বালিশ
বালিশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতি আবশ্যকীয় একটি উপকরণ। জন্মের পর থেকে মৃত্যু অবধি বালিশের সঙ্গ ছাড়া একটি দিনও আমরা কল্পনা করতে পারি না। ক্লান্ত শরীরে একটুখানি বিশ্রাম ও আরামের তৃষ্ণায় বিছানায় গিয়ে যখন লুটিয়ে পড়ি, তখন বালিশই আমাদের প্রথম ও প্রধান অবলম্বন। তুলতুলে এই নরম বস্তুটি ছাড়া—কী মাটির চাঁটাইয়ে, কী সোনার পালঙ্কে—কোথাও আমরা একদণ্ড শুয়ে থাকতে পারি না, শান্তি পাই না! আমরা দিনের বেলা কাজ করি, আবার ফুরসত পেলে বালিশে মাথা রেখে, চোখ বুজে, পা নাড়াতে নাড়াতে আকাশকুসুম কল্পনা করতেও কসুর করি না। আঁধার ঘনিয়ে এলে বালিশে মাথা রেখেই আমরা আরামের ঘুম ঘুমাই, মধুর মধুর স্বপ্ন দেখি। গভীর রাতে অনিদ্রায় যখন ছটফট করি কিংবা ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্নে সময় পার করি তখন পাশে আর কেউ থাকুক বা না থাকুক, বালিশ আমাদের সঙ্গে থাকে। সে খুব কাছেই থাকে, ব্যথাভরা ভারী মাথার ভার বিনা ওজরে আপন কাঁধে তুলে নেয়। তাহলে কি এ কথা বলা যায় না, বালিশ আমাদের অন্যতম প্রকৃত বন্ধু, আসল বন্ধু। কারণ, সুখের কালে বালিশ আমাদের পাশে থাকে, কষ্টের সময়ও সে তার বন্ধুকে ছেড়ে অন্তর যায় না। দিনে ঘুমানো কিংবা শুয়েবসে সময় কাটানো গরিবের বিলাসিতা, কিন্তু রাতের বেলা যেমন–তেমন হোক, তারও একটা বালিশ চাই। যে ভিখারি সারা দিনে কোনোমতে দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে পারে, সে–ও বালিশে মাথা রেখে নির্বিঘ্নে রাতে ঘুমাতে চায়। যার একটা বালিশ নেই, ভেবে দেখুন, তার চেয়ে হতভাগা জগতে আর কে আছে!
আমি কখনো বালিশবিহীন ছিলাম না। তবু জীবনভর এই বালিশ নিয়ে আমার বিড়ম্বনারও শেষ নেই। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার ছয় নম্বর ভাই, ফরহাদের জন্ম হলো। আমি একদিন লক্ষ করলাম, শর্ষের বীজ দিয়ে বানানো ছোট্ট এক বালিশে নবজাত শিশুর মাথা রেখে মা তাকে চিত করে শুইয়ে রেখেছেন। আমার প্রিয় জননীকে জিজ্ঞেস করলাম, জন্মের পর তুমি কি এভাবে শর্ষের বালিশের ওপর আমাকেও ঘুম পাড়াতে। তিনি উত্তর দিলেন, ‘নিশ্চয়ই, তা না হলে তোমার মাথা এত গোল হলো কী করে, বাবা?’ ওই দিন মাকে কোনো জবাব দিতে পারিনি। আজ তিনি বেঁচে থাকলে বলতাম, ‘মা, তুমি শুধু আমার মাথাই গোলাকার করনি, আমার মগজটাও গোলমেলে করে দিয়েছ। আর তাই তো আমার সবকিছুতেই গন্ডগোল!’ পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারছি, বিদ্যাবুদ্ধির জগতে বৃত্তাকারে ঘুরপাক খেতে খেতে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনে তো আর এগোতে পারলাম না!
