে চাই, এ বিয়ের ব্যাপারে তোমার কী মত?’
উত্তরে ধীর কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে দীপা বলল,
‘আমি কোনোভাবেই এ বিয়েতে রাজি নই।’
‘কিন্তু কেন?’
এর কোনো উত্তর না করে দীপা আবার চুপচাপ খাবার খেতে থাকে। এদিকে দীপার মা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
‘শোনো মেয়ে, আমি কি তাহলে ধরে নেব যে তোমার কোনো নিজস্ব পছন্দ আছে?’
‘দেখো মা, তুমি একেবারেই বাজে কথা বলবে না। আমার নিজের কোনো পছন্দ নেই।’
‘তাহলে, সমস্যা কী?’
‘আমার থেকে তো ভাইয়া প্রায় বছর ছয়েকের বড়। সে তো পড়ালেখা শেষ করে ব্যবসা করে। তার বিয়ের ব্যাপারে তো আজ পর্যন্ত তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা শুনিনি। কিন্তু তোমার কাজ হলো আমাকে বাড়ি থেকে বিদায় করার ষড়যন্ত্র!’ বেশ রাগত স্বরে দীপা বলে উঠল।
এবারে দীপার ভাই বলল,
‘শোনো, আমার বোনের কথা! মেয়ে হয়ে জন্মেছ আর তোমার বিয়ের ব্যাপারে আমরা ভাবব না, তা কী করে হয়?’
প্রত্যুত্তরে দীপা উত্তেজিত স্বরে বলল,
‘বাহ! চমৎকার তোমাদের চিন্তাভাবনা! মেয়ে হয়েছি বলে লেখাপড়া শেষ করব না। পরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকব, তাই না?’
‘তাহলে কি আমাদের তোমার লেখাপড়া শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?’ ভাইয়া আবারও বলল।
‘না না, শুধু লেখাপড়া শেষ নয়। এরপর আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, তারপর বিয়ের চিন্তা।’
গত কয়েক দিন হলো দীপার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দীপা একটু অপেক্ষায় ছিল যে কখন মা বা বাবা ওর পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইবে। ওকে খুব একটা অপেক্ষা করতে হলো না। ওই দিনই রাতের বেলা খাবার টেবিলে বাবা জানতে চাইলেন,
‘তা মা, তোমার অনার্স পরীক্ষা তো শেষ হলো। এবারে বলো, তুমি কী করতে চাও?’
উত্তরে দীপা বলল,
‘জানো বাবা, আমি ভাবছি আমাদের জেলা শহরে বেসরকারি পর্যায়ে একটা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করলে কেমন হয়?’
‘তা তোমার মাথায় এমন চিন্তা কেন এল?’
‘জানো বাবা, আমাদের পরীক্ষার মাস ছয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কর্মজীবী মা ও শিশু প্রতিপালন’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সে আলোচনা থেকে আমি বুঝলাম যে জেলা শহরগুলোতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র কর্মজীবী মায়েদের জন্য খুবই দরকার। আমি গত কয়েক মাস একটু খোঁজখবরও করেছি। আমাদের শহরে সরকারি একটা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে, কিন্তু সেটা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।’
‘কিন্তু মা, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র করতে হলে তো আমি ডাক্তার হিসেবে জানি যে এর লাইসেন্স পেতে হলে তোমার দরকার শিশু দিবাযত্ন-সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ, যেটা তোমার নেই।’
এবারে দীপার মা বলে উঠলেন,
‘তার মানে তুমি চাকরি করবে, তারপর বিয়ে করবে?’
উত্তরে দীপা বলল,
‘আমি কখন চাকরির কথা বললাম। নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে আমি উদ্যোক্তা হব।’
এতক্ষণ চুপ থাকলেও দীপার ডাক্তার বাবা মনোযোগসহকারে ওদের কথাবার্তা শুনছিলেন। এবারে দীপার উদ্দেশে বললেন,
‘তা মা, তোমার উদ্যোক্তা হওয়ার মূলধন কোথায় পাবে?’
এমন প্রশ্নে দীপা যতটুকু বিস্মিত হলো, তার চেয়ে বেশি হলো বিরক্ত। ও বলল,
‘বাবা, তুমি সত্যিই আমাকে অবাক করলে! ভাইয়াকে তুমি চাকরি না করে ব্যবসা করতে শুধু যে উৎসাহিত করেছ তা নয়, বরং তাকে মূলধন দিয়েছ আর দিয়েছ প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপদেশ। আর আমার বেলায় মূলধন কোথায় পাব?’
