ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা: সমাধান আছে, কিন্তু সেটা চাই কি না-২
৪. এক থেকে তিন বছর
এবার আসা যাক মধ্যম মেয়াদে কী কী কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন। এ কার্যক্রমগুলো প্রথম ছয় মাসেই নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, আইন পরিষদ এবং প্রয়োজনে সংসদে প্রস্তাব করে পাস করিয়ে নিতে হবে।
একটি বিশেষ কার্যক্রম প্রথম ছয় মাসের শেষ দিক থেকেই হাতে নিতে হবে। সেটা হলো ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ বাহিনীকে স্বশাসিত একটি আধুনিক বাহিনীতে রূপ দেওয়া যায় কি না, সেটা পর্যালোচনা করে আইন পাস করা। এ বাহিনীর কাঠামো, বেতন ও ভাতা, পোশাক–পরিচ্ছদ, প্রশিক্ষণ, নিয়মানুবর্তিতা—সবই হবে আন্তর্জাতিক মানের।
প্রথম দুই বছর এ বাহিনীর প্রশিক্ষণ সামরিক পুলিশ (ট্রাফিক) দিয়ে করা যেতে পারে।
ক.
প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর বিভিন্ন প্রশাসনে চাকরিরত সব চালককে ঢাকার সড়কে যানবাহন চালানো ও চলাচলের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার চালকদের এ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। এ প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। প্রশিক্ষণের পর তাঁদের লাইসেন্সে এ প্রশিক্ষণের টোকেন সংযুক্ত হবে। তৃতীয় পর্যায়ে ঢাকা শহরের চালকদের জন্য বিশেষ লাইসেন্সের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অর্থাৎ দেশের অন্য স্থান থেকে লাইসেন্স নিয়ে ঢাকায় গাড়ি চালানো যাবে না। এ–সংক্রান্ত একটি বিশেষ পরিদপ্তর চালু করতে হবে এবং প্রথম পাঁচ বছর সামরিক বাহিনীর আওতাধীন রেখে এর কার্যক্রম সম্পূর্ণ আধুনিক, মানসই ও দুর্নীতিমুক্ত করার প্রস্তাব করছি আমি। চতুর্থ ও শেষ পর্যায়ে ঢাকার সব চালককে এ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। এরপর বিশেষ লাইসেন্স ব্যতীত ঢাকায় গাড়ি চালানো যাবে না। এর অন্যথায় বড় অঙ্কের জরিমানা হবে।
খ.
তিন মাস থেকে এক বছরের কার্যক্রমগুলো পর্যালোচনা করে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ নজর দেওয়া হবে রাজধানীতে যাত্রী পরিবহনব্যবস্থার ওপর, মালামাল পরিবহনের ওপর, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী পরিবহনের ওপর এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনার ওপর।
গ.
এ পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহনব্যবস্থা, টার্মিনাল এবং এ–সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করা হবে।
ঘ.
ঢাকা শহরে দিন ও রাত্রে যত্রতত্র বাস, ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহন যাতে পার্কিং না করতে পারে, সেটার বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা হবে। এতে যানজট কমে যাবে, মানুষের চলাচলের সুবিধা হবে, নিরাপত্তা বেড়ে যাবে, দুর্ঘটনা কমে যাবে।
ঙ.
ঢাকা শহরে সড়ক পারাপারের নিরাপদ ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। প্রতি ২০০ বা ৩০০ মিটার পরপর, প্রতিটি মোড়ে, চার রাস্তার মোড়ে ইত্যাদি স্থানে ওভারব্রিজ থাকবে। বিদ্যমান ওভারব্রিজগুলোকে নিরাপদ পারাপারের উপযোগী করা হবে। হকার, ফেরিওয়ালা, ফকির—সবাইকে অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। সাধারণ মানুষদের বোঝাতে হবে যে এতে করে তাদের নিরাপত্তাই জোরদার হবে এবং তারা সহজে ও নিরাপদে সড়ক পারাপার করতে পারবে। প্রিফেব্রিকেটেড ব্রিজ তৈরি করে এনে রাতারাতি নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই সব ব্রিজ স্থাপিত হতে পারে। বিশেষ বিশেষ স্থানে আন্ডারপাস তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের রাস্তা পারাপারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে।
চ.
