আমেরিকা ও কালচারাল শক
আমেরিকায় এসে প্রথম কালচারাল শক খাই লস এঞ্জেলেস বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই। একটি দালানে সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘জেন্টেলম্যান্স ক্লাব।’ আমাদের দেশের যেটা ‘নিষিদ্ধ পল্লী।’ (তবে এইগুলো ঠিক হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসের ‘রঙ্গিলা নটীবাড়ি’ (পতিতালয়) না, এগুলো স্ট্রিপ ক্লাব।) আমাদের নিষিদ্ধ পল্লীগুলোতে কেউ এভাবে বিলবোর্ডে সাইন বোর্ডে লিখে লিখে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে না। এদেশ ‘প্রচারেই প্রসার’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। বুঝে গেলাম, এই দেশে বসবাসটা ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে। তারপরে শুরু হলো শকের পর শক। কোনটা ফেলে কোনটা বলব গুছিয়ে উঠতে পারছি না।
তবে প্রথম ধাক্কা খেলাম নারী পুরুষের অবাধ চুম্বন দৃশ্যে। আমরা যেটা আগে শুধু স্টার মুভিজ এবং এইচবিওতে দেখতাম, তাও বড় কেউ সামনে বসা থাকলে রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টে দিতাম। বলিউড সিনেমায় ইমরান হাশমি বিপ্লব এনেছিলেন। ‘চুম্বন দেবতা’ ছিলেন তিনি। প্রতিটা সিনেমাতেই প্রসাদ বিতরণ করতেন। এদেশে সবাই চুম্বন দেবতা। ইচ্ছেমতন প্রসাদ বিতরণ চলে। স্থান কাল পাত্র কেউ পরোয়া করে না।
তবে নারী পুরুষের এই অবাধ চুম্বনের চেয়েও বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম পুরুষে পুরুষে চুম্বন ও হাত ধরাধরি করে হাঁটার দৃশ্য দেখে। আমাদের পুরুষেরা তাঁদের পুরুষ বন্ধুদের হাতে হাত ধরে অবাধে হাঁটাহাঁটি করেন। কেউ কেউতো কাঁধে হাত দিয়ে চলেন। দৃশ্যটা সেখানে খুবই স্বাভাবিক। আমার এক ব্রিটিশ দুলাভাই (সিলেটি, তবে ওখানেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা) জীবনে প্রথমবারের মতন ঢাকায় গিয়ে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলেন। অতি লজ্জিত কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, ‘এদেশে ছেলেরা এমন কেন? তোরা মেয়েদের হাত ধরে হাঁট, এভাবে ছেলে ছেলেতে মেলামেশা, ঘষাঘষি—কেউ খারাপ বলে না?’
আমি তখন মজা পেয়ে বললাম, ‘আরে না। আমাদের এখানেতো এক ছেলে বন্ধু যদি আরেক ছেলে বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাতে চায়, এক বিছানায় শুতে চায়, আমাদের প্যারেন্টসরা হাসিমুখে রাজি হন।’
দুলাভাই চোয়াল ঝুলিয়ে বললেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’
তো সেটা ছিল হাসি ঠাট্টা। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা সিরিয়াস। ক্যালিফোর্নিয়ায় এ দৃশ্য অহরহ দেখা যেত। আমাকেও একবার একজন ছেলে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কাজ কয়টায় শেষ হবে। সে এলাকায় (ডালাস) নতুন এসেছে। আমি কী তাঁকে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখাতে পারব কি না।
যদিও কাজ মাত্র আধঘণ্টা পরেই শেষ হচ্ছিল, তারপরেও চোখমুখ শক্ত করে বলছিলাম, ‘আমি মাত্রই কাজেই এসেছি এবং আমিও এলাকায় নতুন, কিছুই চিনি না। স্যরি।’
ছেলেটা উৎফুল্ল স্বরে বলেছিল, ‘তাহলে তো আরও ভাল! দুজনে মিলে আবিষ্কার করবো। খুব মজা হবে!’ কাস্টমার। দুর্ব্যবহার করা যায় না। তাই আমি যান্ত্রিক স্বরে বলেছিলাম, ‘দুঃখিত। কাজ শেষে আমার পড়াশোনা আছে। পরীক্ষা চলছে। আমাকে পড়তে হবে।’ ছেলেটা বুঝতে পেরেছিল আমার আগ্রহ নেই। মর্মাহত হয়েছিল বোধ হয়। মেয়েরা কেন অবলীলায় ছেলেদের কুসুম হৃদয় ভেঙ্গে দেয়, সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, আগে টেক্সাসে কম দেখা গেলেও এখন চোখ সওয়া হয়ে গেছে। আমার নিজেরই বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন সমকামী। হোমোফোবিয়া কেটে গেছে বহু আগেই। ওরা কীভাবে জীবন কাটায়, সে ব্যাপারে আমার নাক গলানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমরা তো এখনো বাঙালি প্যারেন্টসই রয়ে গেছি।