দীপা যে এমন সত্য কথা নির্ভয়ে বলতে পারে, এ ব্যাপারে পরিবারের সবাই জানে আর তাই কেউ কোনো কথা বলতে উৎসাহ পেল না। এই নিস্তব্ধতার মাঝে দীপা একটু নিচু কিন্তু পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,
‘আমি একটি শিক্ষিত রুচিশীল পরিবারের সন্তান। আর আমিই যদি নিজ পরিবারে শুধু মেয়েসন্তান হয়ে জন্মানোর জন্য বৈষম্যের শিকার হই, তাহলে এ সমাজের আর কোথায়ও কি আমি সঠিক আচরণ আশা করতে পারি?’
রূঢ় অথচ সত্য এই কথাগুলো বলার পর দীপার আর কোনোরূপ ইচ্ছা করল না খাবার টেবিলে বসে থাকতে। আর ও উঠে যাচ্ছে দেখার পরও কারও মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারিত হলো না।
‘বাবা, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এরই মধ্যে খোঁজখবর করে জেনেছি যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্লি চাইল্ড ডেভেলপমেন্টে মাস্টার্স কোর্স আছে। আমি ভাবছি, ওই ডিগ্রি প্রোগ্রামে ভর্তি হব।’
‘তাহলে তো তোমাকে ঢাকায় যেতে হবে, একলা একটা মেয়ে হয়ে সেটা কী করে সম্ভব?’
বাবার এমন প্রশ্ন শুনেই দীপার মনে হলো গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। ও তাড়াতাড়ি করে কয়েক ঢোক পানি পান শেষে বলল,
‘দেখো বাবা, একবিংশ শতাব্দীতে মেয়েরা অভিভাবক ছাড়া দেশ-বিদেশ, এমনকি মহাশূন্যে পর্যন্ত যাচ্ছে, আর তুমি বলছ আমি ঢাকা গিয়ে পড়ালেখা করতে পারব না?’
‘তা তোমার এই স্পেশাল মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে কেমন সময় লাগবে?’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী কুড়ি মাস লাগবে মাস্টার্স করলে আর ষোলো মাস লাগবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করলে।’
দীপার পিতার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে ও আটঘাট বেঁধেই আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এই পর্যায়ে দীপার মা যেন নিজের সাথেই কথা বলছে ভেবেই বললেন,
‘বাবার প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে মেয়েটা যেন যা খুশি তা করার অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে। বাবা-মেয়ে মিলে যা মনে চায় তা-ই করো, আমি বলার কে? তবে আমার এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা মোটেও ভালো লাগে না।’
কিছুক্ষণ হলো কেউ আর কোনো কথা বলছে না। আর সবার খাবার খাওয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে বলা চলে। এমনই একটা সময়ে দীপা খাবার টেবিল ছাড়তে উদ্যত হচ্ছে দেখে তখনই ওর বাবা ইতস্তত ভঙ্গিতে দীপার উদ্দেশে বললেন,
‘তা তোমার পড়ালেখা শেষ করতে তাহলে এখন থেকে প্রায় বছর দুই সময় লাগবে। তারপর তোমার শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা, ধর আরও এক-দুই বছর লাগবে, তা-ই না?’
‘তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। তা আমি বুঝলাম না এটা কি তোমার প্রশ্ন, না এর পেছনে আরও কিছু লুকানো আছে?’
এবারে দীপার বাবা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে বললেন,
‘তোমার কোনো কাজেই আমি কখনো বাধা দেয়নি, আজও তা দেব না। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে একটা কথা বলতে চাই। সেটা হলো, নারীদের সন্তান ধারণের জন্য সবচেয়ে উত্তম সময় হলো যখন তাদের বয়স থাকে ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আর তাই আমি মনে করি, যাই করো না কেন, বিষয়টা অবশ্যই মাথায় রাখবে। কেননা, বিয়ে আর বংশবিস্তার ছাড়া পৃথিবীর বুকে মানুষের অস্তিত্ব কখনো টিকতে পারে না।’ চলবে...