পবিত্র শহরে–১
মদিনা
বছরে একবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই। লন্ডন থেকে ইউরোপের কোনো দেশে বেড়াতে গেলে খরচ কম পড়ে। এবার স্ত্রী বায়না ধরল, তাদের সৌদি আরবে ওমরাহ করাতে নিয়ে যেতে হবে। ইউরোপের তুলনায় সৌদি আরবে যাওয়ায় খরচ বেশি। এর আগে ২০১৪ সালেও প্যাকেজে পরিবার নিয়ে ওমরাহ করতে গিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা ভালো নয়। স্ত্রী চাপ দিতে লাগল। মূল সমস্যা বাজেট। লন্ডনের এক ছোট ভাই (মামুন) বলল, উইজ এয়ার নামের একটি নতুন ফ্লাইট চালু হয়েছে লন্ডন টু সৌদি আরব, বেশ সস্তা। তবে ওই এয়ারলাইনস ‘টু স্টার’ ক্যাটাগরির। মোটামুটি ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে যেতে হয়, বসার জায়গা খুব টাইট। পরিবারের সদস্য তিনজন হলে, তিনজনকে তিন জায়গায় সিট দেয়। ঠান্ডায় একটা কম্বলও দেয় না। যদি এসব ঝামেলা করে যেতে পারেন, তাহলে ঠিক আছে।
অনলাইনে সার্চ করে দেখলাম, এই এয়ারলাইনসের বদনামের শেষ নেই। কিন্তু টিকিটের মূল্য এত কম যে মোটামুটি অন্য এয়ারলাইনসের অর্ধেক। ছেলে অনুভবকে বললাম, ঝুঁকি নেব কি না? ১৮ বছর বয়সী ছেলে বলল, রিস্ক নিয়ে নাও বাবা। সৌদি পৌঁছালেই তো হলো। গ্যাঞ্জাম যা–ই হোক। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। আমরা তিনজন ওমরাহ করতে যাব সৌদি আরবে এবং তা ওই বদনামওয়ালা এয়ারলাইনসেই, চ্যালেঞ্জ।
অনলাইনে ৭৫০ পাউন্ড (১ লাখ ২৩ হাজার টাকা) দিয়ে তিনটি রিটার্ন টিকিট করে ফেললাম। লন্ডন টু মদিনা। জেদ্দা টু লন্ডন। থ্রি স্টার হোটেলও বুক দিলাম, বুকিং ডটকমে। মদিনার হোটেল মসজিদে নববি থেকে দুই মিনিট হাঁটার পথ, তবে মক্কার হোটেল হারাম শরিফ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটার পথ। তবে হোটেলের শাটল বাস সার্ভিস আছে ফ্রি, যেতে লাগে পাঁচ মিনিট।
এদিকে মদিনায় থাকা এক ছোট ভাই কুতুব উদ্দিন চৌধুরীকে ফোন দিয়ে বললাম, আমাদের জন্য তিনটি ট্রেনের টিকিট করতে পারবে কি না (মদিনা টু মক্কা)। কুতুব ঝড়ের গতিতে তিনটি টিকিট কেটে হোয়াটসঅ্যাপে লিংক পাঠিয়ে দিল। এখন রেডি। বউ ব্যাগপত্র গোছাতে লাগল। মনে ভয়। দ্বিতীয় শ্রেণির এয়ারলাইনস, জানি না কোন দুর্গতিতে পড়ি। সস্তার তিন অবস্থা হয় কি না।
টেনশন নিয়ে বাসা থেকে বেরোলাম। তখন দুপুর। ব্রিটেনের আবহাওয়া আজ বেশ ভালো। না ঠান্ডা, না গরম। ছেলেকে বলেছিলাম ট্যাক্সি ডাকতে রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য। ছেলে বলল, বাসা থেকে রেলস্টেশনে যেতে ট্যাক্সিতে ১০ পাউন্ড (১ হাজার ৬০০ টাকা) লাগবে। তার এক বন্ধুকে পাঁচ পাউন্ড দিলে স্টেশনে নামিয়ে দেবে।
ওকে, তাকে ডাকো।
ছেলের বন্ধু পাঁচ পাউন্ডের বিনিময়ে আমাদের রেলস্টেশনে নামিয়ে দিল। ট্রেন দিয়ে ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর গ্যাটউইক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগল ২০ মিনিট। তিনজনের ভাড়া ১৮ পাউন্ড। যুক্তরাজ্যে ট্রেনের ভাড়া অনেক বেশি। ২০ মিনিটের পথ। জনপ্রতি ভাড়া এক হাজার টাকা। পিকটাইমে গেলে আরও বেশি। জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা। ব্রিটেন দেশটা এমন, যেখানে রোজগার বেশি, খরচও বেশি।
