কানাডার চাকরি বৃত্তান্ত—পঞ্চম পর্ব

ওয়ালমার্ট নর্থ সিডনি
ছবি: লেখক

ইন্টারভিউ ভালো হলেও জানতাম, আমার চেয়ে আরও যোগ্য কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না। বাকি পদগুলোর জন্যও আবেদন করে গেলাম, আপাতত পরীক্ষা দেওয়া ম্যানেজার পদের জন্য কোনো আশা না করে। আরও একটা কারণ ছিল; ইন ক্যাম্পাস বা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতর চাকরির একটা পদের বিপরীতে আবেদনকারী হতো অনেক। কাজেই প্রতিযোগিতাও হতো হাড্ডাহাড্ডি! পরের সপ্তাহেই শনের সান্ত্বনাসূচক ঋণাত্মক ই–মেইল এল।

আর ওদিকে ওয়ালমার্টের চাকরি নিয়ে সমস্যা পিছু ছাড়ছিল না। আমার ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার গেলেন পালটে। নতুন ব্যক্তি হলেন কার্ট, আর তিনি আসার পর থেকেই কাজের মজুরি কমে যেতে লাগল। মজুরি মানে হলো এখানে ঘণ্টার হিসেবে পে করা হয়। যাঁর জন্য যত ঘণ্টা ম্যানেজার বরাদ্দ করবেন, তাঁর বেতনও তত বেশি। বুঝতে পারলাম না কার্টের মতিগতি!

আবার আমাদের পর আরও নতুন ছেলেমেয়েদের ওরা চাকরিতে নিল। এটা ওয়ালমার্টের অনেক পুরোনো রীতি, যা চূড়ান্তভাবে অগ্রহণযোগ্য। যাঁরা কাজে আছেন, তাঁদের পুরোপুরি টাকার বন্দোবস্ত না করে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া। তাঁদের কাজের ঘণ্টাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এক দিক থেকে সরকারকে দেখানো যে নতুন মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অপর দিকে পুরোনো যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের পেটে লাথি মেরেই এটা করা হতো! ফুলটাইম চাকরিজীবীরা এর আওতার বাইরে। তবে লাইনটা পড়তে যত খটমটে, মনে রাখবেন, বাস্তবতা তার চেয়ে তিক্ত। বর্তমানে প্রায় ৯০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের উপায় করে দেওয়া বিশাল এ প্রতিষ্ঠানের ৩৪৩টি স্টোর (কানাডায়) রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কানাডার নুনাভুট ছাড়া সব প্রদেশে। ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের নামের অনুকরণেই ওয়ালমার্টের নামকরণ করা হয়েছে। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শ ছিল, ‘যদি আপনি কোনো সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চান, তাহলে কর্মীরা যেন মনে করে, আপনি তাঁদের জন্য কাজ করছেন, তাঁরা আপনার হয়ে নয়!’

তবে কাজ করতে এখন যা দেখছি, মনে হয় না কেউ ওনার আদর্শ ছিটেফোঁটাও বিশ্বাস করেন! এখন এটাও বুঝতে পারছি না, যখন আমরা জয়েন করেছিলাম, তখনো কি এভাবেই অন্যদের ঠকিয়ে আমাদের টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না! যা-ই হোক, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে লাগল, শেষমেশ আমি নিজে কার্টের সঙ্গে দেখা করলাম। সবকিছু খুলে বলার পর তিনি আমাকে বর্তমানের পদ পরিবর্তন করে নতুন আরেকটা পদে আবেদন করতে বললেন। গ্রিটার পজিশন-ওয়ালমার্টের প্রবেশপথে যাঁরা দাঁড়িয়ে থেকে গ্রাহকদের স্বাগতম জানান আর বিদায় দেওয়ার সময় রসিদ চেয়ে জিনিসপত্র যাচাই-বাছাই করেন। তখন স্টোরের এক অভ্যর্থনাকারী ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল। কারণ, যিনি এই পদে ছিলেন, তিনি কথাবার্তা ছাড়াই ভেগেছেন। কথা শুনে যা বুঝলাম, কারণটা ওদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত আর যেহেতু বর্তমানে ওই পদে কেউ নেই, তাই তাঁর জন্য বরাদ্দ মজুরিও বাকিদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে আমার অনুরোধ কার্টকে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ করে দিল। খালি পদের জন্য লোকও পাওয়া যাবে আর আমি তাঁর কাছে মজুরি বাড়ানো বা ঘণ্টার বেশি পাওয়ার অনুরোধ করেছিলাম, সেটার সমাধানও হয়ে যাবে! কিন্তু আমার গ্রিটার পজিশনে আবেদন বা কাজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা আগ্রহ ছিল না। তখন মাঝেমধ্যেই আমাকে ওই পজিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

