আল্পস পাহাড়ের গায়ে ঘুরেফিরে কয়েক দিন–১
ভ্রমণ ফরাসি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘদিন এ সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করে আমরাও কিছু কিছু বিষয়ে ফরাসিদের মতো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণ পছন্দ করি, সেই সঙ্গে স্ত্রী সুমি, তারও নতুন জায়গা ঘুরে দেখা অন্যতম পছন্দের বিষয়। যার কারণে প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে পরিবারের তিনজন মিলে কয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাই। নতুন স্থানের রংরস উপভোগ করে নতুন উদ্যম নিয়ে ফিরে আসি আপন গৃহে। এটা এখন আমাদের জীবনের বাৎসরিক রুটিনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আমরা চার দিনের জন্য গিয়েছিলাম ফ্রান্সের সমুদ্রবর্তী অঞ্চল পেই দো লা লোয়ার রেজিওতে।
ওই বছরের শেষের দিকে চীনের উহান শহরে নেমে আসে কোভিড নামের অদৃশ্য দৈত্যের কালো ছায়া। কিছুদিনের মধ্যে সেই ছায়া গ্রাস করে ফেলে সারা পৃথিবীকে।
স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। কোভিডকে প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে মানুষকে বেঁধে ফেলা হয় নানা নিয়মকানুনের বেড়াজালে। সম্মুখযুদ্ধের মতোই প্রায় দুই বছর ধরে চলে এ প্রতিরোধ লড়াই। বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছে শখের অনেক কিছু। ভ্রমণ না করা, সিনেমা হল ও থিয়েটারে না যাওয়া, রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা না দেওয়া ইত্যাদি। নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে আমরাও প্যারিস থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারছিলাম না।
২০২১–এর শেষের দিকে ফ্রান্সের অধিকাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসায় অনেক নিয়মকানুন শর্ত সাপেক্ষে শিথিল হতে থাকে। টিকা নেওয়ার সনদ প্রদর্শন সাপেক্ষে সরকার জনগণকে দূরবর্তী এক শহর থেকে অন্য শহর, ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার অনুমোদন দেয়। এর পর থেকে মানুষ দীর্ঘদিনের শৃঙ্খলিত জীবনযাপন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে ছুটতে শুরু করে। বছরের শেষের দিক ভ্রমণের মৌসুম না হলেও এই শীতের তীব্রতার মধ্যেই অনেকে অবকাশযাপনের জন্য সময় বের করে নেন।
আমি জুনের দিকে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এলেও এ দুর্যোগকালে দুই বছরে মিশেল ও সুমির যাওয়া হয়নি কোথাও। তাই ওদের নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার ভীষণ তাগিদ অনুভব করছিলাম, সেই সঙ্গে সুমির পক্ষ থেকেও জোর দাবি উঠছিল কিছুদিন কোথাও গিয়ে থাকার। যেহেতু শীতের সময়, তাই যেতে হবে কোনো শহরে অথবা পাহাড়ে স্কি করতে। সেই লক্ষ্যে অক্টোবর মাসজুড়ে আমাদের ভ্রমণ বাজেট অনুযায়ী আলোচনা চলল পাহাড় না শহর হবে আমাদের শীতকালীন ভ্রমণের স্থান। পাহাড়ে ঘোরাঘুরিতে খরচ বেশি, শহরে ভ্রমণ খরচ তুলনামূলকভাবে কম। ইচ্ছে ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় করা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘদিনের শখ পাহাড়ের ছবি তোলার আর সুমির ইচ্ছে স্কি করার। ভ্রমণ খরচ বাজেটের বাইরে চলে গেলেও কিছুটা সাহস করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আল্পসের চূড়ায় ওঠার।
