বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যেন সময়ের দলিল

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’

বাসায় রাখা পত্রিকার পাতা থেকে জানলাম, বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা ডায়েরির সংকলন বাজারে আসছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে। সপ্তাহান্তে দৌড়ালাম শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকানে। গিয়েই বইটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলাম। বইয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু ছবি ছিল। এরপর বইয়ের দামটা দেখে চুপসে গেলাম। কারণ, পকেটে অত টাকা নেই। মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আক্ষেপ তৈরি হলো। বইটা তাকে রেখে দোকানিকে বললাম, এই বই সরকারিভাবে প্রতি পরিবারে এক কপি বিনা মূল্যে দেওয়া উচিত। দোকানি আমার কথা শুনে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি এইমাত্র টুপ করে খসে পড়েছি মঙ্গল গ্রহ থেকে। বইটা কিনতে না পেরে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে এলাম। এরপর হয়তো মনের ভেতরের রাগ থেকেই বইটি আর সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি। প্রবাসে আসার পর এক বড় ভাই আমাকে বইটি উপহার দিয়েছিলেন। তবুও বইটা পড়া হয়নি। অবশেষে পড়া শুরু করলাম জাতীয় শোক দিবসের পর। যেই শুরু করলাম, এরপর একটানা পড়ে শেষ করলাম। প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে বই পড়ার সময় বের করা মোটামুটি অসম্ভব। তবু আমি ট্রেনে, অফিসের কম্পিউটারে পিডিএফ আর বাসার অবসর সময়টুকু মিলিয়ে বইটা পড়লাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্যান্য লেখকদের লেখা পড়েছি। তন্মধ্যে আবু মুসার লেখা ‘মুজিব ভাই’ বইটা মনে দাগ কেটেছিল। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুনেছি কত না গল্প! এর বাইরেও পত্র–পত্রিকায় পড়েছি তাঁকে নিয়ে ছোটখাটো অনেক লেখাই। কিন্তু তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা বই সেসব আনন্দ–উত্তেজনাকে ছাপিয়ে গেছে।

বইয়ের শুরুতে শেখ হাসিনার লেখা একটা ভূমিকা আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দী হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বারবার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনো আপস করেন নাই। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নাই। ছিলেন জনগণ অন্তঃপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন—এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।’ এরপর আছে এই ডায়েরি হাতে পাওয়ার গল্প এবং হাতে পাওয়ার পর ওনাদের দুই বোনের মনের অবস্থার বর্ণনা। আরও আছে পাঠোদ্ধারের গল্প। উনি আরও লিখেছেন, ‘এই লেখাগুলো বারবার পড়লেও শেষ হয় না। আবার পড়তে ইচ্ছা হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, একজন মানুষ কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল–জুলুম–নির্যাতন সহ্য করতে পারেন, তা জানা যায়। জীবনের সুখ-স্বস্তি, আরাম, আয়েশ, মোহ, ধনদৌলত, সবকিছু ত্যাগ করার এই মহান ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়।... তথ্যবহুল লেখায় পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা চক্রান্ত ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা ও ইতিহাস জানার সুযোগ হবে।’ এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে একান্ত নিরিবিলি সময়ে তিনি লিখেছেন। বইয়ের শেষে সংক্ষিপ্ত  আকারে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে, যেটা লেখকের নিজের লেখা নয়। বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখাটার তীব্র স্রোতে ভেসে এসে পাঠককে তাই ধাক্কা খেতে হয়। এমন পরোপকারী, জনদরদি একজন মানুষের এমন পরিণতির কথা পড়ে।