গ্রিটার দরজায়, নর্থ সিডনি ওয়ালমার্ট
ছবি: লেখক

আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বলতে গেলে! ওই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক ধরনের চিন্তার আড়ালে হারিয়ে যেতাম। ভাবতাম, কীভাবে একজন মানুষ আট ঘণ্টা এভাবে দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে পারে? তবে হরেক রকম মানুষকে দেখা, তাঁদের হাবভাব সম্পর্কে বিভিন্ন কল্পনার জগতে বিচরণ করা—এসবের ভেতর দিয়ে কিছু মানুষের মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল। জানতাম এ চুরির উদ্দেশ্যে এসেছে বা কেউ আসলেই অনেক ভালো, নিজে থেকে কথা বলতেন, আমার সম্পর্কে জানতে চাইতেন। চোর সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ ম্যানেজারকে খবর দিতে হতো। সে ক্ষেত্রে আমি অন্য অ্যাসোসিয়েটদের জানিয়ে দিতাম। ওরা ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে কল করে দিত। সমস্যাটা আসলে মূর্তির মতো ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে কাজ না করায়। প্রকৃতিগতভাবে আমি নিশ্চল স্বভাবের নই মোটেও, সব সময় কাজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করি। কিছু না কিছুতে ব্যস্ত থাকাতেই আনন্দ খুঁজে ফিরি। সেই আমাকেই কিনা দেওয়া হলো রীতিমতো বিপরীতে মেরুর কাজ। না, সম্ভব নয়। চেষ্টা করতে লাগলাম, কীভাবে কার্টের পাতা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা যায়! প্রথমে তো তাঁকে হ্যাঁ-ও বলে ফেলি, পরে আবার জানাই, সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। তখন কার্ট বেশ অসন্তুষ্ট হন আর প্রতিউত্তরে জানান, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না কী করবেন। আপাতত ওয়ালমার্টে সবকিছু মিলিয়ে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। তবে ইউনিভার্সিটির চাকরির সুবাদে খরচের ঝামেলা থেকে পার পেয়ে যেতে লাগলাম। ক্লাস, পরীক্ষা, পড়াশোনা, দুটো চাকরি, সঙ্গে রান্নাবান্না, বাজার করা আর বাসার নিত্যনৈমত্তিক অশান্তি, বাবার অসুস্থতা— এভাবেই কেটে যেতে লাগল।

হয়তো ঈশ্বরের কৃপা হয়েছিল। এ সময় আর্শীবাদ হয়ে পাশে দাঁড়ালেন ওয়ালমার্টের স্টোর ম্যানেজার জেনিফার। মানে মূল হর্তাকর্তা। তবে অনেকটা আড়াল থেকেই। আমার ডিপার্টমেন্ট পালটে পোশাক-পরিচ্ছদে (অ্যাপ্যারেল) দেওয়া হলো। এটা বরাবরই আমার প্রিয় কাজের জায়গা ছিল। বাসায়ও আমি জামাকাপড় গোছানোর কাজ করতাম। মূলত মায়ের কাছেই এটা শেখা। প্রতিদিনের নিয়মিত কাজের কারণে ওই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার স্যান্ড্রার সুনজরে পড়লাম। এভাবে টানা মাস তিনেক চলল।

