ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা: সমাধান আছে, কিন্তু সেটা চাই কি না-১
১.
সব সমস্যারই সমাধান আছে, যদি সেটার প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকে। যে সমস্যা আমরা ঢাকাবাসী তিল তিল করে পাহাড়সম গড়ে তুলেছি, সেটা এক দিনে সমাধান করা যাবে না। সমাধান পুরোপুরি করাও যাবে না বা হবেও না। তবে গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা থাকলে অন্তত ৫০ শতাংশ সমাধান করা যাবে, এটা বলা যায়। সর্বপ্রথম ঢাকাবাসীর একমত হতে হবে যে ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা আছে। অর্থাৎ ঢাকাবাসীকে এর সমাধানে সার্বিকভাবে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করা। শুধু প্রশাসন, সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষারোপে আকাশে থুতু ছুড়ে দেওয়া হবে, যা নিজের গায়ে এসেই লাগবে। কারণ প্রশাসন, সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো কারা? আমরাই তো! ঢাকার রাস্তায় যাঁরা চলাচল করেন, যাঁরা রাস্তা থেকে ফায়দা লোটেন, যাঁরা রাস্তার কারণে ভোগান্তিতে, যাঁরা ট্রাফিক অব্যবস্থায় প্রতিদিন মূল্যবান সময় হারাচ্ছেন, যাঁরা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন বা আহত হচ্ছেন, সবাইকে একমত হতে হবে এবং এর সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার কাতারে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই সম্ভব এর সমাধান, কিছুটা হলেও।
সমাধানের সুফলগুলো তুলে ধরতে হবে ঢাকাবাসীর কাছে, যাতে সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এরপর আসবে স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনাগুলো শুধু কাগুজে বা কল্পনাপ্রসিদ্ধ নয়, মাঠপর্যায়ে স্বল্পপরিসরে, এক এক রাস্তা ধরে এবং একেকটি এলাকায় গবেষণাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন সমাধান নিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন পদ্ধতি সংশোধন করতে হবে কিছুদিন পর। একই সমাধান ঢাকার সব রাস্তা বা এলাকায় চলবে না। এটা পরিকল্পনায় রাখতে হবে। মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো সমাধানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না।
সুফলগুলোর কথাই ধরা যাক প্রথমে। রাস্তা ও গন্তব্যস্থলভেদে যাতায়াতের সময় কমে আসবে ক্রমান্বয়ে। যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সরকারি, বেসরকারি ও সাধারণ মানুষের তেল–গ্যাসের খরচ কমে আসবে। যাতায়াতের খরচ কমে গেলে এবং সময় কম লাগলে পরিবহন খাত লাভবান হবে। ২৪ ঘণ্টায় তারা হয়তো দু–তিনটি ট্রিপ বেশি দিতে পারবেন। বায়ুদূষণ কমে আসবে এবং তার ফলে ঢাকার পরিবেশ ক্রমে পরিচ্ছন্ন হবে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, অগ্নিনির্বাপণার গাড়ি ইত্যাদি দ্রুত যাতায়াত করার সুযোগ পাবে। মানুষ গণপরিবহনে চলাচল করবে স্বাচ্ছন্দ্যে। দুর্ঘটনা কমে আসবে, মানুষের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে, সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাবে।
নিম্নলিখিত ভাবনাগুলো আমার একার। ভাবনাগুলো এসেছে দেশ–বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে। এর সব কটিই যে ঢাকায় বিভিন্ন কারণে বাস্তবায়ন করা যাবে না, সেটা আমি জানি। তারপরও পর্যালোচনার খাতিরে তুলে ধরা যায়। এসব ভাবনার বাইরেও জনগণ আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারেন। সেগুলো পর্যালোচনা করেও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
২.
পূর্বশর্ত
ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার উন্নতিকল্পে যে পূর্বশর্তগুলো রয়েছে, তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।
ক.
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সম্পৃক্ততা ও অঙ্গীকার। সরকারি সহযোগিতা, যেমন পর্যাপ্ত বাজেট দেওয়া, জনবলের ব্যবস্থা নেওয়া, আইন প্রণয়ন করা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা না দেওয়া।
খ.
কর্মদক্ষ ও অরাজনৈতিক কাউকে প্রজেক্ট ভিত্তিতে (প্রজেক্ট ডাইরেক্টর) তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া এবং তাঁকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া।
গ.