আমি বই পড়তে বসলে হাতের কাছে কয়েক রঙের হাইলাইটার রাখি চুম্বক অংশগুলো চিহ্নিত করার জন্য। এই বই পড়ার সময় এমন হয়েছে যে প্রায় প্রতি পাতায়ই আমি কিছু না কিছু লাইন দাগিয়েছি। কারণ, বইটা শুধুই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নয়, বরং সময়ের দলিল। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালে, যখন এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চলছে। ব্রিটিশদের তাড়িয়ে ক্ষমতায় আসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু শুরু থেকেই তারা আমলানির্ভর একটা জনবিচ্ছিন্ন সরকার গঠন করে। এরপর তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে যায় যে একসময় জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেটা আর তারা খেয়ালও করে না। আওয়ামী লীগ যখন একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হলো, তখন আবার জোরপূর্বক তাদের দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র একই সময়ে জন্ম নিলেও পাকিস্তান তার লক্ষ্য থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছিল। দীর্ঘ সময় পার করেও তারা একটা শাসনতন্ত্র দেশের জনগণকে দিতে পারেনি, যার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বইয়ের শুরুটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘বন্ধু–বান্ধবরা বলে, তোমার জীবনী লেখো। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখো, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।” বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।...হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যত দূর মনে আছে, লিখে রাখতে আপত্তি কী! সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুইটাও ব্যথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম।... আমার স্ত্রী, যার ডাকনাম রেণু—আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’

পুরো বইটার সবচেয়ে উপভোগ্য দিক হলো, বইটা প্রথম পুরুষে লেখা। প্রথম পুরুষে লেখা যেকোনো বই দ্রুতই পাঠককে বইয়ের পাতায় আবদ্ধ করে ফেলে। পাঠক দিব্যদৃষ্টে সব ঘটনা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেন। আমিও এই বই পড়তে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর একেবারে শৈশব থেকে শুরু করে সব ঘটনাই যেন দেখতে পেলাম। এ ছাড়া বইটিতে লেখক অনেক ঘটনা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যেটা ভবিষ্যতে এসে ফলে গিয়েছে। এতে করে লেখকের দূরদৃষ্টির পরিচয়ও পাওয়া যায়। এ ছাড়া আমাদের মানসিকতা গঠনের বিষয়টিকেও দেখেছেন খুবই গভীর দৃষ্টিতে। বাংলাদেশিদের চরিত্রের এমন অনেক বিষয়ে লেখক আলোকপাত করেছেন যাতে করে সহজেই আমাদের ব্যক্তিগত এবং জাতিগত চরিত্রের মনস্ত্বাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সহজ হয়ে যায়।

পাশাপাশি রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব–কর্তব্য কেমন হতে হবে, সে বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায়। এ ছাড়া সরকারি আমলা এবং সেনাবাহিনীর কর্মপরিধি কেমন হবে, সেটাও বুঝতে পারা যায়। আর এর অন্যথা হলে দেশ ও জাতির কপালে কী ঘটতে পারে, সে বিষয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবন বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদীর মতো। সেই নদী গিয়ে মিশেছে অন্য অনেক নদীর সঙ্গে। কখনো তারা বয়ে চলেছে একসঙ্গে, আবার কখনো বা আলাদা পথে। সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তিত্বের। তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিলেন তাঁর বাবা। হয়তো বা পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবার আদর কিছুটা বেশি পেয়েছিলেন। দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর বাবা অনেকবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন কেবল বঙ্গবন্ধুর মুখদর্শনের পরই। বঙ্গবন্ধুও তাঁর বাবাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসতেন। তাঁর সব আবদারের কেন্দ্র ছিলেন বাবা। বঙ্গবন্ধুর বাবা বলেছিলেন, ‘sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ আরেক দিন কথাপ্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাবা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট না–ও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধুর বাবা অনেক সময় তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ করে প্রশ্ন করতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে খুবই ভালোবাসতেন। আর বঙ্গবন্ধুও তাঁকে ত্যাগী নেতা হিসেবে অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা করতেন। এমন নয় যে শহীদ সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কখনো মনোমালিন্য হয়নি, কিন্তু সেটা সাময়িক। আসলে দুজনের মনের এবং নীতির মিল থাকলে ভুল–বোঝাবুঝিগুলো হয় নিতান্তই সাময়িক। শহীদ সাহেবকে নিয়ে এই বইয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয়েছে। তাঁর পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তানের ঐক্যে নিজেকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া, আবার পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মন্ত্রিত্ব গ্রহণসহ অনেক বিষয় এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। বঙ্গবন্ধু বারবারই শহীদ সাহেবের ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তাঁর সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন।… অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি, ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে উঠলেন, কারণ তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না।...বাংলাকে তিনি যে কতটা ভালোবাসতেন, তাঁর সঙ্গে না মিশলে কেউ বুঝতে পারত না।... শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মতো উদার। যেকোনো লোক একবার তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে ‘নানা’ বলে সম্বোধন করেছেন আর মাওলানা ভাসানীকে বলেছেন ‘মাওলানা’।

