আল্পস পর্বতের গায়ে ঘুরেফিরে কয়েক দিন-২

বাসাটি আশ্চর্য রকমের ছোট। এয়ার বিএনবির বিজ্ঞাপনের ছবিতে যেমন দেখেছি, ভেতরটা তার চেয়ে সুন্দর এবং সাজানো–গোছানো। ১৫ স্কয়ার ফিট জায়গার মধ্যে যে দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে স্টুডিয়ো বাসাটি সাজানো হয়েছে, তাতে অভ্যন্তরীণ নকশা প্রণয়নকারী প্রকৌশলীর কাজের মুনশিয়ানার প্রশংসা না করলেই নয়। ছোট্ট জায়গার মধ্যে প্রয়োজনীয় কোনো কিছুর কমতি নেই। কামরার এক কোণে টয়লেট ও বাথরুম, দুটো চৌকি আকৃতির বিছানা দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করানো রয়েছে, এক কোণে ছোট্ট রান্নার স্থান, পাশেই দেয়ালের সঙ্গে চিকন বেঞ্চের মতো একটি তক্তা বসানো হয়েছে ডাইনিং টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য, সঙ্গে তিনটি লম্বা টুল রাখা হয়েছে, যাতে বসে খাওয়ার যায়। চারপাশের দেয়ালের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কেবিনেট বসানো, ফাঁকে ফাঁকে পেইন্টিংয়ের ক্যানভাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি কেবিনেটের মধ্যে প্রয়োজনীয় হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন, তৈজসপত্র থরে থরে সাজিয়ে রাখা। বইয়ের তাকে সাজানো সারি সারি বই, শিশুদের খেলার নানা উপকরণ। দেয়ালের সঙ্গেই কেবিনেট আকৃতির কাপড়চোপড় রাখার আলমারি।

রেফ্রিজারেটর ও কিচেন কেবিনেটের মধ্যে কিছু চাল, স্প্যাগেটি, রান্নার মসলা, মদের বোতলসহ অন্যান্য খাদ্য–উপকরণ রাখা হয়েছে, যাতে কোনো পর্যটক এসে প্রাথমিক অবস্থায় খাবার সমস্যায় না পড়েন।

ঘুমানোর প্রয়োজন হলে আরাম কেদারাগুলো এক কোনায় সরিয়ে রেখে দেয়ালে দাঁড় করানো ম্যাট্রেস লাগানো চৌকি নামিয়ে নিলেই বিছানা হয়ে যায়। দেয়ালের সঙ্গে চৌকি এমনভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে যে স্পেস তৈরি করার প্রয়োজন হলে চৌকি বিছানার এক পাশে ধরে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিলেই দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে আটকে যায় যে কারও মাথার ওপর পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই। বলা যায়, ছোট্ট জায়গাটির মধ্যে দেয়াল থেকে বিছানা নামালে বেডরুম হয়ে যায়, আবার তুলে রাখলে ড্রয়িংরুম হয়ে যায়। আবার একই রুম কিচেন ও ডাইনিংরুম হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করা যাচ্ছে। ছোট্ট জায়গার এমন বৈচিত্র্যময় ব্যবহার অবাক করা মতো। রাস্তার দিকের কাচের দেয়ালের ওপারে ছোট্ট একটি বারান্দাও রয়েছে। বারান্দায় ছোট্ট একটি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা। টেবিলে ওপর কয়েকটি বড় মোমবাতি রাখা হয়েছে, হয়তো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মোমের আলোয় বসে কফির চায়ের পেয়ালায় চুমুক অথবা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করার জন্য।

এমন বিচিত্র ও নতুনত্বে ভরা একটি অ্যাপার্টমেন্ট পেয়ে আমরা বেশ রোমাঞ্চিত। বুদ্ধি প্রয়োগ করলে ছোট্ট জায়গাকেও পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায়, তার একটি বাস্তব নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন হলো এখান এসে।