ঢাকার পরিবহন প্রতিষ্ঠান, সড়ক, পানি, বিদ্যুৎ, পৌরসভা, পুলিশসহ অন্য সব সংস্থাকে প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের অধীন রাখা। অর্থাৎ প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ট্রাফিক সমস্যার উন্নতিকল্পে যেন বিভিন্ন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সমন্বয়তা রক্ষা করতে পারেন এবং তাদের সহযোগিতা পেতে পারেন, এর নিশ্চয়তা তৈরি করা। বিশেষ প্রয়োজনে সুদক্ষ সামরিক বাহিনীর ট্রাফিক পুলিশের পরামর্শ এবং সার্বিক সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
ঘ.
পরিবহন সংস্থা, মালিক সমিতি, চালক সমিতি, শ্রমিক সমিতি—এদের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সরকারিভাবে সমঝোতায় আসা, যাতে তারাও আগামী দিনের সুফলগুলো পেতে পারেন এবং তাদের সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা জরুরি।
ঙ.
প্রশাসনের সর্বস্তর, মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব সংস্থা থেকে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেওয়া।
৩.
সহজলভ্য সুফলগুলো, তিন মাস থেকে এক বছর
প্রথম পর্যায়—তিন মাসব্যাপী কার্যক্রম। প্রথম তিন মাস দৃষ্টি দিতে হবে তথ্য সংগ্রহ, পরিকল্পনা, মাঠ গবেষণা এবং ঢাকার সড়ক ব্যবহারকারী সবাইকে আসন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করা এবং সবাইকে অনুপ্রাণিত করে তাদের সম্পৃক্ততা ও অঙ্গীকার নিশ্চিত করা। কারণ, এ কার্যক্রমে বিভিন্ন সময়ে স্বল্প মেয়াদে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে যেতে পারে বৈকি; যদিওবা ধৈর্য ধরে কিছুদিন অপেক্ষা করলেই কার্যক্রমের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে শুরু করবে।
প্রথম তিন মাসে একটি বা দুটি রাস্তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যেমন ধরা যাক মৌচাক থেকে কুড়িল। দুই দিন ধরে সংগ্রহ করতে হবে এ সড়ক–সম্পর্কিত সব তথ্য (ডেটা), যা কিনা প্রয়োজনে ছবি তুলে, ভিডিও করে এবং লিখিত আকারে সংরক্ষিত করা হবে। নিচে কিছু ডেটার নমুনা দেওয়া হলো—
ক. সড়কের দৈর্ঘ্য, কতগুলো মোড় এবং সেগুলো কী ধরনের।
খ. সড়কে কী আকারের এবং কোন কোন পরিবহনের যানবাহন (বাস, ট্রাক, পরিবহন, ভ্যান ইত্যাদি) চলে। সেগুলো কী ধরনের সমস্যায় পড়ে এবং সমস্যা তৈরি করে।
গ. কোথায় কোথায় প্রতিবন্ধকতা আছে ও কতগুলো, যেমন ডাস্টবিন, খানখন্দ, বাজার, স্থায়ী বা অস্থায়ী পার্কিং, ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ইত্যাদি।
ঘ. কী কী ধনের ট্রাফিকচিহ্ন এবং কোথায় কোথায় সেগুলো আছে। অসামঞ্জস্যতা রয়েছে কি না, সেটা কোথায় এবং কেন?
ঙ. কয়টি ওভারব্রিজ আছে এবং সেগুলো কোথায় কোথায়, সেগুলোর গুণগত মান কী পর্যায়ে রয়েছে। সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না এবং না হলে কেন তা হচ্ছে না?
চ. কোথায় কোথায় বাসস্টপ রয়েছে, সেগুলোর ব্যবহার করা হচ্ছে কি না এবং না হলে কেন হচ্ছে না?
ছ. ট্রাফিক পুলিশ, ট্রাফিকপোস্ট, ট্রাফিকসংকেত ইত্যাদি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না এবং না হলে কেন হচ্ছে না?
