স্মরণ: অর্থনীতিবিদ ও রবীন্দ্র–গবেষক আনিসুর রহমান স্যার
এত তাড়াতাড়ি এই লেখা লিখতে বসার কথা না, কিছুতেই না; আর আজকে তো নয়–ই। গতকাল রাতে কাজ থেকে ফিরেছি ১২টার দিকে। কি অজানা কারণে ঘুম আসছিল না, তাই আজকে অবশ্যই অনেক দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কথা। জীবনে আর কোথাও কোনো তাড়া নেই, কেউ অপেক্ষা করে নেই। গৎবাঁধা কিছু দায়িত্ব পালনের ব্যাপার আছে, আর তেমন কিছুই বাকি নেই এই জীবনের কাছে।
কিছু স্মৃতি আছে ভীষণ জ্বলজ্বলে। সত্য ও সৎ অতীতের হাতছানি আছে। অতীতের কিছু চকচকে দিন আছে এই বয়ে চলা জীবনে। তাই কি উঠে পড়লাম এই ভোরে?
নিজের দিনলিপির সবচেয়ে রঙিন পাতায় লিখতে বসলাম। ‘চিন্তা, স্মৃতি’ কি মানুষকেই এতটা উতলা করে?
এবার ভেঙে বলি স্যার আপনাকে। হ্যাঁ স্যার, আপনাকই বলছি, আপনি জগৎজোড়া অর্থনীতিবিদ, রবীন্দ্র–গবেষক আনিসুর রহমান। আপনাকে মাত্র কয়েক দিন আগপর্যন্ত আনিস স্যার ডেকেছি, তাই-ই ডাকতাম আপনাকে। এখনো কি আপনার শরীর আছে ঢাকা শহরে, নাকি মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে? সঠিক খবর নেই আমার কাছে।
আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলার তীব্রতা ঘুম কেড়ে নিল।
খুব ভোরে একবার ঘুম ভেঙে যায় স্যার, এই ধরেন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে। বিছানার পাশে রাখা সেলফোন তুলে নিই। দেখি, কোনো খবর অপেক্ষা করে আছে কি না।
আজকে দেখি, ছেলের বাবা সাখাওয়াত ঢাকা থেকে মেসেজ দিয়েছে—‘প্রফেসর আনিসুর রহমান পাসড অ্যাওয়ে।’ অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত খবর স্যার। আরও ১৫ বছর আগে থেকেই তো আপনি চলে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু দুনিয়াতে আমাদের আগমন যেমন আমাদের হাতে নেই, তেমনি চাইলেই চলে যাওয়া যায় না। সে জন্য অনেক তিতা পথের যাত্রা পেরোতে হয়। আর আপনার পথ তো আরও কঠিন হবে, সে তো জানাই কথা, তাই না স্যার?
১৯৭২–৭৩ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়ে দেশ গড়ার জন্য খুব উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার মতের বিস্তর পার্থক্য হয়। সেসব কথা লেখা আছে বেশ কিছু বইয়ে। আর আপনার মুখে তো শুনেছি বহুবার, বহুভাবে।
সেসব অসাধারণ স্মৃতিগুলোই এই মুহূর্তে আমাকে শান্ত থাকতে দিল না স্যার, নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে টেবিলে চলে এলাম লিখতে।
সেই তো ১৯৭২-৭৩–এ অভিমান করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা দুনিয়ার কত বড় বড় সংস্থায় কাজ করলেন, বিশেষ করে ডোনারদের সঙ্গেসহ উন্নয়ন গবেষনায় অনেক অনেক অভিজ্ঞ হলেন আপনি। বিদেশেই কিন্তু দিব্যি থেকে যেতে পারতেন। ডোরা চাচি (ডোরা রহমান) তো চাননি আপনি আবার দেশে ফিরে আসেন। আপনার দুই মেয়েও চায়নি আপনি দেশে গিয়ে বিপ্লবী হবেন।
কিন্তু ওই যে আপনার অভিমানী মন, আপনি আনিস স্যার আবার দেশে ফিরলেন নব্বই দশকের দিকে। এবার আপনি আটঘাট করে চিন্তা করেছিলেন, একটা কিছু পরিবর্তন করার জোর চেষ্টা করবেন।
শুরু করেছিলেন স্যার, ভীষণভাবে শুরু করেছিলেন। তখন আমি সদ্য পাস করে বের হয়েছি। নানান এনজিওতে কাজ করি। পথেই দেখা হলো আপনার সঙ্গে।
১৯৯৪ কি ৯৫ হবে, কোনো এক উজ্জ্বল দিনে আপনি টিএসসি থেকে ফিরছিলেন। আমিও ছিলাম সেখানে। আপনাকে পথেই পাকড়াও করলাম। আপনার বই ‘উন্নয়ন গবেষণা’ পড়া ছিল। সেই নিয়েই আলাপ জুড়লাম। কথা বলতে বলতেই পথে থেকে ধরে নিয়ে এলাম আমাদের নায়েমের বাসায়।
মনে আছে স্যার আপনার?