গণপরিবহনের যানবাহন বিশেষ করে বাস রুটগুলো পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে অসামঞ্জস্য প্রতিযোগিতা রোধ করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় যানবাহনগুলোকে পরিহার করে নিতে হবে। ছোট বাসের পরিবর্তে প্রয়োজনে বড় বাস এবং তার উল্টোটাও করা যেতে পারে প্রয়োজন এবং চাহিদা বিবেচনা করে। এ জন্য হয়তো বা আইন সাময়িকভাবে পরিবর্তন করতে হতে পারে। অন্ততপক্ষে একটি পাইলট প্রজেক্টের জন্য হলেও বা স্বল্পকালীন মেয়াদের জন্য আইন সংশোধন করা দরকার হবে।
৫. তিন থেকে পাঁচ বা দশ বছর
নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো এ প্রজেক্টের প্রথম বছরেই পরিকল্পনায় রাখতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নে বাধা আসবে এবং এগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘ মেয়াদের প্রয়োজন হবে বিধায় শেষ কার্যক্রমে রাখা হয়েছে। এ কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নে আইন পরিবর্তনের দরকার হবে এবং যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁদের সময়ের দরকার হবে। প্রশাসনকেও বিস্তর প্রস্তুতি নিতে হবে, প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে প্রশিক্ষিত জনবল।
ক.
ফুটপাত সম্পূর্ণ মুক্ত করা। ফুটপাতকে পুনর্বিন্যাস করা, যাতে ছোট, বড়, প্রতিবন্ধী—সবাই নিরাপদে ব্যবহার করতে পারে ফুটপাত। ফুটপাতের হকারদের বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসন করা। উদাহরণস্বরূপ প্রস্তাব নেওয়া যায় যে সরকারি মার্কেটগুলোর ওপর এলিভেটরসহ ১০ তলা ভবন তৈরি করে সেখানে ছোট ছোট সীমানা নির্দিষ্ট করে বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন পণ্যের হকারদের বিনা মূল্যে অ্যালটমেন্ট দেওয়া। হকারেরা প্রতিদিন স্বল্প অঙ্কের একটি ভাড়া দেবে। ৫০ বছরেই এ ধরনের একটি ইনভেস্টমেন্ট লাভের মুখ দেখবে, যদি না কোনো দুর্নীতি হয়। এ ধরনের ভবনে নামাজের স্থান ও টয়লেটের ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। ঢাকা শহরে এ ধরনের ১০০টি ভবন তৈরি হতে পারে।
খ.
ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকায় সব মার্কেট ভবনের নিজস্ব পার্কিং স্পেস থাকতে হবে। এদের ৩ থেকে ৭ বছরের সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে এরা নিজ নিজ ভবনে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করবে। ভবনের মালিকদের অনুমতি দেওয়া হবে ওপরের দিকে সমপরিমাণ তলা তৈরি করার, যদি তারা নিচতলাগুলোয় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে। তবে তাঁদের অবশ্য ভবনের কাঠামো মজবুত করতে হবে। একটি বিশেষ টাস্কফোর্স সংসদে আইন পাসের ভিত্তিতে ভবন নির্ধারণ করে তাদের এ নির্দেশনা দেবে। যেসব ভবনে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা যাবে না, সেখানে রাস্তার পাশে কখনোই গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমতি দেওয়া যাবে না। শুধু যাত্রী ওঠানামা করা যাবে। নতুন ভবন তৈরির নকশা অনুমোদনে অবশ্য পর্যাপ্ত পার্কিং থাকার নিয়ম রাখতে হবে।
গ.