জ. সাধারণ মানুষ কী ধরনের সুবিধা বা অসুবিধা ভোগ করছে? তাদের মতামত জানা।
প্রয়োজনবোধে আরও অনেক তথ্যের দরকার পড়বে। উপরিউক্ত তথ্য পর্যালোচনা করে উদাহরণস্বরূপ নিচের পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত করে দেখা যেতে পারে কতটুকু সফলতা আসে।
তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে প্রজেক্ট টিমকে নিয়ে এক সপ্তাহব্যাপী একটি ওয়ার্কশপ করা হবে। সেখানে প্রয়োজনীয় আলোচনা, কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ, শিক্ষা, টিম গঠন ইত্যাদি সাংগঠনিক কাজ সমাধান করা হবে।
ক. সড়কের খানাখন্দ সারিয়ে ফেলা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলা। যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আশু সরিয়ে ফেলা যাবে না, সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা।
খ. সড়কের লেন, বাসস্টপ, রিকশাস্টপ এবং অন্য বিশেষ চিহ্নগুলো নতুন করে রং করা বা লেখা। লেন মার্ক করা বা ট্রাফিকচিহ্ন আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বসানো।
গ. সড়কের মোড়গুলো, যেগুলো বন্ধ করে দিয়ে দূরে ইউ টার্নের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এ বিকল্পগুলো যানজটকে বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি। তবে মোড়গুলোকে এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে, যাতে বিশৃঙ্খলা না হতে পারে। আগে থেকেই যানবাহনকে লেন বেছে নিতে হবে মোড় নেওয়ার জন্য। মোড়ের নিকটে এসে কোনো গাড়ি যেন ওভারটেক করে মোড় না নিতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ. সড়কের ওপর বাজার বসলে সেগুলো সরিয়ে ভেতরের রাস্তায় বা বিকল্প এলাকায় বসার জন্য বাধ্য করা। এ ব্যাপারে এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিতে হবে।
ঙ. সড়কের পাশে ভ্যানগাড়ি, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ইত্যাদি পার্কিং নিষিদ্ধ করা। তবে মালামাল পরিবহনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে তখন মালামাল পরিবহনের গাড়ি এসে মাল নিয়ে যাবে।
চ. মৌচাক থেকে কুড়িল পর্যন্ত যেসব বাস, ট্রাক, মিনিভ্যান, কাভার্ড ভ্যান সচরাচর চলে, তাদের এক সপ্তাহ ধরে তথ্য দেওয়া এবং প্রামাণিক শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে প্রথম এক সপ্তাহ এবং পরে এ কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে। একজন প্রশিক্ষক একেকটি যানে মৌচাক থেকে চালকের পাশে বসে তাকে তথ্য দেবে এবং এ সড়কে চলাচলের বিভিন্ন নিয়মকানুন হাতেকলমে দেখিয়ে দেবে। যে চালক এ প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাকে তার নামধারী একটি টোকেন দেওয়া হবে। এক সপ্তাহ পর এ টোকেন ব্যতীত কোনো চালক এ সড়কে গণপরিবহনের গাড়ি চালাতে পারবে না। তবে নতুন কোনো চালক পূর্বে থেকে যোগাযোগ করলে তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ছ. বিভিন্ন প্রশাসনের বাস, ট্রাক, ভ্যান বা কাভার্ড ভ্যানের চালকদেরও পাশাপাশি শিক্ষা দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সব প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা লাগবে।
জ. ট্যাক্সিচালক, রিকশাচালক, পথচারী, প্রাইভেট কারের চালক ও মালিকদের এ সড়কে চলাচলের সময় তথ্যসংবলিত লিফলেট দিয়ে এবং প্রয়োজনে মৌখিক তথ্য দেওয়া হবে।
ঝ. এ সড়কে লেনগুলোকে চিহ্নিত করা হবে এবং যানবাহন যেখানে যেখানে সম্ভব, সেখানে লেনে চলবে। পরে সড়কের উন্নতি হলে পুরো সড়কেই লেন মোতাবেক চলার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হবে। সাইরেন বাজিয়ে অনুমতিপ্রাপ্ত যে যানবাহন আসবে, সেগুলোকে পথ দিতে হবে লেন থেকে কিছুটা পাশে সরে। এতে জরুরি কাজে নিয়োজিত যানবাহন দ্রুত চলাচল করতে পারবে। এ ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধে বড় অঙ্কের জরিমানা আইন করে চালু করতে হবে।
উপরিউক্ত কার্যক্রমগুলো উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো। গবেষণা সাপেক্ষে এগুলোর সংবর্ধনা এবং আরও সংযোজনাও হতে পারে। প্রয়োজনে এক মাস পর পর্যালোচনা করে কিছু কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তিন মাসব্যাপী এ কার্যক্রম চলবে মৌচাক থেকে কুড়িল পর্যন্ত। তৃতীয় মাসে এ কার্যক্রম আরও দুটি সড়কে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হবে। এরপর এক বছরের মধ্যে পুরো ঢাকা শহরে এ কার্যক্রম সম্পূর্ণ বা আংশিক চালু করা হবে। চলবে...
*লেখক: কামরুল ইসলাম, সুইডেন