অর্থনীতিবিদ মোহম্মদ আনিসুর রহমানের লেখা ‘Social and Environmental Thinking of Rabindranath Tagore in the light of Post-Tagorian World Developmnet’ বইটি হাতে নিয়ে পড়তে যেই শুরু করেছি, লেখকের ওপর ভারী অভিমান হলো। কেন বইটি লেখক আরও আগে লিখলেন না? কত ভালো হতো, কত উপকার হতো। আরও অনেকেই যাঁরা একসময়ে সমাজ ও অর্থনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণে ব্যাপৃত ছিলেন, সে সময়ে এমন বই হাতে পেলে বর্তে যেত। আফসোস হলো খুব। উন্নয়নের কত প্যারাডাইম ট্রিকল ডাউন থিওরি, বেসিক নিডস এপ্রোচ, স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট ঘেঁটে কত মাথা ঘামানো হয়েছে যেগুলোতে আর্থ-সামাজিক উন্নতিই মূলত বিবেচ্য ছিল, পরিবেশ বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। আর এই বই উন্নয়নের জন্য কবির চিন্তাভাবনায় সমাজ ও পরিবেশ সমান গুরুত্বে জায়গা করে নিয়েছে।
সমাজ ও পরিবেশ বিষয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতেই এ ধরনের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হই। গান, কবিতা, গল্প–উপন্যাস দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের আবিষ্ট করেছেন, মোহগ্রস্থ করে রেখেছেন। তাঁর সমাজ, দেশ, ধর্মবিষয়ক চিন্তাভাবনা নিয়েও কিছুটা জানি। তবে এই বই সমাজ, পরিবেশ নিয়ে কবির ভাবনার আকর, অসাধারণভাবে লেখক ব্যাখ্যা করে করে তা বলে গেছেন। বই উল্টেপাল্টে দেখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ (১৫০তম) উপলক্ষে বাংলা একাডেমি থেকে ২০১২ সালে এটি প্রকাশিত। আমার ছাত্রজীবন শেষ হলেও জানার ও শেখার আকাঙ্ক্ষা আজও শেষ হচ্ছে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রামীণ মানুষের জীবন নিয়ে, কৃষি নিয়ে অনেক কিছু করতে চেয়েছেন। প্রায় সবার জানা আছে সেই কবে কোন কালে নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথকে কবি কৃষিবিদ্যা পড়াতে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন, এখানেই থেমে ছিলেন না কবি, মাটির কাছাকাছি যে মানুষজন, তাঁদের জন্য কৃষিব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এগুলো কবির বিশাল কর্মকাণ্ডের সামান্য অংশ মাত্র। এতসব কর্মযজ্ঞ ব্যক্তিমানুষের বিত্তবেসাত ও খ্যাতির সীমাকে প্রসারণের জন্য কি? প্রশ্নটি গভীর চিন্তা উদ্রেককারী।
এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ আনিসুর রহমানের এই বইতে লিখিত ‘The study highlights the Tagore’s philosophy of service to others humanity- as opposed to individualist aggrandizement as the mission of human life, predicting that uncontrolled individualism leads to destruction.’ বইতে লেখক কবিগুরুর কথা, যে অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ধ্বংস ডেকে আনে, সে সম্পর্কে বলছেন যে আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস যে দ্বন্দ্ব তা সমষ্টি ও ব্যষ্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের ফলে বর্তমান সময়ে ব্যষ্টির স্বার্থ জয়ী। ব্যষ্টি বা পৃথকের জয়। যার প্রেক্ষিতে বা যে পরিণতিতে মানবসমাজ ও পরিবেশ আজ ক্ষতির মুখে, বড় বিপন্ন বিদ্ধস্ত প্রায়। রবীন্দ্রনাথের সমষ্টিগত চিন্তা ও কার্ল মার্ক্সের সমষ্টিগত চিন্তার বৈপরীত্য লেখক তুলে ধরেছেন বইতে।
মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সমগ্রতা। রাজনৈতিক সমাবেশ, রুদ্ধদ্বার বৈঠক করার বদলে গ্রামীণ সমাজে ধনী-নির্ধন শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষকে ঐতিহ্যবাহী মেলা ও লোকসংস্কৃতির উৎসব অনুষ্ঠানে একত্রিত করাকে কবি বেশি গুরুত্ববহ বলছেন। ব্যষ্টি বনাম সমষ্টি বিষয়ে কবির দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে লেখক বলছেন সমষ্টিগতভাবে এক হয়ে কাজ করা, তবে তা হবে সবার জন্য, সমষ্টির সেবা হবে এ সম্মিলিত কাজের লক্ষ্য, ব্যষ্টির বা ব্যক্তির সেবা নয়।
এই বইয়ে লেখক আনিসুর রহমান রবীন্দ্রনাথের কর্মকীর্তি ঘেঁটে ঘেঁটে তা হোক কবিতা, কি উপন্যাস, কি প্রবন্ধ তাঁর সমাজ ও পরিবেশবিষয়ক ভাবনা বিবৃত করেছেন। আকর্ষণীয় দিক হলো, লেখক নিজস্ব পর্যবেক্ষণকে মাঝেমধ্যে সে নিরিখে মিলিয়ে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বরাজ শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ নয়, মৃত্তিকাসংলগ্ন মানুষের সম্মিলিত সংহতি ও গঠনমূলক পদক্ষেপে স্বরাজ নিহিত।
আমরা যদি শিক্ষাকে উন্নতি বা উত্তোরণের সোপান মনে করি, তবে কবির চিন্তায় সে সোপান বা সিঁড়িতে উঠার অধিকার সবার থাকতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা হতে হবে সর্বজনীন। শিক্ষার আলোতে মানুষ তার বঞ্চনার কালোকে দেখবে, পরস্পরের কাছে আসবে, পরস্পরের কথা জানবে। তখন সে জানবে এ বঞ্চনার শিকার সে একা নয়। মতবিনিময়ের মাধ্যমে তাদের সংহতি গড়ে উঠবে। শিক্ষাই সে সুযোগ দিতে পারে। শিক্ষা ব্যক্তির একার উত্তোরণের বা উন্নতির জন্য নয়, তা হতে হবে সম্মিলিত মানুষের উন্নতির জন্য।
দারিদ্র্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনন্য সাধারণ। কবির মতে, মানুষের মধ্যে সৃষ্টি বা সৃজনের যে সম্ভাবনা, তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সে সুযোগের মধ্যে মানুষ নিজেকে বিকশিত করতে পারলে বস্তুগত প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতাও তার সুখ কেড়ে নিতে পারবে না। তবে জীবনধারণের জন্য বস্তুগত উন্নতির ফসলে তার অধিকার থাকবে বা দিতে হবে। কবির মতে মানব মনের গভীর আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। তাকে সৃষ্টি করার সে সুযোগটা করে দিতে হবে। বইয়ের এখানে এসে আমার মনে পড়ল বাংলা ভাষার আরেক রত্ন বলছেন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে চোখ হাসে মোর, মুখ হাসে, টগবগিয়ে খুন হাসে’। বাংলাভাষী প্রায় সবার ভালো করেই জানা যে বিত্ত বৈভবে কবি নজরুল ইসলাম জীবন পূর্ণ ছিল না। তারপরও সৃজনের উল্লাসে ছিল পূর্ণ তাঁর প্রাণ। সৃজনের সুযোগ না পাওয়াই মানুষের সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য। সে দারিদ্র্যে তার চোখ-মুখ হাসে না, খুন হাসে না অর্থাৎ রক্তে তার তরঙ্গ জাগে না।
