জীবনের গন্তব্য কোথায়, নির্ধারিত পথে না অবিরাম চেষ্টার মধ্যে

ছবি: প্রতীকী

জীবন ফুলশয্যা নয়, এটা জানার পরও মনে হলো শেয়ার করি জীবনের দীর্ঘ সময়ের কিছু অভিজ্ঞতা।

জীবন কখনোই শুধু আমাদের ইচ্ছার ওপর চলে না। আমরা ভাবি, আমরা লক্ষ্য স্থির করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্যই প্রায়ই আমাদের তৈরি করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে এই পথে এগোব, কিন্তু পথে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে শুরু করি যে অনেক কিছু আমাদের নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জীবনের উদ্দেশ্য যেন এক নির্ধারিত লক্ষ্য স্থির করা, কিন্তু সেই লক্ষ্য কখনোই শুধু একটি চূড়ান্ত বিন্দু নয়, বরং চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপকে পরীক্ষা করে, সংশোধন করে এবং নির্দেশ দেয়।

প্রথম পদক্ষেপেই আমরা কল্পনা করি কত সহজে পৌঁছানো যাবে, কত পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। পথচলা শুরু হয় এবং সঙ্গে আসে প্রতিদিনের প্রশ্ন, প্রতিটি বাধা এবং প্রতিটি পরাজয়। এই সংগ্রাম আজীবনের সংগ্রাম, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের শেখায়, আমাদের আকার দেয় এবং আমাদের ভাবনার সীমা প্রসারিত করে। এইভাবেই জীবন আমাদের শুধু গন্তব্য নয়, পথচলার নিজস্বতা শেখায়।

একটি কথা প্রচলিত আছে যে মানবজীবনের অনেক কিছুই নাকি পুনর্নির্ধারণ এবং কপালে যা লেখা থাকে তা হাজার চেষ্টা করলেও এড়ানো যায় না। সেই হিসেবে জন্মের শুরুতে আমরা যে লক্ষ্য স্থির করি অথবা অনেক ক্ষেত্রে যেগুলো আমাদের হয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, সেগুলো যে শতভাগ সফল হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, ভাগ্য নামের একটি অদৃশ্য শক্তি আছে এবং তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা যায় না।

তবে এটাও সত্য যে অতি চেষ্টা করলে একটি গাধা সাধারণ একটি ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারে, কিন্তু সে কখনো একটি রেসিং ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারবে না। প্রতিযোগিতায়ও তাকে হারানো যায় না। কিন্তু যদি সেই গাধার কপালে অন্য কিছু লেখা থাকে, যেমন সে একটি কর্মঠ গাধা হবে, তাহলে শুরু থেকেই তার ধরন, আচরণ এবং মনোভাব সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। সে যদি সেই পথেই বড় হয় এবং বিশ্বাস নিয়ে এগোতে থাকে, তবে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। যেমন একটি গাছ বড় হবে কি না, তা জন্মের শুরুতেই বোঝা যায় অথবা প্রথম তিনটি পাতাই তার সম্ভাবনার কথা বলে দেয়।

আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি স্বাভাবিক ঢেউ সব সময় কাজ করে। আমরা মানুষ, তাই অনুকরণ ও অনুসরণের অদৃশ্য এক শক্তি আমাদের পরিচালনা করে। এর প্রভাবে পরিবেশ, সমাজ এবং ক্ষণিকের অনুভূতিও বদলে দেয় আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এটি কোনো খারাপ অভ্যাস নয়, বরং স্বাভাবিক জীবনচলার একটি অংশ।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্বাস। আমরা জীবনে নানা কিছুর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করি। ধর্মীয়ভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস করি, পরিবার, মা–বাবা এবং শিক্ষকদের প্রতি বিশ্বাস করি এবং শেষ পর্যন্ত নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করি। আত্মবিশ্বাস নির্ভর করে বিষয়টির গুরুত্ব, পরিশ্রমের গভীরতা এবং মানসিক প্রস্তুতির ওপর। কিন্তু যদি কপালে তা না লেখা থাকে, তাহলে শত চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায় না। এই সত্য অস্বীকার করা যায় না।

