পবিত্র শহরে–২
মক্কা
মক্কা যাওয়ার উদ্দেশে মদিনা রেলস্টেশনে পৌঁছালাম ট্যাক্সিতে। এক বাংলাদেশি চালক আমাদের রেলস্টেশনে পৌঁছে দিলেন। সুন্দর রেলওয়ে স্টেশন, নতুন। ২০১৪ সালে যখন সৌদি এসেছিলাম, তখন ট্রেন ছিল না। মদিনা থেকে মক্কা যেতে ৭–৮ ঘণ্টা লেগে যেত গাড়িতে। এখন ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা মাত্র। আমরা একটু আগে এসেছি। গেট তখনো খোলেনি। ছেলে খাওয়া নিয়ে এল নিচতলার রেস্তোরাঁ থেকে।
ট্রেনে উঠলাম, হাইস্পিড ট্রেন। গতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। ভেতরে বসলে বোঝাই যায় না, এত দ্রুত চলছে। নড়াচড়া কম। মরুভূমির দিকে ছুটে চলছে ট্রেন। তখন দুপুর। আমাদের পাশেই বসেছে এক আরব পরিবার। চার মহিলা, দুই পুরুষ ও দুই বালক। বালক দুটো অদ্ভুত সুন্দর। হিজাব থাকায় নারীদের সৌন্দর্য বোঝা কঠিন। তবে এই চার নারীর সাথে, দুই পুরুষের সম্পর্ক কী! আমি বললাম, বয়স্ক লোকের তিন বউ আর জওয়ান ছেলের একজন। আমার স্ত্রী এটা শুনে হাসতে হাসতে মরে, একমত না। তবে শেষে বলল, হইতেও পারে। শুনছি, আরব লোকদের ৩–৪ বউ থাকে। তবে বাংলাদেশি সতিনদের মতো ঝগড়া–বিবাদে লিপ্ত হয় না তারা। বোনের মতো মিলেমিশে থাকে। ছুটির দিনে পুরো পরিবার নিয়ে, অনেকেই চলে যায় বাগানবাড়িতে।
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মদিনা ছাড়ার আগের দিন যখন এহরামের কাপড় কিনে রুমে ফিরলাম, হঠাৎ মনে হলো ওমরাহ করার নিয়মটা একটু দেখে নিই। অনলাইনে ঢুকে তো মাথা খারাপ। ওমরাহ করতেও অ্যাপসে ঢুকে ওমরাহ পারমিট নিতে হয়। হায় আল্লাহ, আমি তো পারমিট নিইনি। পারমিট যদি না পাই সময়মতো? ওমরাহর কী হবে! যার জন্য আসা।
তাড়াতাড়ি অ্যাপসে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি পরের দিনের জন্য পারমিট আছে। আলহামদুলিল্লাহ। পারমিট নিলাম। আমাদের সময় দিয়েছে ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে ওমরাহ করতে। কিন্তু গিয়ে দেখি পারমিশন চেকের কোনো বালাই নেই। এহরাম (সেলাইহীন সাদা কাপড়) পরা থাকলেই ঢোকা যায়। আমাদের ওমরাহ করার অভিজ্ঞতা থাকায়, এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। ওমরাহ করে চুল কাটতে লাইন দিলাম। লাইনের শেষ মাথায় এসে দেখি, এখানে মাথা কামায় না, চুল ছেঁটে দেয়, মাগনা। সম্ভবত সৌদি সরকারের এই আয়োজন। কিন্তু আমরা জানি, ওমরাহ করলে, মাথা কামাতে হয়, বেল মাথা। ছেলে বলল, চলো অন্য কোথাও। পয়সা দিয়ে মাথা কামিয়ে ফেলি। পথেই এক বাংলাদেশি লোক বলল, আসেন, আমার সাথে সেলুনে। তিনি আমাদের পাকিস্তানি এক সেলুনে নিয়ে গেলেন। সম্ভবত সে এজেন্ট। কাস্টমার এনে দিলে কমিশন পায়। বাপ-ছেলে মাথা কামালাম। ক্লক টাওয়ারের পাশের ভবনে নাম-সাফাহ টাওয়ার। সেখানে অনেকগুলো বাঙালি রেস্তোরাঁও আছে। স্ত্রীসহ বিরিয়ানি খেতে বসে গেলাম। আর ছেলে চলে গেল ক্লক টাওয়ারে। আল বাইক খাবে। এটা হচ্ছে সৌদির বিখ্যাত ফ্রাই চিকেনের ব্র্যান্ড। কেএফসির মতো। রাতে খাবারদাবার সেরে হোটেলে গেলাম।