ভোর থেকে যাত্রার ধকল ও বাসা খুঁজে বের করতে যে হয়রানি হতে হয়েছে, তাতে সবারই ক্ষুধার উদ্রেক আরও তুঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছে। সুমিকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগ থেকে বের করে গুছিয়ে রাখতে বলে দুপুরের খাবার কিনতে আমি বাইরে চলে গেলাম। প্রথমেই চিন্তা হলো রেলস্টেশনের পাশে অবশ্যই কোনো পিৎজা বা স্যান্ডউইচের রেস্তোরাঁ খুঁজে পাব, তাই প্রথমে ওদিকে গেলাম। স্টেশনের আশপাশে যে কয়েকটি পিৎজার রেস্তোরাঁ পেলাম তার সব কটি বন্ধ, দরজায় নোটিশ টাঙিয়ে লিখে রাখা হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টার পর খোলা হবে। একজন স্থানীয় পথচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আশপাশে কোথাও কাবাব বা পিৎজার রেস্তোরাঁ খোলা আছে কি? লোকটি একটি রাস্তা দেখিয়ে বললেন, এ রাস্তা ধরে ১০ মিনিট হাঁটলে একটি তুর্কি কাবাবের রেস্তোরাঁ খোলা পেতে পারেন। লোকটির নির্দেশনা মোতাবেক হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দুই পাশে বেশ কটি রেস্তোরাঁ পেলাম।

রেস্তোরাঁগুলোর বাইরের কাচের দেয়ালে বাহারি খাবারের ছবি ও মূল্যতালিকা লাগানো রয়েছে; কিন্তু প্রবেশ দরজায় তালা ঝোলা। কাচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে মনে হলো রেস্তোরাঁগুলো অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

দীর্ঘদিনের তুষার জমা ফুটপাত মানুষের পদচারণে কঠিন বরফের স্তরে রূপান্তরিত হয়ে আছে। আমার পায়ে তুষারের ওপর হাঁটার বিশেষ জুতা পরা থাকলেও দুবার পা পিছলে পড়ে গেলাম। এরপর আরও সাবধানতার সঙ্গে পা টিপে ফুটপাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে গেলাম; কিন্তু কোনো লাভ হলো না। রাস্তায় কোনো মানুষও নেই জিজ্ঞাসা করার। হঠাৎ আমার পাশে একটি গাড়ি এসে থামল, গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে এক যুবক জিজ্ঞাসা করল, আশপাশে কোথাও সুপারমার্কেট আছে কি, বলতে পারেন? আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, আমি এখানে নতুন, কোনো কিছুই চিনি না। ছেলেটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন চলে গেল। মনে হলো, লোকটিও হয়তো নতুন এলাকায় আমার মতো একই সমস্যায় পড়েছে। হতাশ হয়ে সুমিকে ফোন দিকে বললাম, কোথাও কোনো খোলা রেস্তোরাঁ পাইনি, আমি আর একটু খুঁজে দেখা চেষ্টা করছি। আরও কিছুদূর এগিয়ে মনে হলো, পিচ্ছিল রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে রাস্তা বাড়ানো ছাড়া কোনো লাভ হবে না। এবার রাস্তার অপর পাশের ফুটপাত ধরে বাসার দিকে এগোতে লাগলাম। একটি বড় বিল্ডিংয়ের এক কোনে একটি রেস্তোরাঁর দেখা মিলল, ভেতরে আলো জ্বলছে। ভাবলাম, এবার পরিশ্রম সার্থক। রেস্তোরাঁর কাছে এসে দেখি ভেতরে চেয়ার–টেবিলগুলো পরিপাটিভাবে সাজানো; কিন্তু কোনো লোক নেই। প্রবেশ দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে মনে হলো, ভেতর থেকে তালা লাগানো। এখানেও একটি নোটিশ টাঙানো, লেখা রেস্তোরাঁ সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে খোলা হবে। এর মধ্যে সুমির ফোন, ও জানাল, খাবার না পেলে সমস্যা নেই, বাসায় চলে এসো, ফ্রিজে ডিম ও মসলার তাকে একটি ময়দার প্যাকেট পেয়েছি এগুলো দিয়ে কিছু চাপড়ি ও ডিমের অমলেট বানিয়ে আপাতত চালিয়ে নেওয়া যাবে।

আমি রেস্তোরাঁ খোঁজার চেষ্টা বাদ দিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। বাসার ফিরে দেখি সুমি ইলেকট্রিক চুলা চালানোর চেষ্টা করছে। চুলায় সংযোগ বাতি জ্বলে আছে কিন্তু চুলা গরম হচ্ছে না। ও ব্যর্থ হয়ে আমাকে চেষ্টা করতে বলল। আমি চুলার প্রতিটি স্পর্শ বাটন বিভিন্নভাবে ব্যবহারের করে ব্যর্থ হলাম। ঘড়ির কাঁটায় তিনতে বাজতে চলেছে, কারও পেটে ভারী খাবার পড়েনি। এখানে আসার পর থেকেই কোনো কিছু সহজভাবে হচ্ছে না। শুরুর দিনই আনন্দের বদলে নিরানন্দে ছেয়ে ধরছে আমাদের। মনে হলো, কোন ভৌতিক জায়গায় এসে পড়লাম, সামনের দিন কটিতে আরও কী কপালে আছে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।

