‘কারাগারের রোজনামচা’ যেন বঙ্গবন্ধুর মনোজগতের প্রতিচ্ছবি

কারাগারের রোজনামচা: শেখ মুজিবুর রহমানছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেষ করেই ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই বইটা যেন আর শেষ হতেই চাইত না। প্রতিটি পাতা পড়ি আর মনটা ভীষণ খারাপ হতে থাকে। বইটা আমাদের ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল। বইটার রাজনৈতিক মূল্য অপরিসীম। পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠীর নিপীড়ন নির্যাতনের এক জীবন্ত সাক্ষী এই বইটা। বইয়ে অনেক বিস্তৃতভাবে পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই বিষয়ের ওপর বহুল গবেষণা হওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। আমি যেহেতু রাজনীতির লোক নই, তাই সেদিকটা আমি আলোচনা করার দুঃসাহস করছি না। আমি শুধু বঙ্গবন্ধুর মনোজগতের দিকটা এখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। তবে বঙ্গবন্ধু যেহেতু আপাদমস্তক একজন রাজনীতিক ছিলেন। তাই আমার আলোচনায় রাজনীতিও কিছুটা চলে এসেছে।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বন্দী থাকেন। সেই সময়ে কারাগারে প্রতিদিনের ডায়েরি লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখাগুলো এই বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে, যার শেষ অংশে আছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বন্দী হিসেবে কুর্মিটোলা সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে বন্দী থাকার অসহ্য দিনগুলো। এ বইয়ে বঙ্গবন্ধু তখনকার কারাগারের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যেটা যেকোনো সাধারণ পাঠকের আগ্রহের খোরাক তৈরি করবে। ‘Solitary Confinement’ থাকাটা কত বড় মানসিক শাস্তি, সেটা ফুটে উঠেছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়। আমি শুধু ভাবি, বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে কতটা শক্তিশালী ছিলেন যে জীবনের অধিকাংশ সময় জেলখানার চারদেয়ালের মধ্যে কাটিয়েও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হননি।  

জেলখানার সাধারণ বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। এই বিচিত্র দুনিয়ায় গেলে মানুষ বুঝতে পারে কত রকম লোক দুনিয়ায় আছে। বেশি দিন না থাকলে বোঝা যায় না। তিন রকম জেল আছে। কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা জেল, আর সাবজেল—যেগুলি মহকুমায় রয়েছে। জেলখানায় মানুষ, মানুষ থাকে না—মেশিন হয়ে যায়।…তবে এক সেলে কোন দিন দুইজনকে রাখা হয় না।’

এ ছাড়া জেলখানার ভেতরের কর্মপদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন, ‘কয়েদিরাই কয়েদিদের চালনা করে ও কাজ করায়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় আবার কাজ বুঝে নিতে হয়। যারা জেল খাটার পরে “পাহারা” হয় এবং পরে কনভিক্ট ওভারসিয়ার হয়, তাদেরকে “মেট” বলে। একবার এক চোর গ্রামে চুরি করে ধরা পরার পর তার সাজা হয়। এরপর জেলখানায় একসময় সে মেট হয় এবং বাসায় একটা চিঠি লিখে। চিঠির ভাষ্য, গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কী হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বর শ্রেণির লোক। চুরি না করলে আর জেলে না আসলে এ সম্মান আমাকে কেউই দিত না। তুমি ভেবো না। এখানে খুব সম্মানের সাথে আছি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এ ছাড়া আছে জেলখানায় ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে একটা জেলখানার শব্দকোষ—‘রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ু দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, শয়তানের কল, দরজি খাতা, মুচি খাতা, সিকম্যান, কেসটাকোল, মেডিকেল ডাইট, আইন দফা, ডালচাকি দফা, হাজতি দফা, ছোকরা দফা। গলার ভিতর “খোকড়”। জেলে নতুন কয়েদি এলে “আমদানি” বলে, আর চলে গেলে “খরচ” বলে।’