আমাদের মক্কা হোটেলের নাম-আল কিসওয়া টাওয়ার হোটেল। রুমগুলো প্রশস্ত। হোটেলের ভেতর মসজিদও আছে। আছে দোকানপাট। চারদিকে বাংলাদেশি কর্মী। হোটেলের নিচতলায় অনেক দোকানের মালিক বাংলাদেশি। বেশির ভাগেরই বাড়ি চট্টগ্রাম। আমরা এটা সেটা কিনতে লাগলাম। রোজ হারাম শরিফে যাই। মাঝেমধ্যে হোটেলের মসজিদেও নামাজ পড়ি। একদিন আমি আকামত দিলাম। অন্ধ এক ইমাম আমাকে বললেন, তোমরা বাংলাদেশে যেভাবে আকামত দাও, তা ভুল। তিনি শুধরিয়ে দিলেন। পরদিন রাতে এক বাঙালি খাবারের দোকান খুঁজে পেলাম, যেটা খুব অদ্ভুত। রেস্তোরাঁর কোনো সাইনবোর্ড নেই। ছোট দুইটা রুমের ভেতর রেস্তোরাঁ। ভাত তরকারি, নাশতা সবই আছে। পথে পরিচয় হওয়া এক বাংলাদেশি ভাই, আমাদের ওই অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। নিষিদ্ধ রেস্তোরাঁয়। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির ভেতর। রেস্তোরাঁর পরিবেশ দেখলে আপনার পছন্দ হবে না। কিন্তু খাওয়াটা খারাপ না, সস্তাও। পরবর্তী দুই দিন ওরা আমাদের হোটেলে খাবার পৌঁছে দেয়। সৌদি খাবারের সিস্টেমটা অন্য রকম। বড় একটা পলিথিন দেয়। সেখানে সব খাবার ঢালা হয়। তারপর ওই পলিথিনের ওপর খাবার রেখে সবাই খায়। একটা বড় প্লেট হয়ে যায় এটা। খাওয়ার পর উচ্ছিষ্ট সব পলিথিনে মুচড়ে, বিনে ফেলে দিলেই হলো। ধোয়াধুয়ির ঝামেলা নেই।
যেদিন মক্কা পৌঁছালাম, তার পরদিন ঘটল আরেক ঘটনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি-ছেলে নিরুদ্দেশ, রুমে নেই। কোথায় গেল! প্রথমে ভাবলাম আশপাশে কোথাও হাঁটতে গেছে, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। কিন্তু না, তার ফেরার কোনো লক্ষণ নেই। ফোন দিই, ফোনও ধরে না। টেনশন মাথায় নিয়েই হারাম শরিফে নামাজ পড়তে গেছি, হঠাৎ দেখি শরীর খারাপ লাগছে। কার্পেটে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম, একা। পাশে কোনো প্রিয়জন নেই। স্ত্রী মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে নামাজ পড়ছে। এখন যদি মরে যাই! মনে মনে ভাবলাম, এখানে মরলে তো ভালোই হয়। হারাম শরিফে মৃত্যু তো ভাগ্যের ব্যাপার। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর শরীর কিছুটা ভালো হলো। জোহরের নামাজের পর রুমে ফিরলাম। বেলা আড়াইটার দিকে ছেলে ফোন ধরল। ছেলের মা জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কোথায়? ফোন ধরছ না কেন?
বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই ডেলিভারিম্যান ফোন দিল আমার ছেলেকে। ছেলে মোবাইল ধরিয়ে দিল আমাকে-বাবা, তুমি কথা বলো, আমি আরবি জানি না। অগত্যা চালককে ফোন দিয়ে বললাম, ডেলিভারিম্যানের সাথে কথা বলো। জিজ্ঞেস করো কোনদিকে আছে। আমাদের লোকেশন দাও। বাংলাদেশি চালক দু–তিনটা বাক্য আরবিতে বলার পর হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলল, আরে, আপনিও তো দেখছি বাংলাদেশি?
আমি অন্য একটা রুম ভাড়া নিয়েছি।
কেন?
গেল রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি, বাবার নাক ডাকার জন্য।
তাই বলে, তুমি না বলে, এভাবে চলে যাবে?
তোমরা তো ঘুমাচ্ছিলা, তাই তোমাদের ডাকিনি।
কোন হোটেলে আছ তুমি?
একই হোটেলে।
ওকে। ঘুম শেষ হলে আমাদের রুমে ফিরে এসো।
ওকে।
যাক, টেনশন গেল। এই প্রজন্ম নিয়ে সমস্যা। কখন কী করে বসে। অবশ্য এই প্রজন্ম ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ না করলেও, মুখে ময়লা থাকলেও, মন তাদের পরিষ্কার। যা বলবে, স্পষ্ট। কিশোর ছেলে, অবশ্য পরদিন আমাদের রুমেই ফিরে আসে। কিছু বকাঝকাও হজম করে সে।
পরদিন আরেক বাঙালি তরুণ ট্যাক্সিচালককে নিয়ে যাই, দর্শনীয় স্থান দেখতে-হেরা গুহা, আরাফাত ময়দান, মুরদালিফা, শয়তান মারার জায়গা দেখতে। ইতিমধ্যে আয়শা মসজিদে গিয়ে নামাজও আদায় করেছি। আমাদের তরুণ ড্রাইভারের নাম ফয়সল। বাড়ি কুমিল্লা, বয়স ২৩–২৪ বছর হবে। প্রথমে এসে পরিচ্ছনতার কাজ করত। তারপর হয় কফিশপের কর্মী। তারপর কফি বানাতে পারদর্শী হয়ে গেলে কফিশপের মালিক তাকে ম্যানেজারের ভূমিকায় খাটায়। তার মালিক খুব ভালো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কাজ করে, তার স্ত্রী ইংরেজির শিক্ষক। কিন্তু তাদের ব্যবসায় মন্দা এবং তাদের বদলিজনিত সমস্যার কারণে একসময় কফিশপ বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ফয়সল লেগে যায় ট্যাক্সিতে। সে মক্কার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরিয়ে, আমাদের বলে-রাতে সে ট্যাক্সি চালায় না। তবে তার চাচাতো ভাই চালায়। চাচাতো ভাইকে পাঠাবে, আমাদের জেদ্দা বিমানবন্দরে ড্রপ করতে।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
লন্ডনে ফেরার সময় হয়ে আসছে আমাদের। কীভাবে যেন এক সপ্তাহ চলে গেল। চোখের পলকে। বউ বলল, তার খুব শখ, দুইটা ছোট সোনার গয়না কেনার। এই শখ মেয়েদের জন্য কমন। কী আর করা। সোনাদানাও কেনা হলো। খেজুর, তসবিহ, টুপি, জুব্বা।
রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে পেটেও সমস্যা দেখা দিল। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, ভালোয় ভালোয় লন্ডন পৌঁছাতে পারলেই হলো। বউ রোজ একগাদা বোতল ভরে জমজম পানি নিয়ে আসে হোটেলে। আমাদের বোতলের পানি খেতে দেয় না। আসার আগের দিন স্ত্রী বলল, আবারও তওয়াফ করতে চায়। আমরা তিনজন গেলাম আবারও তওয়াফ করতে। দোতলায় আজ ভিড় কম। দুই চক্কর দেওয়ার পর ছেলে একটা হুইলচেয়ার এনে বলল, বাবা, তুমি বসো, আমি ও মা তোমাকে ধাক্কা দিই। পালা করে তারা আমাকে ধাক্কা দিল। মোটামুটি আরাম করেই তওয়াফ করলাম। তারপর ছেলে বায়না ধরল তাকে পারফিউম কিনে দিতে হবে। এখানে নাকি পারফিউম অনেক সস্তা। লন্ডনের তুলনায়। গেলাম পারফিউম কিনতে। পারফিউমের দোকানগুলো খুব স্মার্ট। স্মার্ট বিক্রয়কর্মীরা, কাস্টমারদের মন জয় করতে, কথার ভেল্কি দেখাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন দোকান ঘুরে যাচাই–বাছাই করছি। হঠাৎ একজন বিক্রয়কর্মীকে কেন যেন মনে হলো এই ছেলেটা বাংলাদেশি হতে পারে। ইংরেজিতে বললাম, তোমার দেশ?