আরও পড়ুন

জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে এই সত্য আমার কাছে বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, বহু রাত ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে একটি শিক্ষা শেয়ার করা যায়। হয়তো কারও কাছে তা গ্রহণযোগ্য লাগবে, আর না লাগলেও ক্ষতি নেই। কারণ কথায় আছে, বিশ্বাসে মেলে বস্তু, তর্কে বহুদূর।

একবার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমার এক সহকর্মী প্রতিদিন পরিশ্রম করতেন, পরিকল্পনা করতেন, প্রচেষ্টা দিতেন, কিন্তু ফল পাচ্ছিলেন না। আরেকজন সামান্য চেষ্টায় সঠিক পথ পেয়ে গেলেন এবং দ্রুত এগিয়ে গেলেন। তখন বুঝেছি, পথ নির্বাচনই কখনো কখনো প্রচেষ্টার চেয়েও বড় সত্য।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি জীবনে অনেক কিছু চেয়েছি, তীব্র চেষ্টা করেছি, স্রষ্টার কাছে বহু প্রার্থনা করেছি। কিন্তু তারপরও সফল হইনি। আবার এমন কিছু পেয়েছি, যা চাওয়ার আগেই এসে গেছে অথবা যেগুলো পাওয়ার আশা করিনি, সেগুলোই সহজে পেয়ে গেছি। কিছু ক্ষেত্রে ভালো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক চাপ কিংবা আর্থিক সংকটের কারণে সফল হওয়া যায়নি। আজ ফিরে দেখি, এ সবকিছুরই একটি গভীর কারণ ছিল।

এখন মনে হয়, শুরু থেকেই আমাদের প্রার্থনাটি হওয়া উচিত ছিল এমনভাবে,

হে রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাকে প্রতি মুহূর্তে পথ দেখাও সেই পথে চলতে, যেটা তুমি আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছ। এমন একটি পথ, যা আমাকে শান্তি দেবে, আনন্দ দেবে এবং আমার আত্মাকে সঠিক স্থানে পৌঁছে দেবে।

কারণ, বহু চেষ্টা সত্ত্বেও যখন সফলতা আসে না, তখন বোঝা যায় যে চাওয়া পথটি হয়তো আমাদের জন্য নির্ধারিত ছিল না। বরং যে পথের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়, সেই পথই মানুষকে তার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। যারা সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত পথের জন্য প্রার্থনা করে এবং সেই বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে, তারা জীবনের গন্তব্যে সবচেয়ে সহজে পৌঁছাতে পারে। তারা শুরুতেই সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, প্রতিভার বিকাশ ঘটায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং মনের বাসনাও পূর্ণ হয়।

মানুষের চাওয়ার পেছনে আসলে তিনটি স্তর কাজ করে।

প্রথম স্তর: মানুষ চায় কারণ চাওয়া তার ভেতরের স্বাভাবিক স্পন্দন। জন্মের পর থেকেই মানুষের ভেতরে একটি অদৃশ্য আকর্ষণ থাকে সম্ভাবনার দিকে, আলোয়ের দিকে, নিজের ভবিষ্যৎকে নিজের মতো গড়ার দিকে। ভাগ্য কী দেবে, তা সে জানে না, কিন্তু এই চাওয়ার ভেতরেই সে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে।

দ্বিতীয় স্তর: মানুষের পরিপার্শ্ব তাকে প্রভাবিত করে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, বন্ধুবান্ধব, অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে মানুষকে কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করতে শেখায়। অনেক সময় একজন মানুষ যা চায়, তার একটি বড় অংশই অন্যদের প্রত্যাশা থেকে জন্ম নেয়। অর্থাৎ মানুষের চাওয়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং গঠিত পরিবেশের চাপ এবং স্নেহের মধ্যেই।

তৃতীয় স্তর: ভাগ্য চাওয়া এবং ফলাফলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। মানুষ ভাবে সে কিছু চাইছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পায় শুধু তা নয়, পায় যা তাকে পূর্ণতা দেয়। কারণ, ভাগ্য কখনোই শুধু ইচ্ছার প্রতিফলন নয়, বরং মানুষের অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম, ব্যর্থতা এবং অর্জনকে একত্র করে তাকে এমন জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে তার পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

এই জন্যই বলা যায়, শেষ পর্যন্ত মানুষ পায় না শুধু যা সে চেয়েছিল, পায় যা তাকে পূর্ণতা দেয়।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]