গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: কানাডা পর্ব ৬
এত দিনের অভিজ্ঞতায় যা বলেছি, সব গ্রীষ্মের সময়কার। গাড়ি শীতের শেষে কেনা হলেও রাস্তায় নেমে যখন চালিয়েছি তখন বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মকাল। তবে শীতের সময়ে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি এর দেখভালের দায়িত্বও বেশ কষ্টের, পরিশ্রমের। সকালে উঠে গাড়িতে জমে থাকা পুরু বরফের আস্তরণ সরাতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। কানাডিয়ানরা এ একটা কাজকে যথেষ্ট বিরক্তির চোখে দেখেন! মনে পড়ে একদিন সকালে ওয়ালমার্টে গিয়ে টেবিলে বসে সকালের জলখাবার খাওয়ার সময় হেদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সকালের শুরুটা কেমন? উনি উত্তরে বলেছিলেন, ওনার বরফ সরাতে অসহ্য লাগে। তবে একই কথা আরও অনেকরই মুখে শুনেছি!
এমনও সময় গেছে যখন কয়েক ধাপে বরফ সরিয়ে পরিষ্কার করতে হয়েছে আমাদের। সকালে কিছুটা, বিকেলে বাকিটা। আশেপাশের বরফের পাহাড় সরিয়ে দিতে মালিকের ভাড়া করা গাড়ি এসে পরিষ্কার করে যাবে। কিন্তু পাশাপাশি রাখা গাড়িগুলোর দায়িত্ব নিজেদের। তবে সকালে যদি কেউ সশরীর উপস্থিত থেকে গাড়ি সরিয়ে জায়গা করে দেন, তাহলে ওই জায়গাও গাড়ি পরিষ্কার করে দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এত সকালে ঘুম ভেঙে উঠবেন কে? পরে ওই বরফ সরাতে অনেক কসরতের প্রয়োজন হয়। পুরো এক সপ্তাহের ব্যায়াম একদিনেই হয়ে যায়!
একদিন বিকেলে পরিষ্কার আকাশ দেখে কাজে চলে গেছি। ওই রাতে ভয়ংকর তুষার ঝড়ের আভাস দেওয়া হয়েছিল। সেটা খেয়াল করলেও ভেবেছিলাম অতটা আর কী হবে? পূর্ব অভিজ্ঞতার কমতি থাকলে যা হয়! তবে এ সমস্ত ক্ষেত্রে কাজে একবার বের হয়ে গেলে ফেরার পথের দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের। অধিকাংশ সময়ই সবাই যা করে, সেটা হলো অফ ডিউটি বা কল অফ। ঝামেলা শেষ! ওই রাতে কাজের কারণে অন্য কিছু ভাবিনি। কাজ শেষে বের হব, তখন ওই রাতের ডিউটি ম্যানেজার গাসি বললেন, বাইরের অবস্থা বেশ খারাপ। খুব সাবধানে, যতটা ধীরগতিতে পারা যায় গাড়ি চালাতে।
ওর কথায়ও ততটা ভয় পাওয়ার মতো কিছু হবে বলে একদম মনে হয়নি। মেইন গেটের সামনে এসে দেখলাম চারপাশে তুষারের কার্পেট বিছানো, অনবরত হিম বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে। গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। গাড়িতে চড়ে বসলাম। সামনের গ্লাসের উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের গতি বাড়িয়ে দিলাম। পতপত শব্দে ওয়াইপার চলতে লাগলো। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার পরও ভাবছিলাম কীভাবে পাড়ি দেবো এই দুর্লঙ্কা সাগর? দুগ্গা দুগ্গা বলে প্যাডেলে চাপ দিয়ে রওয়ানা হলাম। রাস্তায় নেমে আশেপাশে কোন গাড়ি দেখছি না।
চারিদিকে বরফবৃষ্টি চলছে আর গতি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সামনে কিছুই দেখা যায় না। শুধুই সাদা সাদা তুলার মতো বরফ ঝরে পড়ছে। রাস্তায় কোনো দাগ, নির্দেশনা কিছুই দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে নির্ঘাত দুর্ঘটনায় পড়ব। উপয় না দেখে ইর্মাজেন্সি লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। এতে সুবিধা এই হয় যে আশপাশের কোনো গাড়ি আপনার কাছে ঘেঁষবে না। সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। গাড়ির গতি তখন ষাট-সত্তরের মধ্যে ওঠানামা করছে। শুধু সোজা চলেছি। পুরো রাস্তায় দুটো গাড়ির দেখা পেলাম। ওগুলো বেশ সর্তকতার সাথেই আমার গাড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অনেকটা অন্ধের মতো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি কবে শেষ হবে এ দুর্গম পথ? যখন আমরা বিপদে পড়ি তখন প্রতি সেকেন্ডকে মনে হয় এক এক ঘণ্টা! সময়ের গতি শ্লথ হয়ে আসে। ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়েই যাচ্ছি। সবই অস্পষ্ট, বলতে গেলে প্রতিদিনের চালানো থেকে আন্দাজ করতে পারছিলাম আশপাশের পরিবেশ।
এদিকে পুলিশের ভয়ও ছিল। ইর্মাজেন্সি লাইটের সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা এই যে পুলিশ এই লাইট দেখলে আপনার গাড়ি থামিয়ে অবশ্যই কারণ জানতে চাইবেন। আপনি সুস্থ শরীরে আছেন কি না, আপনার অন্য কোন শারিরীক সমস্যা হচ্ছে কি না এসবের খোঁজখবর নেবেন অফিসার। তাই ভাবছিলাম প্রায় পুরো রাস্তায় লাইট জ্বালিয়ে এসেছি। অবশ্য দুটো গাড়ি ছাড়া আর কিছুর আভাস পাইনি। তখনো ঠিক করিনি কোথায় গিয়ে লাইট অফ করব। এক্সিট ফাইভ পার হওয়ার পর বেশ লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। এরপরই সিডনির ওয়ালমার্টের রাস্তা। ঠিক ওখানে কাছাকাছি চলে যাওয়ার আগেই লাইট অফ করে দেব। ওই চৌমাথায় প্রায়শই পুলিশের গাড়ির আনাগোনা থাকে। ক্রমশ...