বাংলাদেশ।
ওই একটি শব্দ, আপনি যখন বিদেশে শুনবেন, আপনার মন মমের মতো গলতে থাকবে। আমারও গলতে শুরু করল। সে যখন বলল, বিক্রয়কর্মী হিসেবে আজ তার প্রথম দিন। তখনই আমার মনে হলো একটি পারফিউম হলেও আমি তার কাছ থেকে কিনব। তার পাশে দাঁড়ানো, তার বস যাতে ভাবতে না পারে, বিক্রয়কর্মী হিসেবে, বাংলাদেশি এই ছেলেটি যথার্থ নয়। বাংলাদেশের যাতে বদনাম না হয়। শিক্ষিত, মার্জিত, ফেনীর এই তরুণকে আমি যখন বললাম (বাংলায়) একটি নয়, আমি তোমার দোকান থেকে তিনটি পারফিউম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে তোমার বস তোমার ওপর খুশি হয়, বুঝতে পারে, তুমি একজন ভালো বিক্রয়কর্মী, তোমার চাকরি স্থায়ী হয়। বাংলাদেশ যাতে হেরে না যায়।
আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে, আবেগে সে নির্বাক হয়ে যায়। হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
আমি তিনটি পারফিউম কিনলাম। পারফিউম কোম্পানির বস, খুশি হয়ে আমাদের সাথে গল্প শুরু করে দিল। পারফিউম কিনে গেলাম খেতে। হারাম শরিফের উল্টো দিকের সাফা-মারওয়া টাওয়ারে। ওখানে ফুডকোর্ট আছে। আছে বাংলাদেশি কয়েকটা রেস্তোরাঁও। ওখানে পিক আওয়ারে চেয়ার পাওয়া কঠিন। যাক আমরা আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে, তিনটা চেয়ার জোগাড় করতে সমর্থ হই। আজ জোর করে ছেলেকে বাংলাদেশি খাওয়ালাম। কালাভুনা আর পরোটা খেয়ে, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া আমার ছেলে বলল, খাওয়াটা বেশ মজা। আমি আর আমার স্ত্রী ভাত-মাছ খেলাম। ১০ বছর আগে যখন আমরা মক্কায় এসছিলাম, এই রেস্তোরাঁতেই খেয়েছিলাম। খেয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত ১২টা।
আগামীকাল লন্ডন চলে যাব। স্ত্রী রুমে এসে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। জিনিসপত্র বেশি কেনা হয়ে গেছে। জায়নামাজ ও কয়েকটা জুতা লন্ডনে নিতে চায় না। আমি জোর করে ব্যাগে জায়নামাজ ঢুকালাম। বড় এক বোতল জমজম ওয়াটার বোতল দিয়ে এলাম লন্ডনপ্রবাসী এক পরিবারকে। যারা আমাদের হোটেলেই অবস্থান করছে। সকালে ছেলে বলল, বাবা, টিকিট প্রিন্ট করতে হবে। জেদ্দা বিমানবন্দরে ই-টিকিট বৈধ না। পড়লাম সমস্যায়। কোথায় প্রিন্টার পাই? ছেলে বলল, হোটেলে অভ্যর্থনা কক্ষে বলে দেখতে পারো। গেলাম সেখানে। দায়িত্বরত সৌদি এক নারী, অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে টিকিট প্রিন্ট করে দিল, হোটেলের প্রিন্টার দিয়ে। দিয়ে বলল, স্যার, ভালো রিভিউ দেবেন কিন্তু।
অবশ্যই। হোটেলের নিচতলায় অনেকগুলো দোকান। সেখানে বাংলাদেশিদেরও দোকান আছে। ছেলে বলল, বাবা, আমার কাছে কিছু সৌদি রিয়াল আছে। ওগুলো দিয়ে বন্ধুদের জন্য গিফট কিনে ফেলি?
