আমাদের তৃতীয় হাত

মেট্রোরেলফাইল ছবি

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। একটা মানুষের জীবনের মূল্য মাত্র পাঁচ লাখ।

সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে এমন অপঘাতে সাধারণ মানুষেরাই মরে, ভিআইপি বা ওদের আত্মীয়স্বজন মরে না। মরলে প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসত।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ঘটনাটা নিশ্চয়ই এক দিনে ঘটেনি। দিনের পর দিন ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব জিনিস ক্ষয় হয়। কথা হচ্ছে, একে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার? সে দায় স্বীকার করবে না, এটা নিশ্চিত। আমাদের দেশে এই কালচার কখনোই ছিল না। আমরা সব সময় নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে অভ্যস্ত।

নিহত ভদ্রলোকের পরিবারকে যে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে, এইতো অনেক। আমি তো আশা করেছিলাম সরকার থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে ‘কাজটা বিরোধী দলের। ওরা পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছে, তাই ওটা খসে গেছে।’

কথাটা পরিচিত মনে হচ্ছে? একটা বহুতল ভবন ধসের সময়ে আমাদের এক আওয়ামী জনপ্রতিনিধি এমন মন্তব্য করেছিলেন। তিনি খুব সম্ভব সরাসরি বিএনপির নাম নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

এখন বিএনপি বা বিরোধী দলের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ বসিয়ে দিলেই চলবে।

একদল দাবি করছেন, এর দায় শেখ হাসিনা সরকারের। দুর্নীতি করেছে, তাই এভাবে খসে খসে পড়ছে।

এটাও অবান্তর। আমি যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিই, তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন আমি কী বোঝাতে চাইছি।

যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল জীবন থেকেই আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় যখন তোমাকে কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেটাকে সম্পন্ন করার দায়িত্ব তোমার। তুমি কীভাবে করবে, সেটাও তোমার দায়।

‘আমি অসুস্থ ছিলাম’, ‘আমি অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে প্রিন্ট করেছিলাম, কিন্তু আমার কুকুর সেটা খেয়ে ফেলেছে’, ‘আমার দাদি বা বিড়াল ইত্যাদি মারা গেছে’—ইত্যাদি কোনো বাহানা কাজে আসবে না। আমার এক বন্ধু প্রতি সেমিস্টারে ওর দাদিকে মেরে ফেলত। একদিন ওর টিচারই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘তোমার কয়টা দাদি যে দুদিন পরপর মরেন?’

সে জবাবে বলে, ‘দাদা চারটা বিয়ে করেছিলেন।’

তেমনই ‘আগের ম্যানেজার এই ওই করে গেছে’—এটা কোনো অজুহাত নয়। আমাদের হাত দুটি, ডান আর বাম, ‘অজুহাত’ নামে তৃতীয় কোনো হাত আমাদের থাকতে পারে না। কিন্তু বাঙালি তিন হাতের জাতি।

আগের ম্যানেজার পারেনি বলেই তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তুমি না পারলে হয় স্টেপ ডাউন করো, নাহলে তোমাকে বরখাস্ত করে নতুন কাউকে নেওয়া হবে, যে কাজটা ঠিকঠাকভাবে শেষ করতে পারবে।

তা এখন এই ব্যাপারটাই আমাদের দৃশ্যপটে অ্যাপ্লাই করেন।

আগের সরকার ভোটচোর ছিল, স্বৈরাচারী ছিল, দুর্নীতিবাজ ছিল, গণহত্যাকারী ছিল—ওদের হটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বসানো হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে, এটা দীর্ঘ সময়। এতদিনে আস্ত দেশ মোটামুটি একটা অবস্থায় বা পর্যায়ে চলে আসার কথা। এখন কোনো অজুহাত নেই ‘আগের সরকার এই করে গেছে, তাই দায় ওদের’ বলার। যেমনটা আওয়ামী লীগ করত। ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি সরকারের ওপর দায় চাপাত।

বিএনপিও একই কাজ করত।

এই সরকারও যদি একই কাজ করে, তাহলে বদলাল কী?

সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, আমরা ১৯৭১ সালে। সিঙ্গাপুর ছিল একটা বস্তি জনপদ, আমরা ছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত। আজকে সিঙ্গাপুর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, আর আমরা? কেন? কারণ, আমাদের ওই তৃতীয় হাত, ‘অজুহাত’।