জেলে কোনো ঘটনা চাপা থাকে না। যেকোনো ঘটনা জেলখানায় আধা ঘণ্টার ভেতর আড়াই হাজার কয়েদির কানে চলে যাবে। জেলবন্দীর কাছে লেখা চিঠিতে যদি কিছু রাজনীতি বা ওই ধরনের কথা থাকত, তবে সে চিঠি রাজবন্দীদের হাতে দেওয়া হতো না; যদি দেওয়া হতো মাঝে মাঝে কালি দিয়ে এমনভাবে মাথাইয়া দেওয়া হতো, তা আর পড়ার উপায় থাকত না। একই অবস্থা দৈনিক পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি কর্তৃপক্ষের মনে হতো কোন খবর দেশবিরোধী। সংবাদের সেই অংশটা কালো কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। আবার কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই যেকোনো পত্রিকা হঠাৎ দেওয়া বন্ধ করে দিত।

আরও পড়ুন

এরপর আছে বঙ্গবন্ধু যে কক্ষে থাকতেন, সেই কক্ষের বর্ণনা, ‘জেলখানার এই জায়গাটি শায়েস্তা খানের আমলে লালবাগ ফোর্টের অংশ ছিল। এখানে নবাবদের ঘোড়াশালা, হাতিশালাও ছিল। আমি যে ঘরটিতে থাকি সেটা ঘোড়া থাকার মতোই ঘর। দেখলে বোঝা যাবে এখানে ঘোড়াই রাখা হতো।...দক্ষিণ দিকে ছয়টা জানালা, কিন্তু তার এক হাত দূরে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেওয়াল, বাতাস শত চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না আমার ঘরে। দেওয়ালের অন্য দিকে গরুর ঘর, পূর্ব দিকে পনের ফিট দেওয়াল ও নূতন বিশ। উত্তর দিকে ৪০ সেল ও ৭ সেল, যেখানে সরকার একরারি আসামি রেখেছেন।...সূর্য বিদায় নিয়েছে, জেলখানায় একটু পূর্বেই বিদায় নেয়। কারণ ১৪ ফিট দেয়াল দাঁড়াইয়া আছে আমাদের চোখের সম্মুখে। ২৬ সেলের সিকিউরিটি বন্ধুরা আমাকে রজনীগন্ধার তোড়া উপহার পাঠাইয়াছে। আমার পড়ার টেবিলের ওপর গ্লাসে পানি দিয়ে রাখলাম। সমস্ত ঘরটি রজনীগন্ধার সুমধুর গন্ধে ভরে গিয়েছে। বড় মধুর লাগলো।’

বঙ্গবন্ধু
ফাইল ছবি

ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর শুধু বঙ্গবন্ধুই গ্রেপ্তার হননি, তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা এমনকি কর্মীদেরও গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দফা দাবিকে সমূলে উৎপাটনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকদেরও। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে “নিউনেশন প্রেস” বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে ইত্তেফাক, ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক “পূর্বাণী” প্রকাশিত হইত।...ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে এবং তাহার মালিক ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে ছয় দফা দাবিকে বানচাল করতে চায়। কিন্তু আর সম্ভব না। এতে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠবে। যার পরিণতি একদিন ভয়াবহ হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

বিভিন্ন অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হতো। কারণগুলো অন্য সবাই মেনে নিলেও উনার মায়ের অবুঝ মন সেগুলো মানতে চাইত না। তাই বঙ্গবন্ধুকে যখন ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ে, তখন উনার মা বলেছিলেন, ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস—এ দেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে নেয় কেন?’ আরও বলেছিলেন, ‘যে তোকে জেলে নেয় আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর।’

