দুই কাপ চা
‘এই অসময়ে ফরিদ ভাই না এলে কি হতো না?’
মা মুখের ভেতর গজগজ করে কথাটা বলেন।
ফরিদ চাচা বাবার বন্ধু। আর মায়ের রাগ করার কারণ হলো, ঘরে একটু চিনি নেই।
যা ছিল, একেবারে উপুড় করে সকালের চা বানানো হয়েছে।
দোকানদার চাচাকে মা ফোন করে দুই কেজি চিনি পাঠানোর কথা বলে রেখেছেন। উনি দুপুরে বাসায় খেতে এলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন বলেছেন।
আর এদিকে ১১টায় ফরিদ চাচা উপস্থিত!
চিনি ২ কেজির চেয়ে কম, ৫০০ বা ২৫০ গ্রাম আশপাশের দোকান থেকেও আনা যাবে না, কিন্তু বাবার বারণ। নিয়মমতো চলতে হবে আর হিসাব রাখার জন্য মাসের বাজার একসঙ্গে এবং তা নির্দিষ্ট দোকান থেকেই কিনতে হবে।
যেকোনো জায়গা থেকে বারবার কেনা চলবে না।
যদিও চিনি ও বিস্কুট এসবের ক্ষেত্রে কোনো দিনও নিয়মমাফিক কেনাকাটা চলে না। তা বাবা যেন বুঝেও বোঝেন না। তাঁর বন্ধু ও ছাত্র, তাঁদের কারণেই যে তাড়াতাড়ি শেষ হয়, তা ওনাকে কে বোঝাতে যাবে!
আর বাবা কয়েক বছর ধরে দুই কেজির ওপরে চিনি আনেনই না। অথচ আরও আধা কেজি বেশিই লাগে, প্রতিবার মাস শেষ হওয়ার কমপক্ষে পাঁচ দিন আগে চিনি শেষ হবেই।
গরমের সময় তো আরও বেশি আগে শেষ হয়। গরমে অস্থির আমি নিজেও লেবু চিপে শরবত বানিয়ে খাই কতবার!
এখন বাবা চা চাইবেন। দেরি হলে দুই–তিনবার চিল্লিয়ে জানতে চাইবেন,
দুই কাপ চা বানাতে কতক্ষণ লাগে, হ্যাঁ? পোলাও–কোরমা রাঁধতে তো বলিনি, সামান্য চা দিতে ২০ মিনিট!
আমাদের ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার একটা মাত্র দরজা। কারও ঘর থেকে যে ধার করে আনব, তারও উপায় নেই। বাবা–চাচা দরজার পথ আটকে বাইরের বারান্দায় বসেছেন।
‘দূর পরবাস’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
চিনি আনতে দেখলে ওনার সামনেই ধমক দিয়ে বলে ফেলবেন, ‘চিনি নেই! দুই কাপ চায়ের চিনি ধার করে আনতে হবে কেন? তোর মায়ের মাথা কি ঠিক আছে? পায়খানা এলে বদনা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি কেন করে?’
শুনতে কী বিশ্রী শোনায়!
তাই মায়ের খুব রাগ লাগছে, ওনাকে এখন আড্ডা দিতে আসতে দেখে।
মা কাল বিকেলে নাকি দোকানদার চাচাকে চিনির কথা বলেছিলেন। দোকান বন্ধ করে আসার সময় আনতে, তিনিই ভুলে গিয়েছিলেন।
এত কথা বাবাকে কে বোঝাতে যাবে!
অস্থির মা কয়েকবার ভাইয়াকে ফোন করে দেখেছে, রিং পড়তেই আছে নাকি, ভাইয়া ফোন রিসিভ করছে না।
ভাইয়ার পকেট কখনো খালি থাকে না, ৫০–১০০ টাকা থাকেই।
টিউশনি করে একটা, মোবাইল বিল খরচের জন্য। সেখানে যদিও এক হাজার দেবে বলেছে, কিন্তু মাস শেষে কখনো ৫০০ টাকা, আবার কখনো ৮০০ টাকা ধরিয়ে দেয়।
ভাইয়া লজ্জায় বাকিটা চাইতেও পারে না।
কিন্তু মায়ের রাগ বাড়তেই আছে, ভাইয়া ফোন ধরছে না।
লাটসাহেব আসুক, করে তো একটা টিউশনি। ভাব দেখে মনে হয়, ব্যবসার কাজে ফোন ধরার ফুরসত পাচ্ছে না। ফোন নিয়েছে কি পকেটে পুরে রাখার জন্য!
বাবার ডাক শোনা যাচ্ছে, মা কিছু শোনার আগেই কেটলিতে পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিতে যাবেন, আজ চিনি ছাড়াই চা দেবেন। বকা খেলে বকা।
‘দেখেন, গ্যাস নেই!’
উনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন! দুপুরের রান্না যে শেষ হয়নি এখনো, তাতে তার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। দুই কাপ চায়ের টেনশনে তিনি এতটাই অস্থির ছিলেন।
কিন্তু বাবা ডেকে বললেন, অন্য কথা।
‘শিমুল, তোর ফরিদ চাচাকে তোর দাদির ডায়াবেটিস মাপার মেশিনটা দেখা তো। বেচারা টেনশনে নাওয়া–খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। পারলে ওকে চিনি ছাড়া এক কাপ চা দিতে বল, আমাকেও চিনি ছাড়া দিস। দেখি, খেতে কেমন!’
‘বাবা, গ্যাস নেই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, মেশিন নিয়ে আয়।’
*লেখক: ফারহানা বহ্নি শিখা, যুক্তরাজ্য