অবশেষে বাসার মালিকের মুঠোফোনে আবার কল করতে হলো। বললাম, বাসার সবকিছু ঠিক আছে; কিন্তু ইলেকট্রিক চুলা গরম হচ্ছে না। লোকটি একটি নির্দেশনা দিলেন, সেই মোতাবেক চুলার বাটন চাপার পর চুলা গরম হয়ে উঠল। কপালে যে অনিশ্চয়তার যে ভাঁজ পড়ে ছিল, তা মুহূর্তেই চলে গেল। ইলেকট্রিকের গরম উনুনে তৈরি হলো চাপড়ি আর ডিমের ওমলেট। তা–ই হয়ে উঠল অমৃত, পেটকে শান্ত রাখার ওই মুহূর্তের অন্যতম উপাদেয়।

খাওয়ার পর আমরা সবাই বিশ্রামে চলে গেলাম। ঘুম থেকে ওঠে দেখি সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বিল্ডিং সামনের সান্ধ্য বাতিগুলো জ্বলে ওঠায় পাসেজের উপর দিয়ে জমে থাকা সাদা তুষারের স্তর মুক্তার মতো চিকচিক করছে। আমাদের সবার শরীরেও ফিরে এসেছে ফুরফুরে ভাব। দেহ মন শান্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম, সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাকার আশপাশে হেঁটে দেখব এবং আসার সময় একটি রেস্তোরাঁয় বসে খেয়ে বাসায় ফিরব।

সেই অনুযায়ী সবাই ভারী পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লাম। বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে ওদের দুজনের বেশ সমস্যা হচ্ছিল, তাই বেশি দূর যাওয়ার হলো না। দুপুরের আবিষ্কার করা তুর্কি রেস্তোরাঁয় ঢুকে কাবাব ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে সেরে নিলাম রাতের ভোজ। রেস্তোরাঁটিতে কোনো ভিড় নেই। হঠাৎ কেউ এসে খাবারের পার্সেল নিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার কেউ টেবিলে বসে খাচ্ছে। নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম, এ এলাকায় কেন সারা দিন রেস্তোরাঁ খোলা থাকে না।

বরফে আবৃত এলাকা হওয়ার কারণে মানুষ ঘরের মধ্যে বৈদ্যুতিক হিটারের উষ্ণতায় সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তা ছাড়া রাস্তার ফুটপাতগুলো বরফে ঢেকে থাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে হাঁটতে বের হয় না। ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি এখানে চলাফেরার প্রধান বাহন। পাবলিক বাস থাকলেও সেগুলোতে দু–চারজন পর্যটক ছাড়া স্থানীয় লোকজনের খুব একটা চলাচল নেই।

মানুষের বাহিরমুখি না হওয়ার প্রবণতার কারণে রেস্তোরাঁগুলোয় মানুষের তেমন আনাগোনা হয় না। যার দরুন রেস্তোরাঁমালিকেরা সারা দিন একটানা রেস্তোরাঁ খুলে না রেখে কর্মচারীর মজুরি ও ইলেকট্রিক বিল সাশ্রয় করে। কারণ, রেস্তোরাঁ খোলা রাখলে বিক্রি না হলেও কর্মচারীর মজুরি ও বিদ্যুৎ বিল দিতেই হবে। যার কারণে যে সময়টায় মানুষের খাবারের চাহিদা বেশি থাকে, শুধু সেই সময়েই রেস্তোরাঁ খোলা রাখে। স্থানীয় মানুষদের বিষয়টি জানা থাকায় তাঁরা কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই সময় অনুযায়ী রেস্তোরাঁয় গিয়ে আহার করতে পারেন, কিন্তু আমাদের মতো পর্যটকদের হঠাৎ এসে পড়তে হয় সমস্যায়।

বাসায় ফিরে আমরা সামনের দিনগুলোতে কোথায় ঘুরতে যাব, তার একটি পরিকল্পনা করে নিলাম। প্রথম দিন ২১ ডিসেম্বর, ট্রামে করে আল্পস পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু পর্বত মোঁ ব্লতে ওঠার সিদ্ধান্ত হলো আমাদের। এরপর কিছুক্ষণ গল্পগুজব তারপর ঘুম।


*লেখক: মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ উজ্জ্বল, প্যারিস, ফ্রান্স

আরও পড়ুন