মদিনায় তিন দিন থাকলাম। সুন্দর ও পরিপাটি শহর। অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে দেখেছি প্রচণ্ড গরমে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে। তখন মনটা হু হু করে উঠেছে। তাঁরা মরুভূমির দেশে ঘেমে আমাদের জন্য অর্থ উপার্জন করেন। যাঁদের ঘামের ওপর দেশ দাঁড়িয়ে।
যাক, রেলস্টেশনের ওপরেই বিমানবন্দর। ঢুকতে পাঁচ মিনিট লাগে। আমরা বিমানবন্দরে প্রবেশ করলাম। প্রথম ভাবলাম, পাউন্ড ভাঙিয়ে কিছু সৌদি রিয়াল নিয়ে নিই। সৌদিতে নেমে ট্যাক্সিওয়ালাকে তো ভাড়া দিতে হবে। একটা মানি এক্সচেঞ্জে গেলাম। পাউন্ডের রেট শুনে থ হয়ে গেলাম। বলে কী! যেখানে এক পাউন্ড দিলে পাঁচ সৌদি রিয়াল পাওয়া যায়, সেখানে এক্সচেঞ্জ বলেছে ৩ দশমিক ৫ রিয়াল। পাউন্ড ভাঙালাম না। ভাবলাম, মদিনা বিমানবন্দরে ভাঙাব।
বোর্ডিং কার্ড হাতে পেলাম আর ভাবলাম, ছোট ভাইয়ের কথাই ঠিক হলো—আমাদের তিনজনকে সিট দিয়েছে তিন মাথায়। মেজাজ একটু বিগড়ে গেল, কিন্তু মাথা গরম করা যাবে না, জেনেশুনেই তো বিষ পান করেছি। কিন্তু প্লেনে ঢুকে পরিস্থিতি পুরোই বদলে গেল। অনেক সিট খালি। আমরা খালি সিট দখল করে মোটামুটি নাক ডেকে ঘুমিয়ে মদিনা পৌঁছালাম ভোর সাড়ে চারটায়। সাড়ে ছয় ঘণ্টার জার্নি। বিমানে কম্বল দেবে না জেনে আমরা শীতের কাপড় সঙ্গে নিয়েছিলাম মরুভূমির উত্তপ্ত নগরী ভ্রমণে। যার ফলে বিমানের ঠান্ডা আমাদের কাবু করতে পারেনি।
মদিনা বিমানবন্দর নেমে তো অবাক। হিজাব পরা মেয়েরা ইমিগ্রেশন অফিসার! মুখ ঢেকে বসে আছে। অথচ ২০১৪ সালে যখন সৌদি ভ্রমণ করি, তখন কোথাও কোনো নারীর দেখা মেলেনি। আমি এক নারী কর্মকর্তার ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের ডকুমেন্ট চেক করে আবার পরক্ষণে পাশে দাঁড়ানো পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে কী কী যেন আলাপ করেন আরবিতে, তা বুঝতে পারিনি। এদিকে স্ত্রী ও ছেলে দ্রুত ইমিগ্রেশন শেষ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমার কর্মকর্তা ধীরগতি সম্পন্ন। একটু বিরক্ত হলাম, কিন্তু তা প্রকাশ করলাম না। এসেছি একটা ভালো উদ্দেশ্যে, তাই রাগান্বিত হওয়া যাবে না।
ইমিগ্রেশন পাড়ি দিয়ে গেলাম মানি এক্সচেঞ্জে। আমার সামনের দুজন মুদ্রা বদল করল। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি কাউন্টারে যেতেই বলল, তাদের কাছে পর্যাপ্ত সৌদি রিয়াল নেই। এখন আর বিনিময় হবে না। আবার হতাশ হলাম। পরে আর কী করা, লন্ডনের ডেবিট কার্ড দিয়ে ক্যাশ পয়েন্ট থেকে টাকা তুললাম এবং কিছুক্ষণ পর টের পেলাম, সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে আমার অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে রেখেছে ব্যাংক। এদিকে ছেলে ও স্ত্রী গিয়েছিল ফজরের নামাজ পড়তে, ফেরার খবর নেই। মেজাজ চড়া হলো। বসে বসে অপেক্ষা করলাম, তারপর একজন একটা জায়নামাজ দিল, বিমানবন্দরের উন্মুক্ত স্থানেই নামাজ পড়লাম। ওরাও নামাজ পড়ে ফিরল। তারপর গেলাম ফোনের সিমকার্ড নিতে। তিনজনের জন্য তিনটি সিম নিলাম। