বিয়ের পাত্রী-৩য় পর্ব
মদ খাওয়াবিষয়ক বিব্রতকর প্রসঙ্গ পাল্টাতে পাত্রীকে বললাম,
-আপনার নাম তো শিউলি, তা-ই না?
-না। আমার নাম শিউলি শিউলি।
-আমি তো তা-ই বললাম।
-আপনি বলেছেন শিউলি। কিন্তু আমার নাম শিউলি শিউলি।
-দুইবার শিউলি? খুবই আনকমন নাম।
-জি, আমি মেয়েটাই আনকমন।
বলেই শিউলি শিউলি খিলখিল করে হেসে উঠল।
কী মায়াবী হাসি। আচ্ছা, মেয়েরা এত সুন্দর করে হাসে কীভাবে?
এর মধ্যে খাবার চলে এল। আমরা খেতে শুরু করলাম। হঠাৎ করে শিউলি শিউলি আমাকে বলল,
-শুনুন, আমি কিন্তু রান্না করতে পারি না।
এ কথা শুনে মামা বললেন,
-কোনো চিন্তা নাই। বিয়ের পর তোমার রান্না করতে হবে না। রাজুই তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে।
-বলেন কী! উনি রান্না পারেন?
-পারে মানে? আরে, ওর রান্নার হাত তো ফাটাফাটি। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, ও সম্ভবত দুনিয়ায় আসছে মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য।
মামার কথা শুনে শিউলি শিউলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-বলেন কী! তা উনি কী ধরনের রান্না করেন? দেশি নাকি বিদেশি?
-এটা একটু কঠিন প্রশ্ন। উত্তর দেওয়াটা কঠিন।
-কেন?
-আসলে ওর রান্নাকে দেশি বা বিদেশি ক্যাটাগরির মধ্যে ফেলা মুশকিল। ও হচ্ছে ক্রিয়েটিভ মানুষ। নিজেই নিজেই বিভিন্ন রেসিপি তৈরি করে রান্না করে। যা মানুষের কল্পনারও বাইরে।
-আচ্ছা, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে শুনে কি আপনি আমাকে লুজ বলছেন? আপনারও তো বয়ফ্রেন্ড আছে।
আসলে আমি আর মামা মাঝে মাঝে বাসায় মজা করে উল্টাপাল্টা রান্না করি। তবে সেটা বলার মতো তেমন কিছু না। তাই মামা আমার রান্নার প্রশংসা করে কথা বলছেন দেখে খুবই টেনশন লাগছে। বুঝতে পারছি না, উনি কি এবারও পচাবেন, নাকি প্রশংসা করবেন।
শিউলি শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-তা আপনার বেস্ট রেসিপি কোনটা?
প্রশ্ন আমাকে করলেও মামাই উত্তর দিলেন।
-ওর বেস্ট রেসিপি হচ্ছে পাকা বিচি কলা দিয়ে গরুর মাংসের ঝোলের তরকারি।
-কী! এটা আবার কেমন তরকারি!
-অবাক হচ্ছো, তা-ই না? এতে অবশ্য তোমার কোনো দোষ নাই। প্রথম প্রথম এই তরকারির কথা শুনলে সবাই অবাক হয়। তবে এর টেস্টটা কিন্তু জোশ। রাজু অবশ্য আমাকে রান্নাটা শিখিয়েছে। এই রান্নার একটা বিশেষ কৌশল আছে। রান্নার ঠিক শেষ পর্যায়ে গিয়ে পাকা বিচি কলা হাতের সাহায্যে চটকিয়ে মাংসের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে এবং একটু পরই তরকারিটা নামিয়ে ফেলতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে বিচিগুলো সেদ্ধ না হয়ে যায়। এর ফলে যখন তুমি ভাতের সাথে মাংসসহ বিচি কলার বিচি খাবে, তখন মুখের মধ্যে কটকট করে একটা আওয়াজ হবে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। তবে মজার কথা হচ্ছে কি জানো? আমি রাজুর কাছ থেকে এ রান্না শিখে নিজের মেধা দিয়ে এটাকে আরেকটু আপগ্রেড করেছি।
শিউলি শিউলির বান্ধবী আগ্রহ নিয়ে মামাকে প্রশ্ন করল,
-মামা সেটা কী রকম?
