বাংলাদেশের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে, একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিতে–শেষ পর্ব

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসফাইল ছবি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলাদেশে রাশিয়ার বড় কোনো স্বার্থ নেই। যদিও শোনা যাচ্ছে আমাদের দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে রাশিয়া বিনিয়োগে আগ্রহী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যদিও বর্তমান রাশিয়া ও সে সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভ। ব্রেজনেভ ছিলেন একজন ইউক্রেনিয়ান। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে গম ও সার আমদানি করে। ফ্রান্স বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে সে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মালয়েশিয়া সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। এসব দেশের প্রতিটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে। এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক বিশ্বরাজনীতিতে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তুরস্ক সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী। তারা বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চাইছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এখন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র, যাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। যদিও এ মুহূর্তে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা আশানুরূপ নয়। দেশটি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। ইরানও সামরিক দিক থেকে অগ্রগামী একটি রাষ্ট্র। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হোক কিংবা অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে হলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা চাইতে পারে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, কাতার ও কুয়েত ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের বিভিন্নভাবে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিছু দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অভিবাসনপ্রত্যাশী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের সদস্যরাষ্ট্র। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আসিয়ানের দেশগুলোকে বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য। কৌশলগত কারণে পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গেও আমাদের সখ্য বৃদ্ধি করতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অংশ নিয়েছিল। আজ জাপান ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের মিত্র। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেন লম্বা সময় ধরে যুদ্ধে জড়িয়েছে। আজ ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো। বাংলাদেশকেও অতীতের দিকে না তাকিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হবে। পাকিস্তানকেও একাত্তরের গণহত্যার জন্য আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।

মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিকভাবেও বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত। আরাকানের রাজসভায় একসময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হতো। বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক সাধারণ মানুষ একসময় জীবন ও জীবিকার জন্য রেঙ্গুনকে বেছে নিতেন। স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমার সব সময় নিজেদের বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা সে রকম পদক্ষেপ দেখাননি। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মিয়ানমার বেশির ভাগ সময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। বর্তমানে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। বাংলাদেশের নিরাপত্তার সঙ্গে মিয়ানমার জড়িত। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের চালান আসে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন না ঘটলে বাংলাদেশে ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব নয়, এমনকি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানেও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা ছাড়া বিকল্প কোনো অপশন নেই। মিয়ানমারের জনসাধারণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনসাধারণের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এ দুই দেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মিয়ানমারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত এবং একজন পেশাদার ও দক্ষ কূটনৈতিককে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই। রিচার্ড নিক্সনের শাসনামলে চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, অথচ আজকের বিশ্বে চীন ও রাশিয়া একযোগ হয়ে পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধ আবার ফিরে আসছে, যার একদিকে থাকছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এবং বিরোধী পক্ষে থাকছে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট। পরিবর্তনের পথে পা বাড়ানো নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলো কীভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে চলতে পারবে, সে বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রকেও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভারত এখনো মিলিটারি হার্ডওয়্যারের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপরও ভারতের নির্ভরশীলতা রয়েছে। পশ্চিমা জোট ও রাশিয়া—এ দুই শক্তিকে ব্যালান্স করে ভারত অগ্রসর হতে পারছে না। তবে বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরিভাবে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবকে খর্ব করতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতকে প্রয়োজন।

ভৌগোলিক অবস্থান কিংবা অর্থনীতি—যেদিক থেকে বিবেচনা করি না কেন, বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, চীন ও পশ্চিমা জোটের মধ্য থেকে যেকোনো একজনের প্রতি ঢালাওভাবে ঝুঁকে পড়া সম্ভব নয়। এটাও ঠিক যে একই সঙ্গে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা যায় না। তাই বাংলাদেশকে নিজেদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সব রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে সবার প্রথমে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্লে গ্রাউন্ডে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার বা চীন কারও সঙ্গে যাতে কূটনৈতিকভাবে আমাদের বৈরিতা সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। সার্ককে কার্যকর হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতির কথা চিন্তা করে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে যদি উপায়ান্তর না দেখে যেকোনো এক পক্ষের প্রতি ঝুঁকে পড়তে হয়; তাহলে সে ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের উচিত হবে পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা। ৫ বা ১০ বছর পর বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো পশ্চিমের দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের মতো বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহজে ঋণ পেতে পারে এবং এ ঋণের অর্থ বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করতে পারে। এ ছাড়া চীন ও ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সৃষ্টি হওয়া কূটনৈতিক শীতলতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ পশ্চিমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানাতে পারে। তবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনসাধারণের স্বার্থকে প্রশ্নের মুখে ছুড়ে দেয়, এমন কোনো বিষয় আমরা আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হতে দিতে পারি না। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে একটি খবর প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। গুঞ্জন উঠেছে যে যুক্তরাষ্ট্র নাকি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করতে চায়, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অফিশিয়াল সোর্স থেকে এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের মাটিতে অন্য কোনো দেশ নৌঘাঁটি বা কোনো ধরনের সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করুক, সেটা আমি চাই না। যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে থাকে, সেটা আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াবে এবং চীন ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সংঘাতের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করবে। এ ছাড়া সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের জন্য এ ধরনের স্থাপনা হুমকিস্বরূপ। তাই ভবিষ্যৎ পরিণতি বিবেচনা না করে এবং সঠিক বিচার ও বিশ্লেষণ ছাড়া বাইরের কোনো দেশ সম্পর্কে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।

কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক আমাদের কাম্য নয় এবং আমাদের দেশের জন্য তা কল্যাণকর নয়। চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। একই সঙ্গে আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে যাতে আমাদের কোনো কর্মকাণ্ড চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতি ও জনগণের স্বার্থ—এ তিনের ওপর ভিত্তি করে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে গড়ে উঠুক এ দেশের স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে সেটি কায়মনোবাক্যে আমার কামনা। শেষ

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]