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেখি ট্যাক্সিওয়ালাদের ডাকাডাকি। বাংলাদেশি স্টাইলে। অথচ ২০১৪ সালে যখন সৌদি এসেছিলাম, তখন ট্যাক্সি না পেয়ে ৪০ ডিগ্রি গরমে অনেক ঘামতে হয়েছিল। বাজে অভিজ্ঞতা। এখন পুরোই অন্য রকম। লন্ডন থেকে রওনা হওয়ার আগে একজন বলেছিলেন, সবুজ ট্যাক্সি নেবেন, মদিনায় এই ট্যাক্সি বিশ্বস্ত। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সবুজ ট্যাক্সি খুঁজলাম। দেখলাম, কোথাও বাংলাদেশি ড্রাইভার আছে কি না। সবুজ ট্যাক্সি পেলাম, কিন্তু বাংলাদেশি ড্রাইভার পেলাম না। পেলাম পাকিস্তানি ড্রাইভার। তখন সকাল আটটা। মদিনার তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি। খারাপ লাগছে না। ঝকঝকে সকাল। চারদিক ছবির মতো সাজানো। আহা দেশ। যারা কয়েক যুগ আগেও দরিদ্র ছিল, প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। আমাদের পাকিস্তানি ড্রাইভার ইংরেজি ভালোই জানে। পাকিস্তানের রাজনীতি ও সৌদি–জীবনের গল্প করতে করতে আমরা নিমেষেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। মদিনা এয়ারপোর্ট থেকে মসজিদে নববি আধা ঘণ্টার পথ। হোটেলে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে আটটায়। হোটেলের নাম গোল্ডেন টিউলিপ। অনেক বাঙালি কর্মী সেখানে দেখতে পেয়ে দেশের একটা ফ্লেভার পেলাম। খুব ভালো লাগছে। হোটেলটা ভালোই, কিন্তু পুরো ভালো নয়। আমরা ট্রিপল রুম বুক করেছি। ওরা ডাবল রুমে একটা এক্সট্রা বেড দিয়ে দুই নম্বরি করেছে। খুব কনজাস্টেড। আপত্তি করায় অন্য আরেকটা রুম অফার করল। গিয়ে দেখি, সেই রুমের অবস্থা একই। কী আর করা। সবকিছু তো আর মনের মতো হয় না। সকালের নাশতা খেতে বাপ–ছেলে হোটেলের রেস্তোরাঁয় গেলাম। ৮০ রিয়াল দিয়ে যে নাশতা খেলাম, মনে হলো পুরো টাকাই জলে গেল। রুমে ফ্রেশ হয়ে যখন মসজিদে নববিতে গেলাম, মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২–৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই পবিত্র মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণে আনসার ও মুজাহিদরা একত্রে সাত মাস কাজ করেছিলেন। এখানেই শায়িত আছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। নামাজ পড়ে হোটেলের বাংলাদেশি কর্মী ভাইদের মাধ্যমে জেনে নিলাম বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর অবস্থান। গেলাম খেতে। এটাই নাকি মদিনার সবচেয়ে অভিজাত বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। নাম সোনারগাঁ রেস্তোরাঁ। গিয়ে দেখি পরিপাটি রেস্তোরাঁ, সার্ভিসও ভালো। কিন্তু খাওয়ার মান বেশ খারাপ। দুজনের বিল এল ৯০ রিয়াল (তিন হাজার টাকা)। ছেলে ভাত খেতে রাজি নয়। সে অনলাইনে অর্ডার করে হোটেলে খাবার এনেছে। পরদিন ছোট ভাই কুতুব উদ্দিন চৌধুরী নিজে রান্না করে দুপুর ও রাতের খাবার পাঠিয়েছে হোটেলে। কুতুবের রান্না দারুণ। কুতুবকে বললাম, রেস্তোরাঁ খোলো। এই হাতের রান্নায় রেস্তোরাঁ ভালো চলবে। সৌদি আসার আগে আমরা জেনেছি, হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজা মোবারকের কাছে যেতে হলে অনলাইনে বুক করতে হয়। সৌদি সরকারের একটা অ্যাপস আছে, নাম নুসুক (Nusuk)। ওটা আগেই আপলোড করে রেখেছিলাম। আমি ও আমার ছেলে অ্যাপসে ঢুকে বুক পারমিট পেলাম, কিন্তু স্ত্রীরটা