ছোটবেলায় ভূগোল বই পড়তে গিয়ে জেনেছি আল্পস পর্বতের কথা। পৃথিবীর অন্যতম পর্বতটি স্বচক্ষে দেখব, তা ওই সময় কল্পনা করিনি। নম্বর তোলার লক্ষ্যে পরীক্ষার উত্তরপত্রে আল্পস সম্পর্কে মুখস্থ লিখেই সন্তুষ্টির ঢেকুর গিলেছি। কিন্তু আমার জীবন–জীবিকা একসময় আল্পস পর্বতের দেশ ফ্রান্সে হবে, সে কথাও তখন কল্পনা করিনি। কিন্তু আজ এটাই বাস্তব। অথচ ফ্রান্সে বসবাসের ১১ বছরের জীবনে আল্পসের বুকে পা রাখা শুধুই অপেক্ষা হয়ে থেকেছে। পর্বত ও বনভূমি আমার প্রিয় স্থান। যাত্রাপথে বাসে জানালা দিয়ে পর্বতচূড়া দেখেছি অনেকবার, কিন্তু পর্বতচূড়ায় উঠে ভূমি দেখার আক্ষেপের ইতি টানতে পারছিলাম না।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভ্রমণের দিন নির্ধারিত হলো ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বুকিং করা হলো এবং বাসস্থানের জন্য এয়ারবিএনবির মাধ্যমে বাসাও ভাড়া করে ফেললাম। প্যারিসের শীতের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সাধারণত ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামে না। তা–ও হঠাৎ কয়েক দিনের জন্য এমনটি ঘটে। কিন্তু আল্পস পর্বত এলাকায় শীতের মৌসুমে তাপমাত্রা সব সময় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করে। ফলে এ অঞ্চল বরফের আবরণে ঢাকা থাকে। তাই প্যারিসের ঠান্ডার পোশাক আর আল্পস অঞ্চলের ঠান্ডার পোশাকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। একদিন সময় করে আমরা তিনজন ফ্রান্সের একটি নামকরা খেলাখুলার সরঞ্জামের দোকানে গিয়ে আল্পস পর্বতাঞ্চলের বরফের মধ্যে চলাফেরা করার জুতা, জ্যাকেট, টুপি, ইনারসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কাজও সেরে ফেললাম।
আমাদের পরিবারে মূলত চারজন সদস্য। একজনের নাম ফেলিক্স। আমাদের আদরের বিড়াল। আল্পসে যাওয়ার আগে ওকে কোথাও রাখা নিয়ে একটা ছোট সমস্যা তৈরি হলো। অবশেষে পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে পেরু থেকে পড়তে আসা এক ছাত্রীর বাসায় ৫০ ইউরো প্রদানের শর্তে ফেলিক্সকে পাঁচ দিনের জন্য রাখার ব্যবস্থাও হলো। আমাদের ভ্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি বেশ ভালোভাবে সম্পন্ন হলো।
২০ ডিসেম্বর ভোর ৬টা ৪৭ মিনিটে আমরা প্যারিসের গার দো লিয় থেকে ট্রেনে গন্তব্য ছা জারভে লে বাঁ’র উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। ১০টা ৩০ মিনিটে আমরা অ্যানসি স্টেশনে পৌঁছাই। এখানে ৩৫ মিনিটের বিরতির পর আমাদের আরেকটি ট্রেনে উঠতে হয়।
অ্যানসি থেকে যাত্রা শুরুর পর কয়েক স্টেশন পাড়ি দিতেই আমরা বুঝতে পারি, নতুন ভূপ্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করেছি। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, হিমশীতের আভা প্রকৃতিতে বিরাজমান। ভূমির ওপর বরফের স্তর পড়ে সাদা হয়ে আছে চারিধার, স্থানীয় বাড়ির উঠান বা বারান্দায় কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ট্রেনের ভেতর থেকেই অনুভব করলাম বাইরের ঠান্ডার তীব্রতা কেমন হবে। উঁচু–নিচু পাহাড়ি এলাকার কোথাও ঘন বনভূমিতে তুষার পড়ে থোকা থোকা সাদা ফুলের মতো হয়ে আছে। গহিন পাহাড়ি বনের মধ্য দিয়ে কোথাও নালার মতো বয়ে গেছে, তার মধ্যে শান্ত স্রোতের ধারা। যাত্রাপথেই অনুমান করতে পারছিলাম, সামনের চার দিন আমাদের কেমন প্রকৃতির মধ্যে কাটাতে হবে।
