গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা (কানাডা পর্ব শেষ)
যা-ই হোক, ঘটনাটা আচমকা হওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই জায়গা থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যাই সোজা বাসার দিকে। তবে যে কানাডিয়ানের ব্যবহার খারাপ, তাকে সামলানো মুশকিল। হয়তো ওই দিন টিমে গিয়ে এক গ্লাস কফি কিনলেই বিষয়টা মিটমাট হয়ে যেত। মূলত অমন রূঢ় ব্যবহারের পর ওর কথা মেনে কফি কিনে খাব, সেটা অসম্ভব, অন্তত আমার ক্ষেত্রে! কথাটা ভালোভাবে বললে হয়তো নিজেই গিয়ে কিছু কিনতাম! পরের দিনই আবার আরেকবার গিয়েছিলাম নোভা স্কসিয়া ওয়ার্কসের অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বলে, গাড়ি ছাড়াই! ব্যাপারটা ভেতরের অফিসারকে খুলে বললাম। ওই মেয়েও খুব হতবাক হয়ে বলতে লাগল, ওরাও অন্য কোনো জায়গায় সুবিধা করতে না পারায় টিমের পার্কিংয়ে গাড়ি রাখে, আজও রেখেছে। তবে প্রায়ই কফি বা এটা–সেটা টিমস থেকে কেনা ওদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অতএব উপসংহারে এটাই বলা যায়, অর্থই অনর্থের মূল!!
ড্রাইভিং যখন শুরু করি তখন আশেপাশের ছেলেপুলেদের সহযোগিতা ছাড়াও কানাডিয়ান এক গাড়ি কোচিং কোম্পানিতে ক্লাস নিয়েছিলাম। এর মালিক পল হলেও ওরা দুজনই গাড়ি চালানোর ক্লাস করাত। আরেকজন ডেভিড। আমার ক্লাস নিয়েছিল ও। সুমনের মতে, এদের কাছে ক্লাস করার সুবিধা হলো, মূল ড্রাইভিং টেস্টের দিন এদের কাছ থেকে গাড়ি ধার নেওয়া যায়। নিজস্ব গাড়িতে অনেক ছোটখাটো সমস্যা থাকতে পারে, যা অনেক সময় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে। তবে পরীক্ষার দিন নিরীক্ষক পুরো গাড়ির কলকবজা চেক করার সময় টুকটাক কিছু পেলেই বাতিলের তালিকায় ফেলে দিতে পারেন। ওদের গাড়ি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সেসব সমস্যা থেকে রেহাই দেয়। তবে প্রতিদিন ড্রাইভিংয়ের খরচ বেশ চওড়া—পঞ্চাশ ডলার প্রতি ঘণ্টায়। সে যা-ই হোক, সোমবারের এক হিমশীতল সকালে পল তার সাদা রঙের হোন্ডা গাড়িতে আমার ট্রেনিং ক্লাস নিতে হাজির। গাড়িতে করে আমাদের গন্তব্যস্থল হলো উইটনি পিয়ারের ড্রাইভিং করার জায়গায়। বলা বাহুল্য, ওখানে এর আগে কখনো যাওয়া হয়নি। প্রথমে ডেভিড নিজে শুরু করলেও পরে আমার হাতেই স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল। আরও একটা মজার ব্যাপার হলো, পাশের যে সিটে প্রশিক্ষক বসেছেন, ওর পায়ের নিচেই আরেকটা ব্রেকিং প্যাডেল রয়েছে, যাতে আনাড়ি ড্রাইভারের কোনো ভুল হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। খুব সম্ভবত এটা ট্রেনিং করার সব গাড়িতেই থাকে। বেশ কয়েকবার ডেভকে ওই প্যাডেলের ব্যবহার করতে হয়েছে ইতিমধ্যেই। ওখান থেকে শুরু হয়ে ভেতরের দিকের ওই সমস্ত রাস্তায় আমরা ঘুরেফিরে একই পথে ফিরে এসেছি। এখানে গাড়ির ট্রাফিক তুলনামূলকভাবে কম। মূলত কোনো জায়গায় কীভাবে গাড়ি থামাবেন, বিভিন্ন থেমে চলার চিহ্ন, আরও কিছু সাইন যেমন— পথচারী পারাপার, স্কুলের জায়গা, ডানে-বায়ে ঘোরার নিদের্শনাগুলো শেখানোর চেষ্টা করেছে ডেভ। তবে এ ক্ষেত্রে টাকা পয়সার একটা ঝামেলা পোহানো চলেছে। আমি কয়েকটা ক্লাসের পর কাজের সিডিউল নিয়ে ঝামেলায় পড়ি। তখন থেকে ক্লাস এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
পরে আমার আরেক সহপাঠি রুচিও ওখানে ক্লাস শেষ করে লাইসেন্স পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যায়। হয়তো ওর অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে অনেক খরচের পাশাপাশি সময়ও ঠিকঠাক কাজে লাগানো যেত। মূলত ভালো চাকরির অনিশ্চয়তা, অতিমারীর কারণে চাকরির ওই সময়ের অচলাবস্থা কাটিয়ে হ্যালিফ্যক্সের দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে পরীক্ষার সময় নেওয়ার পরও আর অংশগ্রহণ করা হয়নি। তবে লাইসেন্স পরীক্ষার রোড টেস্টের সুবিধা হচ্ছে এই যে টাকা জমা দেওয়ার কাগজের রিসিটটা সযত্নে রেখে দিলে ওটা কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ হয় না। যখন আপনি প্রস্তুতি শেষ করবেন, এরপর আবার পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে দিন। কোন সমস্যা নেই!