পাওয়া গেল না। নারীদের ওখানে ভিড় বেশি। আমার স্ত্রীর মন খারাপ হলো। কিন্তু কী আশ্চর্য! পরদিন কুতুব বলল, সে আমার স্ত্রীর জন্য পারমিট এনে দিতে পারবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ব্যবস্থা করে দিল। এখন স্ত্রীও খুশি। তিনজনই জিয়ারত করলাম। হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজা মোবারকের পাশে গেলে মন অন্য রকম হয়ে যায়। আবেগঘন ও অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে মন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব এখানে শায়িত। সালাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
প্রতিদিন মসজিদে নববিতে গিয়ে নামাজ পড়ি। ফ্রি জমজমের পানি খাই। দারুণ প্রশান্তি। দুপুরে গরম থাকে। আগস্টে দিনের বেলায় গরম ৪০ ডিগ্রির মতো। বিকেলে কমে যায়। বিকেলের হাওয়া দারুণ। মসজিদে নববির প্রশস্ত আঙিনায় হাঁটলে মনে হয়, স্বপ্নের মধ্যে হাঁটছি। পবিত্র নগরীর বাতাস আসলেই মোহনীয় ও মায়া মায়া।
তারপর চারদিকে বাংলাদেশি লোকজন—হোটেল, মসজিদ ও দোকানে। বাংলাদেশ বাংলাদেশ লাগে। একধরনের ভালো লাগা। যেখানে–সেখানে বাংলা খাবার। একদম ডালপুরি, পেঁয়াজু ও মিষ্টি পর্যন্ত। বললে হোটেলেও ডেলিভারি দেয় কেউ কেউ। তবে মদিনার মসজিদে নববি ও মক্কার হারাম শরিফে শুক্রবারের জুমার নামাজ পড়তে গেলে সকাল ১০টার মধ্যে যেতে হয়, তা না হলে জায়গা পাওয়া কঠিন। প্রচণ্ড গরমে বাইরে নামাজ পড়া অনেক কঠিন। আমি জুমার নামাজ পড়তে যাই বেলা সাড়ে ১১টায়। গিয়ে দেখি মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেছে। লোকজন এখন মসজিদের ছাদের ওপরে যাচ্ছে। সৌদি এক সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওপরে এয়ারকন্ডিশন আছে কি না? জবাবে বলল, আছে।
কয়েক তলা বেয়ে ওপরে উঠে দেখি, ছাদে নামাজের বিশাল আয়োজন, কিন্তু কোনো এয়ারকন্ডিশন নেই। ফ্যান আছে, কিন্তু তা গরম নিবারণে একদমই যথেষ্ট নয়। রোদ ও গরমে সেদ্ধ হওয়ার উপক্রম। আমি গরম সহ্য করতে পারি না। দেখি, অসুস্থ বোধ করছি। দ্রুত ছাদ থেকে নামতে শুরু করলাম। এক জায়গায় দেখি, সিঁড়িতেই কেউ কেউ বসে পড়েছেন। এখানে গরম কিছুটা কম। আমিও বসলাম। কিছুক্ষণ পর সিকিউরিটি সবাইকে তুলে দিল। তারা কোনো অনুরোধ রাখে না। সবাই ইংরেজিও বুঝে না। কী মুশকিল।
প্রচণ্ড গরম ও টেনশনে আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হলে বেরোনোর পথ দেখি না। ভয়ে ভয়ে আবার নিচে নামলাম। হঠাৎ একটা জায়গা পেয়ে গেলাম মসজিদের বাইরে। এখানে তুলনামূলক কম গরম, একটু ছায়াও আছে, যাক রক্ষা। আমার হাতে পানির একটি ছোট বোতল। একটু একটু খাই, কিছুটা রাখি, যাতে পানিশূন্যতায় না মরি। হঠাৎ পাশের এক লোক আমার কাছে পানি চেয়ে বসল। দিলাম বোতল। বললাম খাও, তবে আমার জন্য একটু রেখো। যাক, এই জায়গা ছাদ থেকে অনেক ভালো। এখানেই জুমার নামাজ আদায় করলাম।
পরদিন বাঙালি এক ট্যাক্সিচালক ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন খেজুরবাগানে এবং পরে কিবলা মসজিদে। কিবলা মসজিদ খুবই নান্দনিক মসজিদ। দেখে অভিভূত হলাম। এই মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায়ই মহানবীর কাছে নির্দেশ আসে, কিবলা পরিবর্তনের। জেরুজালেমের আল–আকসা মসজিদের পরিবর্তে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতে। তখনই কিবলা বদলে গেল।
