বাংলাদেশের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে, একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিতে–১ম পর্ব

ফাইল ছবি

প্রায় ৫৭ হাজার ২০০ বর্গমাইল আয়তনের দেশ বাংলাদেশ। অথচ এ দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হচ্ছে আইওয়া। আইওয়ার আয়তন প্রায় ৫৬ হাজার ২৭৩ বর্গমাইল। আইওয়াতে বসবাসরত মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩২ লাখের কাছাকাছি। আর যদি পুরো যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হবে ৩৭,৯৬,৭৪২ বর্গমাইল আয়তনের বৃহৎ রাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি। বাংলাদেশ ও আইওয়ার আয়তন প্রায় কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্য রয়েছে এবং আয়তনের দিক থেকে বিবেচনা করলে আইওয়ার অবস্থান এ ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২৬তম। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনবিশিষ্ট একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকে বেশি মানুষ বসবাস করেন। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর বেশ কিছু পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।

আমার মনে হয় না হংকং, মোনাকো, মালদ্বীপ, মাল্টা, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুর ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্র পাওয়া যাবে, সেখানে এত অল্প জায়গায় এত অধিক সংখ্যক মানুষের বসবাস। হংকং চীনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় মোনাকো, মালদ্বীপ ও মাল্টা হচ্ছে মাইক্রোস্টেট। আয়তন, জনসংখ্যা ও অর্থনীতির পরিধির কথা বিবেচনা করলে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় মোনাকো, মালদ্বীপ, মাল্টা, বাহারাইন ও সিঙ্গাপুরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও আমাদের দেশ খুব একটা অগ্রসর নয়। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিকটিকসের রিপোর্ট অনুযায়ী এ দেশের ১৮ দশিমক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। শিল্প ক্ষেত্রে দেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নেই। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগ আসে তৈরি পোশাক, কৃষি, চিংড়ি ও বিভিন্ন স্বাদুপানির মাছ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ থেকে। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে নেই।

হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য যেভাবে আশীর্বাদ, ঠিক একইভাবে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার প্রধান কারণ হতে পারে ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কি ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে, নাকি গলার কাঁটা হবে, তা নির্ভর করবে যখন যে সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে, তাদের পলিসি বা নীতির ওপর।

বিভিন্ন কারণে দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ মানুষের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে কোনোভাবে সমর্থন করি না। তবে একটি বিষয় সত্য যে ভারত আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীকে কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে ২ হাজার ৫৪৫ মাইল দীর্ঘ সীমারেখা। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম তিন দিক থেকে আমরা ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত। বঙ্গোপসাগরেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সংযোগ ঘটেছে। ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় যে ভারতের পেটের ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের মানচিত্র আঁকলে পরোক্ষভাবে দেশের মানচিত্র আঁকা হয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয় বাদ দিলে সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য তেমনভাবে চোখে পড়ে না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। ভারতের সঙ্গে কোনো কারণে বৈরিতা সৃষ্টি হলে দেশের মানুষের জন্য তা কল্যাণ বয়ে আনবে না। তা ছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে ভারত একটি উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারত বর্তমান বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। এ ছাড়া সামরিক দিক থেকে ভারত এ পৃথিবীর চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো পশ্চিমা বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে।

আয়তন ও জনসংখ্যা এমনকি অর্থনীতির পরিধির কথা চিন্তা করলে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে অসমতা থাকবে। এটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর রাষ্ট্র এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের জন্য আমরা ভারতের প্রতি নির্ভরশীল। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ তুলনামূলকভাবে স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা লাভের জন্য ভারতে যান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৫৭টি আন্তসীমান্ত নদী রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে উপনিবেশের চোখে দেখার অভিযোগও আছে। সিকিমকে নিজেদের করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সে সময় ভারতের বিপক্ষে কোনো অবস্থান নিতে পারেনি।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে সার্ক গঠন করা হয়েছিল। সার্ক বর্তমানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে ভারতের উদাসীনতার কারণে সার্ক কার্যকরভাবে ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভারত বিশ্ব পরিসরে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভারতের মধ্যে সে সম্ভাবনা রয়েছে প্রবলভাবে। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত ষষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করতে চায়। ভারতের নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বজায় রেখে ভারত কোনো দিন পরাশক্তি কিংবা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত বাজপেয়ী–পরবর্তী ভারত সব সরকার দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে এসব দেশের প্রতি উপনিবেশের মতো আচরণ দেখিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের ওপর ভারতের এ উপনিবেশবাদী আচরণ প্রকট রূপ ধারণ করেছে।