জেনিফার আমার সুপারভাইজার ট্রেসিকে জানিয়েছিলেন ব্যাপারটা। ফলস্বরূপ সেবারের সেরা কর্মকর্তার পদক দেওয়া হয়েছিল। সকালে মিটিংয়ে সবাই একসঙ্গে দাঁড়াবেন, ম্যানেজার সবাইকে বিভিন্ন লাভ-লোকসানের হিসাবের পাশাপাশি মাসের সেরা ব্যক্তির হাতে তুলে দেবেন পদক। যখন আমাকে দেওয়া হলো, সবাই করতালি দিয়ে উষ্ণ অভিবাদনে সিক্ত করলেন আমাকে!! বলতেই হয়, তখন পর্যন্ত ওয়ালমার্টের সবচেয়ে মিষ্টি অভিজ্ঞতা ছিল ওটা।

লাইব্রেরি
ছবি: লেখক

একপ্রকার সম্পূর্ণ ভগ্নদশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম করুণাময়ের অপার কৃপায়। তবে চাকরির জন্য ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন বিভাগে আবেদন থামিয়ে রাখিনি কখনো, ওটা ভেতরে ভেতরে করে যেতে থাকলাম। এ ক্ষেত্রে ড্যানিয়েলের কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন, যা এতক্ষণ বলিনি। প্রথমে যখন চাকরি খোঁজা শুরু করি, তখন আমার স্টাডি পারমিটে সমস্যা ছিল, তাই ওটা সংশোধনের জন্য পাঠাই। আমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরের কোনো চাকরিতে (অফ ক্যাম্পাস) আবেদন করায় বাধা ছিল। এতে ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অফিসের উপদেষ্টা ড্যানিয়েলের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সেই ঘটনার সূত্র ধরে প্রথম দিন থেকেই পরিচিত হওয়া ড্যানিয়েলের সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। ইউক্রেনের এই স্বল্পবক্তা, চমৎকার স্বভাবের যুবক আমাকে সব সময়ই বিভিন্ন পদে আবেদনের জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। তাঁর সঙ্গে ইমিগ্রেশনের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে কথা হতো।

নর্থ সিডনির পথে
ছবি: লেখক

এরপর লাইব্রেরির সহকারীর পদের জন্য ইন্টারভিউয়ের ই–মেইল পেলাম। কোনো পদের জন্য সাড়া পেলে কাউকে না জানালেও শুধু ড্যানিয়েলকে অবশ্যই জানাতাম। অবশ্য সব সময় এমনও হতো না যে সব পদের খবর তিনি জানাচ্ছেন আমাকে, কিন্তু মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটাও অনেক। এ তল্লাটে বিনা প্রয়োজনে কেউ কারও খবরই রাখে না। আর মনে করিয়ে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না! তবে লাইব্রেরির পদের বিবরণীতে এমন কিছু পূর্বশর্ত দেওয়া ছিল, যেগুলো এই অধমের আয়ত্তের বাইরে। সে ক্ষেত্রে যাঁরা এসব জানেন বা ধারণা রাখেন বা আগে কাজ করেছেন, তাঁরা ইন্টারভিউ দেওয়ার আগেই আমার চেয়ে এগিয়ে গেলেন অলিখিতভাবে। হুবহু একই ব্যাপারে ধারণা না থাকলেও ঠিক করে রেখেছিলাম, ওই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে উত্তরে কী বলব, যা ওদের মনঃপূত হবে। হয়তো পুরোপুরি হবে না, তবে সে চেষ্টা করতে হবে। কিছু নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের কথা বলা হয়েছিল, যেগুলোর নামও কখনো শুনিনি। কাজেই সাক্ষাৎকারের আগেই মানসিকভাবে পিছিয়ে ছিলাম, এমনটা বলা যায়।

তারপরও কোনো সমস্যা হতো না, যদি কৃষ্ণকন্যার ফাঁদে না পড়তাম! নির্ধারিত সময়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত হয়ে মুখোমুখি হলাম তিন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর। এতগুলো ইন্টারভিউ দিলেও তিনজনের মুখোমুখি আজ পর্যন্ত হইনি। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন কিছুটা ব্যতিক্রমী এক আফ্রিকান মেয়ে, যাঁর আপাতত নাম দিলাম কৃষ্ণকলি!
ক্রমশ...

আরও পড়ুন