আমরা তিনজন প্রতিদিন মসজিদে নববিতে নামাজ পড়ি। কখনো রুমে এনে খাবার খাই। কখনো বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয়। হোটেলের এক বাংলাদেশি কর্মী নতুন এক বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর সন্ধান দিলেন। ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম। ১০ রিয়াল ভাড়ার বদলে ২০ রিয়াল নিল। সে ইংলিশ বুঝে না, অ্যারাবিয়ান। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ পেলাম, কিন্তু তা দেখে খুব পছন্দ হলো না স্ত্রী ও ছেলের। এক–দুটি মাছিও উড়তেছে। এই ৪০ ডিগ্রি গরমে আর কোথায় গিয়ে খুঁজব বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ! স্ত্রী ও ছেলে বাধ্য হলো এখানে বসতে। খাবার অর্ডার দিলাম মাছ, মাংস, ডাল ও সবজি। খাবার খারাপ নয়। সেই সঙ্গে দই ও মিষ্টি আছে। সব খেলাম। তারপর বিল দিতে যাব, অমনি দেখি গরম ডালপুরি ও সমুচা ভেজে তাকে সাজাচ্ছে, লোভ হলো। বিকেলের নাশতার জন্য সমুচা ও ডালপুরিও কিনলাম। রেস্তোরাঁর এক কর্মী, তার বাড়ি কুমিল্লায়। সে বলল, আপনাদের হোটেল তো কাছেই, ট্যাক্সি নেওয়ার দরকার নেই। আসেন, আপনাদের শর্টকাট পথ দেখিয়ে দিই। এই বলে সে অনেকটা পথ আমাদের সঙ্গে এল। তাকে কয়েক রিয়াল টিপস দিলাম। সে খুশি। আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে বলল, যখনই খাবারের প্রয়োজন পড়বে আমাকে ফোন দিয়েন, হোটেলে পৌঁছে দেব।
পরদিন তাকে ফোন দিয়ে খাবার ও নাশতা এনেছিলাম। সব খেতে পারিনি। যা রয়ে গিয়েছিল, তা হোটেলের বাংলাদেশের কর্মীদের দিয়েছিলাম খেতে। তারাও খুশি। একজনকে পেলাম, তার বাড়ি শ্রীমঙ্গল। যখন বুঝতে পারল আমিও সিলেটী, তখন মনের আনন্দে নিজের সুখ–দুঃখের গল্প শেয়ার করতে লাগল। বলল, সৌদি তার গন্তব্য নয়, সে এখান থেকে পর্তুগালে পাড়ি দেবে।
মদিনায় তিন দিন ছিলাম। মদিনা খুবই সুন্দর, পরিপাটি শহর ও প্রশান্তিময় জায়গা। তবে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে যখন দেখেছি প্রচণ্ড গরমে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে, তখন মনটা হু হু করে উঠেছে। তারা মরুভূমির দেশে ঘেমে ঘেমে আমাদের জন্য অর্থ উপার্জন করে। যাদের ঘামের ওপর দেশ দাঁড়িয়ে। যাদের ঘাম ও শ্রমকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কিছু মানুষ। কিন্তু কেন করে! তাদেরকে সম্মান দিলে আমরা ছোট হয়ে যাব! অদ্ভুত আমাদের মানসিকতা।
আজ ৩০ আগস্ট ২০২৫। আমরা মদিনা থেকে মক্কা যাব। মক্কা থাকব পাঁচ দিন। তারপর লন্ডন। এই তিন দিন মদিনায় থেকে মদিনার জন্য মায়া জন্মে গেছে। মদিনা ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে। তিন দিন মদিনায় থাকার পর আমরা যখন মক্কার ট্রেন ধরব, হোটেল থেকে বেরোলাম, তখন আবার মনটায় কষ্ট লাগতছে। এই তিন দিনে হোটেলে কর্মরত বাংলাদেশি ভাইদের সঙ্গে উঠতে নামতে কথা বলেছি এবং মতবিনিময় হয়েছে। এখন তাদের রেখে যেতে মন খারাপ লাগছে। কে জানে আর দেখা হয় কি না। জীবন তো এ রকমই! নাকি! চলবে...