রুচির ক্লাস করার ধরন অনুসরণ করলে হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যেমন ও পুরো ড্রাইভিং কোর্স নিয়েছিল। এক্ষেত্রে ওর প্রশিক্ষক ছিল পল নিজেই। রুচির ভাষ্যমতে, পল অনেক ধৈর্যশীল ছিলেন, সবকিছুর ক্ষেত্রেই যা ডেভিড ছিল না। আমি নিজে পলকে অনেকবার ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বললেও আমার ক্লাস নিতে আসতো ডেভ। অনুমান করলেও কেন জানি মনে হয় ওদের মধ্যে এমন কোনো বোঝাপড়া ছিল, যাতে পল শুধু পুরো কোর্সে অংশগ্রহণকারীদের ক্লাস করাবেন আর বাকিদের ডেভিড। পুরো কোর্স শেষে প্রশিক্ষণকারীকে সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। এর সাথে ডিসকাউন্ট পাওয়ার একটা কথাও জানিয়েছিল রুচি। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
লাইসেন্স পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষা দিতে ওদের সরকারি ওয়েবসাইটে গাইড পাওয়া যায়, সেটা ভালোভাবে পড়ে প্রস্তুতি নিতে হয়। এ ছাড়াও প্রশ্নের নমুনাপত্র পাওয়া যায়, যেটা কাজে আসবে। অতিমারির প্রাথমিক ধাক্কার পর এ বছরের শুরুতে যখন আমি হ্যালিফ্যাক্সের দিকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই, তখন আবারও একবার ক্লাস নিতে চেয়েছিলাম, যাতে করে ওদের গাড়িটা নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যায়। তারিখও নিয়ে ফেলি। যোগাযোগ করতে গিয়ে কিছুটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। এবারও যথারীতি পলকে পাওয়া যায়নি কিন্তু ডেভিডের জবাব এলো। যখন কল করলাম তখন আমাকে অন্য আরেকটা নাম্বারে যোগাযোগ করতে বললো ও। কল রিসিভ করে আরও হতবাক হয়ে শুনলাম, নারী কন্ঠ! উনি আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিলেন। পরে যখন ডেভ এসে উপস্থিত হলো তখন রহস্যের জট খুললো। অতিমারির পরপরই পলের সঙ্গে আর কাজ করছে না ডেভ। এখন সে নিজেই প্রশিক্ষণ দেয়। যিনি ফোন রিসিভ করে আজকের ক্লাসের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন তিনি ডেভের সহধর্মিণী ভিন্ন আর কেউ নন! ওইদিন গল্পের এক পর্যায়ে ডেভ বললো, টাকা পয়সা বা অফিসের কোনো ব্যাপার ও দেখে না, সবটাই দেখভাল করেন মিসেস ডেভ।
মূলত ও-ই সময়ের ডেভের সাথে করা তিন দিনের ক্লাস আমাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল। আর যা ই হোক, পুরো ড্রাইভিং কোর্স শেষ না করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছি না। এটাই মনস্থির করেছি! সাফল্য লাভে চড়াই–উৎরাই অনেক থাকবে আর থেমে যাওয়া মানেই নিঃশেষ হওয়া নয়। বিরতি আমাদের স্বতঃস্ফূর্ততার পাশাপাশি নতুন উদ্যমে শুরু করার প্রেরণাও জোগায়। জয়ী বা পরাজিত হওয়া কারও ভাগ্যে লেখা থাকে না, তা অর্জন বা বর্জন করতে হয়। (সমাপ্ত)
**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]