কেনো।
হঠাৎ সে দৌড়ে এসে বলল, বাবা, তাড়াতাড়ি এসে আরেকটা পারফিউম কিনব। একটা বাংলাদেশি দোকান থেকে। আমি তো ভালো দামদর করতে পারি না, তুমি এলে ভালো হয়।
গেলাম বাংলাদেশিদের দোকানে। ছেলে একটা পারফিউম পছন্দ করল, দামও ঠিক করল কিন্তু স্টকে নেই, শুধু টেস্টার আছে। আমি বললাম, তাহলে টেস্টারই দিয়ে দেন। দেখলাম বোতল প্রায় ভর্তি। ২০% দাম দিয়ে দিল দোকানদার। ছেলে খুশি। মেঘ না চাইতেই জল।
বিকেল পাঁচটায় ট্যাক্সি এল। বাংলাদেশি চালক আমাদের জেদ্দা বিমানবন্দরে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আমরা ফ্লাই করব লন্ডনে। ট্যাক্সিতে উঠেই ছেলে বলল, সে জাপানি খাবার অর্ডার দিতে চায় অনলাইনে। ওরা ডেলিভারি দেবে জেদ্দা বিমানবন্দরে। তাকে বললাম, এই খাবার না খেলে হয় না? ব্যাগপত্র, চেকইন, কত ঝামেলা, তারপর আমরা কখন জেদ্দা পৌঁছাব, একই সময়ে ডেলিভারিম্যান উপস্থিত থাকতে পারবে কি না!
না, ছেলে নাছোড় বান্দা, এই খাবার তাকে খেতেই হবে, এটা ব্রিটেনে নেই।
যাক, সে খাবারের অর্ডার দিল। আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই ডেলিভারিম্যান ফোন দিল আমার ছেলেকে। ছেলে ভয়ে মোবাইল ধরিয়ে দিল আমাকে-বাবা, তুমি কথা বলো, আমি তো আরবি জানি না।
আরে, আরবি তো আমিও জানি না। অগত্যা আমাদের চালককে ফোন দিয়ে বললাম-ডেলিভারিম্যানের সাথে কথা বলো। জিজ্ঞেস করো কোন দিকে আছে। আমাদের লোকেশন দাও।
আমাদের বাংলাদেশি চালক ২–৩টা বাক্য আরবিতে বলার পর, হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলল-আরে, আপনিও তো দেখছি বাংলাদেশি?
সৌদি আরবে গেলে একটা মজা কী, ১০ জন লোক হাঁটতে দেখলে, ২ জন বাঙালি পাবেন। ইংরেজি জানেন না, সমস্যা নেই। বাংলাভাষীরা সর্বত্র। বিদেশে বাংলা ভাষায় কথা বলার মজাই আলাদা। ছেলে জাপানি খাবার পেয়ে খুশি। অতঃপর বিমানবন্দরে ঢুকেই প্রথমে বিমানের কাউন্টারে গেলাম। স্মার্ট নারী কর্মী ভালো ইংরেজি বলে, সৌদি নারী। সে বলল, আমাদের ভিসা যেহেতু ভিজিট ভিসা, আমরা জমজম ওয়াটার লন্ডন নিতে পারব না। পয়সা দিয়েও। এটা শুনে স্ত্রী খুব আপসেট। কী আর করা। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না। ওমরাহ ভিসায় গেলে আমরা ফ্রিতে ৫ কেজি জমজম ওয়াটার নিতে পারতাম। আমাদের ট্যুরিস্ট ভিসা।
ইমিগ্রেশন পাস করে ভেতরে ঢুকলাম। মনিটরে দেখলাম-আমাদের ফ্লাইটের ১ ঘণ্টা বিলম্ব হবে। কী করা। আমাদের পাশে এসে বসলেন দুই বাংলাদেশি ভাই। ৮ বছর পর দেশে যাচ্ছেন। তাদের সাথে গল্প শুরু করলাম। হঠাৎ স্ত্রী বলল-চা খাবে। একটা ক্যাফেতে গিয়ে চা নিয়ে এল। এসে হাসতে হাসতে বলল-দেখো, কেমন অদ্ভুত চা দিছে। কাপে কোনো চায়ের লিকার-ই দেয়নি।
সম্ভবত ভুলে দেয়নি। আমি বললাম।
সৌদিপ্রবাসী এক ভাই বললেন-আপনি সম্ভবত বোঝাতে পারেন নাই। আসেন, আমি যাই, আরবিতে বললে বুঝবে। তারপর তারা দুজন, তথাকথিত চা নিয়ে, ক্যাফের দিকে গেলেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন নতুন চা নিয়ে। নতুন চা নিয়ে এসে, আমার স্ত্রী আবারও হাসতে লাগল।
ব্যাপার কী!