-বলছি শোনো। আমি এই রান্নার ঠিক শেষ মুহূর্তে এর মধ্যে দুই বাটি চিটা গুড় ঢেলে দিই। এতে তরকারির রং, স্বাদ আর পুষ্টিগুণ বেড়ে যায়।
-চিটা গুড় কী, মামা?
-এটা একধরনের তরল দানাদার গুড়। সাধারণত গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খড়ের সাথে মিশিয়ে গরুকে এই গুড় খাওয়ানো হয়। এই গুড় গরুর খুবই প্রিয়। শোনো, আমি একদিন নিজে তোমাদের দুজনকে চিটা গুড় আর পাকা বিচি কলা দিয়ে গরুর মাংস রান্না করে খাওয়াব।
এ কথা শুনেই শিউলি শিউলি দ্রুত দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। অবস্থা দেখে মনে হলো, সে বমি আটকানোর চেষ্টা করছে। এরপর বলল,
-আচ্ছা মামা, আপনারা দুইজন কি সারা দিনই এসব ফালতু কাজ-কারবার নিয়ে থাকেন? আর আপনারা এসব ফালতু কাজ করার সময় কোথায় পান?
-সময় কোথায় পাই মানে? আরে, আমরা দুজন তো বেকার মানুষ। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়।
শিউলি শিউলি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনি বেকার! কিন্তু বায়োডাটাতে তো লেখা ছিল আপনি ব্যবসায়ী।
আমি উত্তর দিতে মুখ খুলতে যাব, ঠিক সে সময় মামাই বলা শুরু করলেন,
-কথা সত্য। রাজু আসলে ওর বাবার ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ওর বাবা ওকে তিন সপ্তাহ আগে পাছায় লাথি দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিয়েছে।
-মানে কী!
-তাহলে শোনো, তোমাকে কাহিনিটা খুলে বলি। রাজুর মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর শুয়েবসেই আনন্দে দিন কাটছিল। এ সময় হঠাৎ একদিন রাজুর বাবা আমাকে আর রাজুকে ডেকে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। আমি আর রাজু বাধ্য হয়ে অফিস যাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দুজনের অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস। কিন্তু সকালে উঠে অফিস যাওয়ার কারণে সেটা আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমি আর রাজু বাধ্য হয়ে অফিসে গিয়ে অফিসের স্টোররুমে মাদুর বিছিয়ে ঘুমানো শুরু করলাম। এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের ঘুমের অবস্থা দেখে অফিসের বাকিরাও কাজে ফাঁকি দেওয়া শুরু করল। ওরা সবাই নিজ নিজ বাসা থেকে পাটি নিয়ে এল। তারপর ওই পাটি ফ্লোরে বিছিয়ে ঘুমানো শুরু করল। ছেলেরা এক রুমে ঘুমাত আর মেয়েরা আরেক রুমে ঘুমাত। অফিসে ক্লায়েন্ট এসে দেখত, পুরো অফিসের সবাই মনের আনন্দে ঘুমাচ্ছে। কী এক সুখী পরিবেশ। যেকোনোভাবেই হোক, কথাটা রাজুর বাবার কানে চলে গেল। উনি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে একদিন অফিস ভিজিটে এলেন। এসে দেখলেন, অফিসের সবাই ফ্লোরের ওপর পাটিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। না, ঠিক সবাই না। একজন জেগে ছিল। তার কারণ, তার ওই দিন ডায়রিয়া হয়েছিল। সে টয়লেটে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিল। তাই ঘুমাতে পারছিল না। পুরো অফিসের এই অবস্থা দেখে তখনই দুলাভাই আমাদের দুজনকে একপ্রকার গলাধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিলেন।
-আপনারা দুজন কি এ কারণে লজ্জিত?
মামাই উত্তর দিলেন,
-প্রশ্নই আসে না। আমরা বরং খুশি। এখন আমরা আবারও আগের মতো বেলা করে নিজেদের বিছানায় আরাম করে ঘুমাতে পারি। শোনো, পুরুষ মানুষের লজ্জা থাকা ঠিক না। তাহলে সে পুরুষ জীবনে উন্নতি করতে পারবে না।
-তা-ই! তা আপনারা দুজন লজ্জা বর্জন করে কী উন্নতি করেছেন?