পৃথিবী বা ধরিত্রী ও প্রকৃতিকে যত্নে বাঁচাতে নারীর অনন্য সাধারণ ভূমিকার সম্ভাবনা দেখছেন কবি। নারী প্রকৃতির অংশ। নারী হৃদয়ে প্রাকৃতিকভাবে যে মমত্বের ঝরনা ঝরে, তা দিয়ে সে মানব প্রজন্ম ও পরিবেশকে সিক্ত করে যাচ্ছে আদিকাল থেকে। কোনো শিক্ষা, কোনো প্রশিক্ষণ দিয়ে হৃদয়ে মমতা উৎপাদন করানো যায় না বা হয় না। ‘The treasure of heart that nature has given her not been permitted to experiment with ever-curious intellect. Women are ancient. নারী তার পারিপার্শ্বিকতাকে আদিকাল থেকে আপন মমতা দিয়ে সজীব, সতেজ রাখে, মানবজীবনের বহমানতা বজায় রাখে নারী।
পরিবেশ, প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অংশজুড়ে আছে। বইতে লেখক বলছেন কবি তাঁর জমিদারি অঞ্চলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের যা বর্তমানের বাংলাদেশের পাবনা, শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনে ছাত্রদের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন করে গেছেন। তার সৃষ্টির ভান্ডার গল্প, কবিতা, গানে এমনকি পত্রালাপেও প্রকৃতির প্রতি তাঁর আবেগময় ভালোবাসা ও মনটিকে দেখা যায়। কবি বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের অস্তিত্বের অংশ। আমার মনে হচ্ছে কবি প্রকৃতিকে দেখছেন মানুষের আনন্দের এক অপার উৎস হিসেবে। তাই কবি বলছেন, ‘অলক্ষ্যে রং লাগলো তোমার অশোকে কিংশুকে আমার অকারণের সুখে।’
রদীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন এই বইতে তার কর্ম ও সৃষ্টির ব্যাখ্যায়, আছেন তাঁর সৃষ্টকর্মের অনুবাদে; আরও আছেন পৃথিবীর নানা জায়গায় মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত নানা উদ্যোগের তথ্যে, যা রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন চিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। মানুষের কল্যাণে সংবদ্ধ মানুষের কর্মযজ্ঞের নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এই বই। রবীন্দ্রনাথের ব্যষ্টি বনাম সমষ্টির আলোকে দেখা আফ্রিকার ‘ইউয়াকানা’ দর্শন থেকে ভারতের কেরালা রাজ্যের ‘Science for Social Revolution Movement’ তথ্য আমাদের জানাচ্ছে এই বই।
শুরুতে নির্ঘণ্ট, মুখবন্ধ বাদে বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৬ আর শেষে আছে রেফারেন্স ও ইনডেক্সসহ আরও ১১–১২ পৃষ্ঠা। আকর্ষণীয় একটি তথ্য পাঠককে জানাতে চাই। বইটি পড়তে পড়তে একটি বিষয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলা দরকার মনে হলো। পৃথিবীর কোন দেশের কোন শহরে আছেন কে জানে? ভাগ্য সদয় ছিল, উনার এক প্রাক্তন ছাত্রের কাছ থেকে তাঁর হদিস পেলাম, ফোন নম্বরও জোগার হলো। আছেন তিনি বাংলাদেশেই। এখন তাঁর বয়স আশির ওপর, জীবনসঙ্গিনী বিগত বেশ কয়েক বছর, তবু প্রাণের কাছে আছে তাঁর বাংলাদেশ।
লেখকের কথা ভাবতে ভাবতে মনে হলো, তাঁর ক্ষেত্রে কবি কিটসের কবিতাটি যথাযথ ‘Happiness is Bangladesh’(কীটস অবশ্য লিখেছেন Happiness is England)। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। যখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম ‘স্যার আপনার ছাত্রতো বলেছেনই আর আমরাও জানি, আপনি অর্থনীতির শিক্ষক, লেখক, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, হার্ভাড শিক্ষিত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত, স্বাধীন বাংলাদেশের...’ থামিয়ে দিয়ে বললেন ‘এ সবই আমি ছিলাম, এখন কিছুই নই।’
*দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]-এ