বঙ্গন্ধুর জন্য কারাগারের সময়গুলো সবচেয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল একাকিত্বের কারণে। যেহেতু রাজবন্দী ছিলেন। তাই উনার সঙ্গে কাউকেই দেওয়া হয়নি। ফলে ভয়ংকর রকমের একাকিত্ব পেয়ে বসে উনাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘রাত কেটে গেল। এমনি অনেক রাত কেটে গেছে আমার। প্রায় ছয় বৎসর জেলে কাটিয়েছি। বোধ হয় দুই হাজার রাতের কম হবে না, বেশি হতে পারে। আরও কত রাত কাটবে কে জানে? বোধ হয় আমাদের জীবনের সামনের রাতগুলো সরকার ও আইবি ডিপার্টমেন্টের হাতে।...আমরা নীরবে সবই সহ্য করব ভবিষ্যৎ বংশধরদের আজাদির জন্য। আমাদের যৌবনের উন্মাদনার দিনগুলি তো কারাগারেই কাটিয়ে দিলাম। আধা বয়স পার হয়ে গেছে।’

কারাগারের অসহ্য সময়গুলোতে তাই বই, কারাগারের গাছপালা, পাখপাখালি থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে তৈরি করা বাগানও হয়ে হয়ে নিত্যসঙ্গী। যদিও বই–খাতা সব জেল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে দিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আমার ঘরের দরজার কাছে একটা কামিনী ও একটা শেফালিগাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর লেবুগাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলো যেন আরও সবুজ আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভালো লাগল দেখতে। মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে। তারপর গাছগুলো, বড় ভালো লাগল।…আমি বই নিয়ে বসে পড়লাম। মনে করবেন না বই নিয়ে বসলেই লেখাপড়া করি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য, মনে হবে কত মনোযোগসহকারে পড়ছি। বোধ হয় সেই মুহূর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা–অচেনা দেশে চলে গিয়েছে। নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়েছে।...আমার মনের অবস্থা আপনারা যারা বাইরে আছেন বুঝতে পারবেন না। কারাগারের এই ইটের ঘরে গেলে বুঝতে পারতেন।...ভালো বইপত্র দিবে না, Reader's Digest পর্যন্ত দেয় না। মনমতো কোনো বই পড়তেও দিবে না।’
৪৫ বছর বয়সে এসেও বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবা–মায়ের নিকট ছিলেন সেই ছোট্ট খোকাটিই ছিলেন। এই বইয়ের পাতায় তাই বঙ্গবন্ধুর নিজের পরিবার ছাড়াও তাঁর বাবা–মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘বাবা-মায়ের কাছে আজও আমি খোকাই আছি।...আমার ৪৫ বৎসর বয়স, চুলেও পাক ধরেছে। পাঁচটি ছেলেমেয়ের বাবা আমি, তথাপি আজও আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে বোধ হয় সেই ছোট্ট খোকাটি—এখনো মায়ের ও আব্বার গলা ধরে আদর করি, আমার সাথে যখন দেখা হয়।’
‘জেল–কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই, তাহারা বুঝতে পারে না সেটা কি বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে। কয়েদিরা সপ্তাহে একদিন দেখা করতে পারে আত্মীয়স্বজনের সাথে। সকাল বেলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দরখাস্ত করতে হয়। তারপর জেল কর্তৃপক্ষ দরখাস্তগুলি দেখে নেয় এবং সাক্ষাতের অনুমতি দেয়।…দুই চার মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করতে হয়।...এই সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে।...না দেখলে বা না ভুগলে কেউই বুঝবে না যখন সাক্ষাৎ হওয়ার পর ছাড়াছাড়ি করতে হয় তখনকার অবস্থা।...আমরা যারা রাজবন্দি তারা আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় পাই।’

কারাগারে পরিবারের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সামান্য সময়টুকু ছিল খুবই আবেগময়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘সেই পুরান দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে। আমাকে দেখে বলছে, আব্বা! আমি যেতেই কোলে এল। কে কে মেরেছে নালিশ হলো। খরগোশ কীভাবে মারা গেছে, কীভাবে দাঁড়াইয়া থাকে দেখালো।...দূর থেকেই ছোট বাচ্চাটা “আব্বা, আব্বা” করে ডাকতে শুরু করে। এইটাই আমাকে বেশি আঘাত দেয়।...জেল থেকে কী মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ুক, আইএ, বিএ পাস করুক। তারপরে দেখা যাবে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।…বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে। রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দিই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, তুমি আবার আব্বা। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’