ভারতও বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। যেসব দেশ থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত ভারতের সাতটি রাজ্য হচ্ছে আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচল। শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেকের ১২ থেকে ১৪ মাইলের সংকীর্ণ অংশ বাদ দিলে ভারতের রাজধানী দিল্লির সঙ্গে এ সাতটি রাজ্যের কোনো ধরনের স্থল সংযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে কোনো না কোনোভাবে দায়বদ্ধ। ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে বিভিন্ন সময়ে—এমন অভিযোগ আছে। কাঁটাতারের বেড়া থেকে শুরু করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে বিএসএফের কার্যক্রম নিয়েও ক্ষোভ আছে। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৫ বছর ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা করেনি; বরং এ দেশের মানুষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়ে গেছে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে জনগণের মতামত ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে। কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হতে পারে না।

ইসরায়েল আয়তনে অতি ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র। ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া বলা হয়। জর্ডান ও মিসর ইসরায়েলের প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্র এবং এ দুই দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসর ও জর্ডানের সম্পর্ক সাধারণ জনগণের স্তরে পৌঁছায়নি। বলা বাহুল্য, ইসরায়েল এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যে অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সঙ্গে তার কোনো না কোনো দিক থেকে বৈরিতা রয়েছে। তারপরও ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান নিতে পারে। কারণ, ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর খুবই জোরালো ও মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা খাতেও ইসরায়েল ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়ার স্থায়ীভাবে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে সামরিক শক্তিমত্তার দিক থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান যদিও ভারত সামরিক শক্তিতে এ তিন দেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। ইসরায়েলের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক যে রকম নিরেট, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের সম্পর্ক ঠিক একই রকম নিরেট নয়। এ কারণে ভারতের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের যুদ্ধের মতো কোনো পরিস্থিতি হয়, সেটা আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। কাজেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক অত্যাবশ্যক এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক হবে দুই দেশের জনসাধারণকেন্দ্রিক। ভারত ও বাংলাদেশ এ দুই রাষ্ট্রের এমন কোনো কিছু করা উচিত নয়, যা পরস্পরের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে হবে ভারসাম্যমূলক। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় একটি বৃহৎ রাষ্ট্র এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্বের জায়গা বেশি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হোক সেটা আমি মনেপ্রাণে কামনা করি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। এ দেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে সে সময় ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। তবে এটাও ঠিক, স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে ভারত আমাদের ওপর যে ধরনের আচরণ দেখিয়েছে, তা আমাদের অনেকের মনে তীব্র ক্ষোভ হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে বিজেপি এবং রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস উভয় রাজনৈতিক দল প্রায় কাছাকাছি ধরনের মনোভাব পোষণ করেন, যা সত্যি দুঃখজনক।

বাংলাদেশ থেকে চীনের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। চীন ও জাপান এ দুই দেশের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। জাপান ও চীন এ দুই দেশ আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। জাপান বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে জাপানের সখ্যতা রয়েছে। জাপান এশিয়া মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র। ঐতিহাসিক কারণে চীনের সঙ্গে জাপানের বৈরিতা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের শীতলতার কারণে চীন কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। চীনের বিরাগভাজন হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপরও চীনের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। চীনের সহায়তা ছাড়া আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণে সমর্থ হবো না। জাপান হয়তোবা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে সে অর্থে ভূমিকা রাখবে না। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, দাতা রাষ্ট্র হিসেবে চীন ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র আমাদের সেভাবে অর্থ সহযোগিতা দিতে পারবে না। ভারতের মতো চীনের সঙ্গেও আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরালো করতে হবে। তবে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে গেলে ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশ সেটি সহজে গ্রহণ করবে না।

দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ ঘটেছে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে। এ কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে ভারতের অবস্থান বিশেষত নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মিত্রতা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। ভারত কোয়াডের সদস্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এ কারণে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেনেজুয়েলা বা ইরানের মতো নয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, কৃষি ও মাছের প্রধান বাজার পশ্চিমা দেশগুলোতে। আমাদের দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, একক দেশ হিসেবে বিবেচনা করলে যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন এবং তাঁরা এ দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। এমনকি উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে অভিবাসনের জন্য আমাদের দেশের মানুষের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো বেশি পছন্দের। কাজেই পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ঐতিহাসিক দিক থেকেও আমাদের দেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সংযোগ রয়েছে। প্রায় দুই শ বছর ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সংসদীয় কাঠামো রয়েছে, যা ওয়েস্টমিনস্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত। পশ্চিমা দেশগুলোও বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে আমাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে, অন্য রাষ্ট্রগুলো থেকে আমরা সে রকম সাহায্য পাইনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি।.... চলবে

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]