আরে, এবার যেটা দিছে, সেটা হলো মাঠা। গাঢ় দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে দিয়ে দিছে। আবারও লিকার দেয়নি। খেয়ে দেখলাম, ঘটনা সত্য। অতঃপর এই তথকথিত চা নিয়ে আমি রওনা দিলাম ক্যাফের দিকে। কর্মরত ভারতীয় চা মেকারকে বললাম-চাপাতা ছাড়া চা হয়?
হয়।
সে আমার সাথে তর্ক শুরু করে দিল। এমন অভিনব বিষয় আমি জীবনে কম দেখেছি। তাকে আমি বললাম-দেখো, আমাকে আবার চা দিতে হবে না। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গেছি, নিজেও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী, এমন চায়ের দেখা কোথাও পাইনি ভাই।
যাক, চা আর খাওয়া হলো না। আমরা বিমানবন্দর থেকে খাওয়া কিনলাম। বার্গার, রাব, পানি। আমার স্ত্রী বলল, আমাদের পাশেই বসা আছেন দুজন বয়স্ক বাংলাদেশি নারী, যাঁরা ওমরাহ করতে এসছেন, তাঁদেরও কিছু খাবার কিনে দিতে। তাঁদের জন্যও খাবার কিনলাম।
খাবার কিনে আনার পর দেখি, ফ্লাইট বিলম্ব হওয়ার কারণে, এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য হালকা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সেগুলোও নিলাম। ৭ ঘণ্টার যাত্রা। পথে খাওয়া যাবে।
ওহ, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। বোর্ডিং পাশ নেওয়ার সময় দেখলাম, আমাদের তিনজনের সিট তিন জায়গায়। একসাথে দেওয়ার অনুরোধ করলাম। ওরা বলল, সম্ভব না। তবে এক্সট্রা পয়সা দিলে চেষ্টা করতে পারি।
করো।
ওরা কয়েক মিনিট কম্পিউটার গুঁতাগুঁতি করে বলল, তিন সিট একসাথে দেওয়া যাবে। চার্জ ৩০ ইউরো।
সমস্যা নেই। নিয়ে নিলাম। কারণ আজকে মোটামুটি ফুল। খালি সিট পাওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। বিমান প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল। বিমান আকাশে উড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফেলে যাচ্ছি মক্কা, ফেলে যাচ্ছি মদিনা। আর ফেরা হয় কি না, কে জানে। কানে ভাসছে পবিত্র নগরীর মধুময় আজানের ধ্বনি। স্নিগ্ধ বাতাস। প্রার্থনায় মগ্ন থাকা মানুষ। কত বর্ণের। কত ভাষার। সৃষ্টিকর্তার কী এক অপূর্ব সৃষ্টি! এই পবিত্র নগরী। আবার যেন ফেরা হয়। আবার যেন প্রার্থনায় মগ্ন হই। আবার যেন ক্ষমার চাদরে ঢেকে যায় আমাদের চারপাশ। আমিন।