-বলো কী! অনেক উন্নতি করেছি। তুমি তো জানো না, আমরা ঘুমকে এমন একটা লেভেলে নিয়ে গেছি যে চাইলে দুই মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময়, যেকোনোখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। এমনকি এখন এখানেও তোমার সামনে ঘুমিয়ে পড়তে পারব। দেখবা?
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে মামা বললেন,
-নে রাজু, শুরু কর। ওকে আমাদের ট্যালেন্টটা দেখিয়ে দিই।
এ কথা বলেই মামা টেবিলের ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মামা সত্যি সত্যি নাক ডাকা শুরু করলেন।
শিউলি শিউলি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আচ্ছা, আপনাদের পরিবারের সবারই কি মাথায় একটু সমস্যা আছে?
আমি কী বলব, কিছু খুঁজে পেলাম না। শিউলি শিউলি বলল,
-তা আপনি বসে আছেন কেন? এক কাজ করেন, আপনিও আপনার মামার সাথে ঘুমান। আমরা বরং উঠি।
শিউলি ও তার বান্ধবী যাওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমিও সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর শিউলিকে বললাম,
-এখনই চলে যাবেন? তা যাওয়ার আগে কি আপনার সিদ্ধান্তটা বলে যাবেন?
-কিসের সিদ্ধান্ত?
-না মানে, আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত কী, জানতে চাচ্ছিলাম।
-আপনাকে কে বিয়ে করবে? শোনেন, আমি আপনার মতো কোনো লুজ মানুষকে বিয়ে করব না।
-লুজ মানে কী?
-লুজ মানে লুচ্চা।
-আচ্ছা, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে শুনে কি আপনি আমাকে লুজ বলছেন? আপনারও তো বয়ফ্রেন্ড আছে।
-না, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নাই। আমি আপনার পেট থেকে কথা বের করার জন্য মিথ্যে বলেছি। শুনুন, মানুষের জীবনে প্রেম-ভালোবাসা আসতেই পারে। আবার তা ভেঙেও যেতে পারে। এটা কোনো সমস্যা না। আপনার জীবনে এর আগে সাতটি গার্লফ্রেন্ড ছিল, সেটাও কোনো সমস্যা না। কিন্তু তাই বলে আপনি একসাথে তিনজনের সাথে প্রেম করবেন? এটা তো পুরোই ক্রাইম। আমি বুঝি না, মানুষের ক্যারেক্টার এত খারাপ হয় কী করে?
-না মানে, আসলে হয়েছে কী...
-প্লিজ, এখন আর মিথ্যে বলে নিজেকে সাধু বানানোর চেষ্টা করবেন না। নিশ্চয় আপনি এখন বলবেন যে আপনার মামা ফান করে আপনার সম্পর্কে সব মিথ্যে কথা বলেছেন। আপনি চাইলে বলতে পারেন, তবে আমি তা বিশ্বাস করব না। ও আরেকটা কথা, আমি মদ্যপান, ধূমপান কোনো কিছুই করি না।
-তাহলে মিথ্যে বলেছেন কেন?
-কারণ, আমি দেখতে চেয়েছিলাম মদ্যপান, ধূমপান বিষয়ে আপনার কি মতামত। কিন্তু কী দেখলাম? দেখলাম, আপনারা পুরো পরিবারই মদ্যপ পরিবার। ছি ছি ছি...
আমি শিউলি শিউলিকে আর কিছুই বললাম না। হতাশ চোখে ঘুমন্ত মামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী নিষ্পাপভাবে মানুষটি ঘুমাচ্ছে। দেখলেই যে কারও মায়া লাগবে। মামা যে বানিয়ে বানিয়ে সব মিথ্যে বলেছেন, তা আর শিউলি শিউলিকে বলতে ইচ্ছা হলো না। থাক না। না হয় বিয়ের জন্য আরেকবার রিজেক্ট হলাম। জীবনে বিয়ের জন্য একটা না একটা পাত্রী তো পাবই। কিন্তু মামা তো আর পাব না।
একটু পর শিউলি শিউলি তার বান্ধবীকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলাম, মামা এখন গভীর ঘুমে। আওয়াজ করে নাক ডাকছেন। ভাবলাম, আমি আর বসে থেকে কী করব? আমিও টেবিলের ওপর মাথা রাখলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রায় ৪০ সেকেন্ডের মাথায় আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। (শেষ)
*ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]