প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রা শেষ করে আমাদের ট্রেন এসে থামল লা রোশ সু ফোরো স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মের ওপর নেমেই মনে হলো, আমরা অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করছি। কুয়াশা ও মেঘ প্রকৃতিকে এমনভাবে ঢেকে রেখেছে যে দূরে তাকালে সাদা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সূর্য মাঝেমধ্যে মেঘ ভেদ করে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাতেই চোখে ধরা দিল অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্য, কুয়াশাঢাকা অস্পষ্ট প্রকৃতির মধ্যে পাহাড়ের চূড়ার একটি অংশ রুপার মতো চিকচিক করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃশ্যটি আবার আড়াল হয়ে গেল। মনে হলো, পাহাড়চূড়াটি এক মুহূর্তের জন্য মেঘ সরিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে গেল। আমি ভেতরে দারুণ পুলক অনুভব করছিলাম। কারণ, এমন দৃশ্য এত কাছ থেকে আমার জীবনে এই প্রথম দেখা।
এখান থেকে আবার ট্রেন বদল করে আরও ৪৫ মিনিটের বিরতিহীন যাত্রায় আমরা চলে এলাম আমাদের গন্তব্য ছা জারভে লে বাঁ লো ফায়ে রেলস্টেশনে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাসা খুঁজে বের করতে গুগল ম্যাপের শরণাপন্ন হলাম। গুগল ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী স্টেশন থেকে আমাদের বাসার ঠিকানা পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। জনমানবের কোলাহলমুক্ত নীরব নিস্তব্ধ এলাকা। রাস্তা ছাড়া চারপাশে শুধুই সাদা বরফের স্তর। কেউ কেউ স্কি করার সরঞ্জাম হাতে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশের দোকানপাটগুলো বন্ধ। গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে বাসার দিকে যাওয়ার পথে দেখছিলাম কোনো রেস্তোরাঁ খোলা আছে কি না। কারণ, বাসায় পৌঁছে আমাদের প্রথম কাজ দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা। একটা পিৎজার দোকানের দেখা মিলল, কিন্তু প্রবেশের দরজা বন্ধ।
গুগল তার দায়িত্ব শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেও আমাদের বাসার নম্বর খুঁজে পেতে পড়তে হলো নতুন বিড়ম্বনায়। গুগল আমাদের যে বিল্ডিংয়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, তা আমাদের বাসা নম্বরের সঙ্গে মিলছে না। এত দূরের পথ পারি দিয়ে গন্তব্যের কাছে এসেও গন্তব্য খুঁজে না পেয়ে মনটা অস্থিরতায় ভরে উঠল। পাশের বিল্ডিং থেকে এক লোককে বাইরে আসতে দেখে আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম সাহায্য চাওয়ার জন্য। মনে হলো, স্থানীয় হলে তাঁর কাছে এই সমস্যার সমাধান মিলবে।
লোকটিকে সমস্যা খুলে বলার পর তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য। পাশাপাশি একই নকশার কয়েকটি দালানবাড়ি। প্রতিটি দালানবাড়ির হোল্ডিং নম্বর আমাদের বাসার হোল্ডিং নম্বরের কাছাকাছি, শুধু আমাদের বাসার নম্বরের দেখা মিলছে না। উপায় না পেয়ে বাসার মালিকের নম্বরে ফোন দিলাম, কিন্তু ভদ্রলোককে ফোনে পাওয়া গেল না। হঠাৎ আমাদের সামনে একটি কার এসে থামল। কার থেকে বেরিয়ে আসা এক নারীকে আমাদের বাসার নম্বর বলতেই তিনি নম্বর দেখিয়ে বললেন, ‘আপনারা আপনাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।’ লম্বা একটি দালানের দুই অংশের দুটি হোল্ডিং নম্বর। অন্য অংশের হোল্ডিং নম্বর আমাদের চোখে পড়লেও আমাদেরটি চোখে না পড়ার কারণ হলো, নম্বরটি বিল্ডিংয়ে প্রবেশপথের দেয়ালের সামনে না টাঙিয়ে দরজার পাশে এক কোনায় ছোট করে টাঙানো হয়েছে। নতুন যে কারও অতি সহজে নম্বরটি চোখে পড়বে না। সেই নারী বললেন, তিনিও আমাদের মতো শীতকালীন অবকাশযাপনের জন্য এখানে এসেছেন এবং আমাদের একই বিল্ডিংয়ে তাঁর ক্ষণিকের ভাড়া অ্যাপার্টমেন্ট। তিনি বললেন, নিজেও প্রথম দিন এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। ভদ্রমহিলাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে চলে এলাম আমরা। চলবে...