আবাসিক এলাকাগুলো থেকে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তুলে ফেলতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বাসন করতে হবে। এতে ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠা নিয়ে এবং এলাকায় যানজট কমে যাবে। বোনাস হিসেবে আবাসিক এলাকাগুলোর মান উন্নত হবে, সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং অপরাধও কমে যাবে।
ঘ.
ব্যস্ত সড়কের পাশে অবস্থিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যেমন রড, সিমেন্ট, ওয়ার্কশপ, ফার্নিচার, কাঠ, স মিল ইত্যাদি যাদের নিজস্ব পার্কিং স্পেস নেই এবং যে কারণে মালবাহী যানবাহন সচরাচর রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করছে, সেগুলো সরিয়ে মূল শহরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
৬. পাঁচ থেকে দশ বা বারো বছর
ক.
রাজধানী ঢাকার জন্য আইন করে একটি স্বতন্ত্র গণপরিবহন কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে হবে। এ কর্তৃপক্ষের আওতাধীন থাকবে সব ধরনের গণপরিবহন, যেমন বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি, উবার, পাতালরেল, কমিউটার ট্রেন ইত্যাদি। একটি মানসই ও আন্তর্জাতিক মানের গণপরিবহনব্যবস্থা তৈরির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি নিজস্ব বাস বা যানবাহন দিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু যানবাহনগুলো চলবে একটি কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এবং একই ব্যানারে। সব যানবাহনের মান হবে এক, ভাড়া হবে এক নিয়মে। মাসিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক কিংবা প্রতিবারের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা হবে। একটি অতি সুন্দর ও আন্তর্জাতিক মানের গণপরিবহনব্যবস্থা থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে।
খ. রাজধানী ঢাকা শহরে অনুমোদিত সব কিন্ডারগার্টেন, স্কুল ও কলেজের মান একই রকম করার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষানীতি, পরিবেশ, পাঠ্যক্রম, পরীক্ষাব্যবস্থা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি একই মানের হতে হবে। গোড়ানের একটি স্কুল এবং মোহাম্মদপুরের একটি স্কুল—দুটির মান একই হতে হবে। এটা নিশ্চিত করার পর আইন করতে হবে, এলাকার শিশু বিশেষ কারণ ব্যতিরেকে অন্য এলাকার কিন্ডারগার্টেন, স্কুল বা কলেজে যেতে পারবে না। একই সময় থেকে বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিশ্ববিদ্যালয়সহ) ৩০০ থেকে ৫০০ মিটার এলাকায় কোনো প্রাইভেট কার শিক্ষার্থী ওঠানামা করার জন্য থামতে পারবে না বা দিনভর পার্কিং করে রাখতে পারবে না। এর অন্যথায় বড় অঙ্কের জরিমানা করা হবে। এটা যত দ্রুত করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি যানজট কমে আসবে।
গ.
ঢাকার সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাধ্যতামূলক পরিবহনব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির সময় অভিভাবকদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা নেবে যে ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে নিজ পরিবহনে না এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনে আসতে বাধ্য থাকবে। এটাও যত দ্রুত করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি যানজট কমে আসবে।
পরিশেষে
ঢাকার বাসিন্দারা যদি আন্তরিকভাবে ট্রাফিক ও যানজটের সমস্যার সমাধান চান, তাহলে সেটা অসম্ভব নয়। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় পাহাড়সম সমাধানটি হাতের নাগালের মধ্যে এনে এর লাগাম টেনে ধরা যাবে। সবাইকে এর সুফলতার লোভ দেখাতে হবে, প্রমাণ দেখাতে হবে যে এটা সম্ভব। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে। বিশিষ্ট নাগরিকদের উদাহরণ হতে হবে। পথ দেখাতে হবে। তাতেই উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হব আমরা সবাই।
*লেখক: কামরুল ইসলাম, সুইডেনপ্রবাসী