জেলজীবনে অনেক ঈদ করতে হয়েছে কারাগারের অভ্যন্তরে। সেদিনের মনঃকষ্টের ব্যাপারগুলোও উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায়, ‘আগামী ১৩ই জানুয়ারি (১৯৬৭) ঈদের নামাজ।...চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।...আজ কোরবানির ঈদ (২২ মার্চ ১৯৬৭)। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দীজীবনে ঈদ উদ্‌যাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বারবার আপনজন বন্ধুবান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।’
বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে—এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কি না জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে, যেকোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভালো জানেন। জেলের ভিতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।’  

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুকে আবার নতুন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কুর্মিটোলা সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। কুর্মিটোলায় বন্দী থাকার বিবরণও উঠে এসেছে এই বইয়ে, ‘দরজা জানালা বন্ধ। জানালা ও দরজার কাচগুলিকে লাল রং করে দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলি অন্ধকার তাই আলো জ্বালাইয়া রাখতে হলো।...আর অফিসার ভদ্রলোকের কাজ হলো আমাকে চোখে চোখে রাখা যাতে আমি ভাগতে চেষ্টা না করি বা আত্মহত্যা করতে না পারি।...এইভাবে থাকলে যে কোনো লোক পাগল হতে বাধ্য।...এটা অফিসার মেস। আমার ঘরটা হলো গেস্টহাউস।...সমস্ত কর্মচারীই হলো পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, তারা রুটি খেয়েই থাকে। সাথে মাংস।...ভুল করেছি বই না এনে।...ভাবা ও চিন্তা করা ছাড়া কোনো কাজই যখন নাই, তখন মনকে বললাম, ভাবো যত পারো কিন্তু পাগল কোরো না। জীবনের বহু কথা মনে পড়তে লাগলো। খাতা কাগজ নাই যে কিছু লেখব। কলম আছে। কাগজ ও খাতা পাওয়ার কোনো উপায়ও নাই, আর অনুমতিও নাই।’  

ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী সবচেয়ে আতঙ্কের এবং অনিশ্চিত। সেই ভয়ংকর দিনগুলোর বর্ণনার মাধ্যমে এই বইটা শেষ হয়েছে, ‘আইনে আছে যদি কোন নাগরিক সামরিক বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে এই আইনে তাকেও গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।...কর্মচারীদের আলোচনায় বুঝতে পারতাম কোর্ট মার্শালে বিচার করে সকলকে ফাঁসি বা গুলি করে মেরে ফেলবে। সকল কিছুই সম্ভব। মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছিলাম।’

এ বইটা পড়া শেষ করে আমি ভীষণভাবে বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করি। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। নিজের মনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ উঠে যায়। কোনোভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিলাম না যে এমন একজন ত্যাগী নেতার পরবর্তী সময়ের করুণ পরিণতির কথা ভেবে। আমরা জাতি হিসেবে ঠিক কতটা সৌভাগ্যবান যে আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিল। যাহোক অবশেষে মনের অবস্থা কিছুটা স্থির হলে এই রিভিউ লেখা শুরু করি কিন্তু তবুও মনমতো হয়নি। কারণ, মনের ওপর থেকে চাপটা এখনো পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। জানি না, কোনো দিন হবে কি না? হয়তোবা বাকি জীবন এই দুঃখবোধটা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। তবে এরপর পড়ব বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইটা। আশা করি, সেটা অনেক বড় সহায়ক হবে। ঠিক যেভাবে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় কবিগুরুর দুটি লাইন বঙ্গবন্ধুর মনে সব সময় শক্তির জোগান দিত, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’