আমাদের এক বান্ধবী তাঁর চার বছরের ছেলেকে প্রতিদিন এই বুলি মুখস্ত করায়, ‘বাবা, তুই নিজের জন্য একটা মাইয়া জোগাড় করবি। সাদা হোক, কালা হোক, ইন্ডিয়ান হোক, চাইনিজ হোক—কোনোই সমস্যা নাই। আমার একটাই কন্ডিশন, আল্লাহর ওয়াস্তে তুই নিজের জন্য একটা মাইয়া জোগাড় করবি।’
কী দারুণভাবে আমাদের মায়েদের ডিমান্ড বদলে গেল।
একটা সময়ে আমাদের বাংলাদেশি মায়েরাই (এখনো) পুত্রবধূ বাছাইয়ে কত নখরা যে করতো। এই মেয়ের নাক খাড়া, ঐ মেয়ের বোচা, এই মেয়ের চোখ টানা, ঐ মেয়ের বুজা আর রং শ্যামলা হলে তো কথাই নেই। এখন সবাই লাইনে ফিরেছে। ‘মেয়ে হলেই হলো।’
তো আমার ছেলেও মন্টিসোরিতে যাওয়া শুরুর পরে থেকে মাশাল্লাহ নিজের ক্লাসের মেয়ে মহলে তাঁর ডিমান্ড ভালোই। বয়সের তুলনায় একটু লম্বা হওয়ায়, প্রায়ই তাঁকে তাঁর চেয়ে এক বছরের বড় গ্রুপের সাথে মেশানো হয়। দেখা যায় সে কিছু কথা কুতিয়েকাতিয়ে বলতে পারলেও তাঁর সহপাঠীরা বেশ পটর পটর করে কথা বলতে পারে। কথা উঠায় দুই আরব কন্যার কাহিনি বলা যাক।
একজন আমাকে ‘ড্যাডি’ বলে ডাকতো, তো আরেকজন আমার বউয়ের সঙ্গে ফটো তুলত। দুইটা বাচ্চাই দেখতে পুতুলের মতন। ছেলে ক্লাসে গেলেই ‘হাই রিসালাত’ বলে দুজনই ছুটে আসতো তাঁর জ্যাকেট খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখার জন্য। তাঁর সঙ্গেই দুজনে খেলতে আগ্রহী। নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন।
এদিকে যাকে নিয়ে এত আগ্রহ, সে একেবারে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিজের মনে খেলে। পাত্তাটাত্তা দেয় না। খুব সম্ভব বাঙালি এক মেয়েকে ভালবেসে বসে আছে।
যা–ই হোক, আগের স্কুলের এক টিচারের অসভ্যতায় স্কুল পরিবর্তন করে নতুন স্কুলে দেওয়ার পরে এখানেও দেখলাম দুই একজন জুটে গেছে। ছেলেকে নিতে যাবার সময়ে এক মেয়ে নিজে থেকেই এগিয়ে এসে পরিচিত হলো। ‘হ্যালো আমার নাম লিডিয়া, আমি আর রিসালাত এক সঙ্গে খেলি। আজকে আমরা দুজন দোলনায় চড়েছি।’
আমি আবার শ্বশুর হিসেবে ভীষণ দিল দরিয়া। ছেলের পছন্দই আমার পছন্দ। ছেলের না পছন্দও আমার পছন্দ। ওর ক্লাসের প্রতিটা মেয়েকে আমি তাই পুত্রবধূর চোখে দেখি।
আমার বউ এসবে খুবই মজা পায়। দেশে আমার শাশুড়িকে ফোনে শোনায়। ওপাশ থেকেও সবাই আনন্দ পায়।
লিডিয়া তারপর খুবই নির্বিকার স্বরে বললো, ‘আমার ফিফথ বার্থডেতে আমার মা–বাবা বিয়ে করবে।’
আমার বউ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। বেচারি মাত্রই আরেকটা কালচারাল শক খেলো। ওয়েলকাম টু অমেরিকা।
‘ওহ দারুণ!’ জেনুইন খুশি গলায় বললাম, ‘তুমি কী একসাইটেড লিডিয়া?’
সে জানালো ‘ইয়েস আই অ্যাম।’
তারপর লিডিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কী রিসালাতের সঙ্গে খেলতে ভাল লাগে?’
সে সরল মনেই জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু মাঝে মাঝে ও ডাইপারে হাগু করে দেয়। তখন ভাল লাগে না। অনেক গন্ধ।’
আমি হো হো করে হেসে দিলাম।
আহারে আমার ছেলের প্রেম কাহিনি! গার্লফ্রেন্ডের সামনে ইজ্জতের মারামারি।
দূর পরবাসে ভ্রমণকাহিনি, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]