আরেকটু বড় হওয়ার পর, আলাদা আলাদা বালিশে ছোট ভাই জামানের সঙ্গে একই কাঁথার নিচে ঘুমাতাম। কার বালিশ কখন কার বালিশের সঙ্গে এসে লেগে গেল কিংবা কাঁথা কে কতখানি নিজের দিকে টেনে নিল, এ নিয়ে তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার ঝগড়া, মারামারি হতো। মা কিছুই বলতেন না, কিন্তু বাবা টের পেলে আমাদের উভয়ের ওপর সমান শাস্তির খড়্গ নেমে আসত। কে ফরিয়াদি আর কে বিবাদী, তিনি জানতে চাইতেন না, কারও কথা শুনতেও চাইতেন না। উপহারস্বরূপ দুজনকেই মুক্তহস্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ কানমলা দিয়ে যেতেন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে যথাক্রমে হোস্টেলে ও হলে থেকেছি প্রায় আট বছর। এ সময় মাত্র একটি বালিশই ছিল আমার একলা রাতের প্রিয় সাথি। বাড়ির গাছের শিমুল তুলা ঠেসে ভরে নিজ হাতে অনেক যত্ন করে বানিয়েছিলাম সেই বালিশ। বালিশটি আঁটসাঁট এবং শক্ত ছিল বলে প্রথম দিকে বেশ বেআরাম ছিল, পরে নরম হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রায়ই বালিশসংশ্লিষ্ট একটা রোগেও ভুগতাম। কী কারণে হতো জানি না, মাঝেমধ্যে ঘাড়ে এমন যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা নিয়ে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতাম, যা বলে বোঝানোর নয়! ব্যথার চোটে ডানে-বাঁয়ে ঘাড় একটুও নাড়াতে পারতাম না। তবে এর একটি কার্যকর প্রতিকার আমার জানা ছিল এবং এটা খুব ভালো কাজও করত। ব্যবস্থাপত্রটি ছোট চাচার কাছ থেকে পাওয়া, কিন্তু তিনি এই জ্ঞান কোন গাঁয়ের কোন কবিরাজ থেকে শিখেছিলেন, তা আমার জানা নেই। এ রকম ঘাড়ব্যথা হলে বালিশটা সারা দিন রোদে রেখে উল্টে-পাল্টে দিতাম। রাতে সেই গরম বালিশে ঘুমালে পরদিন থেকে আস্তে আস্তে ব্যথা সেরে যেত।
বিদেশে যখন চলে এলাম, তখন বালিশ নিয়ে ভোগান্তির কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। ভুলে যাওয়ার মানে এই নয় যে বালিশের সঙ্গে আপসে আমার একটি বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল; বরং ওই সময়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতার আঘাতে আঘাতে দেহ-মনে এমনভাবে বিধ্বস্ত ছিলাম যে বালিশের দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসতটাও পাইনি। কয়েক যুগ পার করে এসে ইদানীং বুঝতে পারছি, বালিশ আমার জীবনে আবার নববিড়ম্বনায় নতুন নতুন রূপে এসে দেখা দিয়েছে! এবারের সমস্যা একটু অন্য রকম।
একটা বালিশ হলে মাথার জন্য বেশি নিচু হয়ে যায় এবং দুটি হলে হয়ে যায় অস্বস্তিকর রকমের উঁচু। নিজে নিজে বুদ্ধি খরচ করে এরও একটা সমাধান বের করলাম। এক বালিশের কাভারে দেড়টা বালিশ; অর্থাৎ একটা ফুল সাইজ এবং আরেকটা পুরোনো, ছোট ও পাতলা বালিশ পুরে দিলাম। এভাবে ঘুমাতে গিয়ে দেখি, প্রতি দুই–তিন দিন পরপর ছোট বালিশটা ঠিকই কাভারের ভেতরে থাকে, কিন্তু বড়টা কথা মানতে চায় না, পিছলিয়ে পিছলিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় এবং আসেও। আবার জোর করে ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢোকাতে হয়। এভাবে কদিন পরপর বালিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে কতটা বছর যে কাটিয়ে দিলাম, কে তার হিসাব রাখে!
সময়ের হিসাব যেমন রাখা যায় না, তেমনি বালিশ নিয়ে দেশ-বিদেশে আমার যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ভুলে গেছি। তবে একটি ঘটনা ভোলার নয়, এখনো মনে আছে। এবার বলছি সে কাহিনি। ২০০৯-১০ সালের দিকে জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ টোকিও থেকে একটি সেমিনারের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এ উপলক্ষে সেখানে গিয়েছিলাম ৩–৪ দিনের জন্য।
আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ইনস্টিটিউট ভবনের বেজমেন্টের গেস্টহাউসে। প্রথম রাতে ঘুমাতে গিয়ে বেডকাভার তুলে দেখি, একটার ওপর আরেকটা মিনি সাইজ বালিশ রাখা। বালিশগুলো এত ছোট, যেন আমার মাথাটারই জায়গা হবে না। এত ছোট এবং এত নরম বালিশে তো আমি ঘুমাতেই পারব না। তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে। এখন করি কী! ভেবেচিন্তে ওপরতলায় গেস্টহাউসের ফ্রন্ট ডেস্কে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, সেখানে কোনো গেস্ট নেই, কর্তব্যরত তিনজন নারী কর্মকর্তা খোসমেজাজে গল্প করছেন। তাঁদের সাথে কথা বলে বুঝলাম, কাজ চালানোর মতো ইংরেজি তাঁরা জানেন, কিন্তু ‘বালিশ’ কিংবা ‘পিলো’ কী, তাঁরা কেউ–ই জানেন না। আমি দুই হাত ও মাথা নেড়েচেড়ে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কোনোভাবেই বোঝাতে পারলাম না যে আমি আমার বালিশগুলো বদলাতে চাই। অগত্যা রুমে গিয়ে একটা বালিশ সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। আমাকে বালিশ হাতে দেখে তাঁরা তিনজনই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘অহ! ‘মাকুরা’, ‘মাকুরা”।’ বিশ্বাস করুন, সেই রাতে ওই তিন জাপানি তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জাপানি ভাষায় বালিশকে যে মাকুরা বলে, এটা শেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপকার হয়নি।
অনেক দিন পর আবার এ রকম লাভ-লোকসানের হিসাব করতে গিয়ে একদিন একটি ভালো বালিশ কিনেও কিনতে পারিনি। এবার শুনুন সে গল্প। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখলাম, বাজারে একধরনের নতুন বালিশ বেরিয়েছে, একটার দাম ৫০ ডলার। যেসব দোকানে এই বালিশ পাওয়া যায়, সে রকম একটি দোকান আমাদের বাড়ির পাশেই আছে। নাম বেড-বাথ-অ্যান্ড বিওন্ড। একদিন একটি দামি বালিশ কিনব বলে দোকানে গেলাম, নেড়েচেড়ে দেখলাম। ৫০ ডলার দিয়ে একটি বালিশ কিনব! কিনব কি কিনব না ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত আর কেনাই হলো না। নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলাম, ‘এক বালিশে নিচু এবং দুই বালিশে উঁচুর সমাধান হবে না, তো এত দাম দিয়ে একটা বালিশ কিনে লাভ কী। এভাবে খালি হাতে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। আসলে সেদিন পকেট থেকে ৫০ ডলার খসাতে চাইনি, তাই অবুঝ মনকে এভাবে বুঝ দিয়েছিলাম।
বিড়ম্বনাকে সঙ্গে নিয়ে দেড়খানা বালিশের ওপর মাথা রেখে রেখে আরও কাটিয়ে দিলাম পাঁচ-ছয় বছর। ভাবলাম, চলছে তো চলুক। আপাতত বালিশ আর বদলাচ্ছি না। এর মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসের ৯ তারিখ, আমার স্ত্রীকে নিয়ে একটি কাজে গেছি ‘হোম ডিপো’তে। ফিরে আসার পথে বেড-বাথ-অ্যান্ড বিওন্ড দোকানের সামনে এসে অপরিকল্পিতভাবে হঠাৎ করে পার্কিং লটে গাড়ি রেখে গিয়ে উঠলাম দোকানে। গিন্নি বললেন, ‘এখানে কেন?’ উত্তর দিলাম, ‘বালিশের সঙ্গে আর যুদ্ধ করতে চাই না, কদিনই–বা বাঁচব, পছন্দমতো পেলে আজই একটি ভালো বালিশ কিনে ফেলব, দাম যতই হোক।’ দোকানে এলাম, বালিশ দেখছি, দাম দেখছি—৫ ডলার থেকে ১৭০ ডলার দামের বালিশ থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লোর স্টাফকে বললাম, আমি একটি ভারী-পুরু বালিশ চাই। তিনি তিন-চারটা দেখালেন। যে বালিশটি আমার পছন্দ হলো, তার নাম, ‘মিরা ব্যাম্বু পিলো’। ৩০ ডলার দিয়ে বালিশটি কিনে নিয়ে এলাম। ঘরে এসেই জোড়াতালি দেওয়া পুরোনো বালিশ ছুড়ে ফেলে দিলাম। নতুন বালিশটি কাভারে ভরে একটু শুয়ে দেখলাম, বাহ ! বেশ আরামই তো মনে হচ্ছে! দেখা যাক, আজ রাতে ঘুম কেমন হয়। আরামের ঘুম দিয়ে পরদিন সকালবেলা ঝরঝরে শরীরে উঠলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! মনে হলো, এত দিন পর বালিশ-বিড়ম্বনা থেকে আমার মুক্তি মিলেছে! আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার ‘বালিশ-বিলাস’-এর গল্প এখানেই বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না, নতুন আরেক ভাবনা এসে মুহূর্তের মধ্যে আমাকে কাবু করে ফেলল। ‘যেদিন মাটির ঘরে, মাটির বিছানায়’ আমাকে শুইয়ে রাখবে, সেদিন তো ‘মিরা ব্যাম্বু বালিশ’ আমার সঙ্গে যাবে না!
লেখক: আবু এন এম ওয়াহিদ; অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং এডিটর জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ, টেনেসি, আমেরিকা