এই বই পড়লে বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক চরিত্রের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু একাধারে ছিলেন দুরন্ত, আবার অন্যায় দেখলে প্রতিবাদী। এক দিকে প্রকৃতিপ্রেমী আবার অন্য দিকে তাঁর হাস্যরসও ছিল ঈর্ষণীয়। একবার দিল্লিতে একটা কনভেনশনে যোগ দিতে গিয়ে সেখানে ভ্রমণের সুযোগ পান। সেই সুযোগে দিল্লির সব দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেন। সেসব জায়গার চমৎকার বর্ণনা আছে এই বইতে। তাজমহলের সৌন্দর্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কী দেখলাম, ভাষায় প্রকাশ আমি করতে পারব না। ভাষার ওপর আমার সে দখলও নাই। শুধু মনে হলো, এ–ও কি সত্য? কল্পনা যা করেছিলাম, তার চেয়ে যে এ অনেক সুন্দর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। তাজকে ভালোভাবে দেখতে হলে আসতে হবে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাবার সময়, চাঁদ যখন হেসে উঠবে, তখন।... সন্ধ্যার একটু পরই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কী অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না। দারোয়ান দরজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম।’

বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সে বিষয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটা পড়ার পর লেখার ইচ্ছা আছে। কারাগারে বন্দী থাকা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কী কষ্টের, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না।’ এভাবে কারাগারে বন্দী থাকতে থাকতে তিনি পরিবার–পরিজন থেকে বেশির ভাগ সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকতেন। আবার কারাগারের বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবারকে ঠিকমতো সময় দিতে পারতেন না। পরিবারের মানুষদের সঙ্গে বন্ধনটা কেমন হয়ে গিয়েছিল, তার একটা মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে এই বইতে। একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, আমি তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলি?” আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমি তো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়।’

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম ধাপ ছিল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং কারাবরণ করেছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাহিত্য–সংস্কৃতির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম টান। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধু একদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেডারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’ আব্বাসউদ্দিন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ বঙ্গবন্ধু আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে কথা দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তো আসলে ছিলেন বাংলার জনসাধারণের বন্ধু। ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে বাংলাদেশের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ তাঁকে ভালোবাসতেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময়ের একটা ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। এই বই থেকে বঙ্গবন্ধুর জবানিতে লেখাটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। ‘আমার মনে আছে, খুবই গরিব বৃদ্ধ এক মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমাকে একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না, আমার মাথায়–মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের বিষয়টা সর্বজনবিদিত। তাই আমি ইচ্ছা করেই সেদিকটা এড়িয়ে গেছি। এই বই পড়ে আমি যেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই সময়ে পরিভ্রমণ করে এলাম। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু দুর্লভ স্থিরচিত্র স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি আছে তাঁর হাতে লেখা ডায়েরির প্রতিলিপি। এটা আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে। কেমন ছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির হাতের লেখা। বারবার ছুঁয়ে দেখেছি! পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, বাংলাদেশি হিসেবে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকের অবশ্যপাঠ্য এই বই। বইটি নিয়ে হোক অনেক পাঠ–সমাবেশ। হোক আলোচনা। শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, সেখানে ফিরে আসি। সরকার অন্ততপক্ষে এই বইয়ের একটা কপি প্রতি পরিবারকে বিনা মূল্যে দিয়ে পাঠে উৎসাহিত করতে পারে।