আব্বা অফিস থেকে ফিরেছিলেন এর কিছু পরে। আপনাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে আব্বাকে পাশের ঘরে ডাকতে গিয়ে বললাম, ‘আব্বা, আনিস স্যারকে চেনো? স্যার ওই ঘরে বসে আছেন, চলো আলাপ করবা।’ আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে খুব বিস্ময় আর উদ্গ্রীব হয়ে বলেছিলেন, ‘কোথা থেকে তুই এই সব মানুষদের ধরে নিয়ে আসিস, এ তো মহা জ্বালা। আমি আনিস স্যারকে কেন চিনব না, সে তো আমার সরাসরি শিক্ষক। কত বড় মানুষ উনি, সেই হিসেব আছে তোর?’
না স্যার, আপনার ব্যাপারে অতটা হিসাব আমার ছিল না। আর ছিল না বলেই তো আজকে এই এত দূরে বসে আপনার কাছে ফিরছি স্যার। ভীষণভাবে ফিরছি। কি ভীষণ শিশুর মতো অভিমানী মন ছিল আপনার, কি ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন আপনি।
এত ভালো মানুষ কি দেশ পরিবর্তন করতে পারে স্যার? রাজনীতি করতে পারে? বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে?
৩৫ বছরের ব্যবধানে দেশে ফিরে আবার আপনি সেই ১৯৭২/৭৩ থেকে শুরু করলেন। আপনি বলতে শুরু করলেন, দেশে বিদেশি ফান্ড বন্ধ করতে হবে। দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আপনি সে সময়ের এনজিও নেতাদের পেটের ভেতরে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলেন। সবাইকে অল্প সময়ে নাড়িয়ে নিলেন আপনি।
কিন্তু ফল হলো বিরূপ।
কেন হবে না স্যার বলেন? স্বাধীনতার এতো বছর পরে তো আমাদের মাথাপিছু ঋণ অনেক, আমরা বিদেশি ফান্ডে ভীষণ অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমাদের পায়ে তখন অনেক মোটা মোটা শিকল, আমাদের অনেকের জীবনে তখন বিদেশি ডলার আর ফান্ড ভীষণভাবে দখল নিয়েছে, কেন আপনার কথায় এসব জায়গা থেকে আমরা বের হব?
সেই আমার চোখের সামনেই আপনার সঙ্গে দেশের অন্য সব উন্নয়ন ব্যবসায় জড়িত মানুষদের দূরত্ব বাড়তে থাকল, বাড়তেই থাকল। ২০০২–২০০৩ সালের দিকে ‘রিইব (রিসার্স ইনিশিয়েটিভ অব বাংলাদেশ)’ আপনাকে কিছুটা ব্যস্ত করে রাখল, আর আপনার প্রাণের ভেতরে বাজতে থাকল রবীন্দ্রসংগীত।
কানাডায় চলে এলাম ২০০৪ সালে। কতবার কথা বলেছি আপনার সঙ্গে, ডোরা চাচির সঙ্গে। বুঝতে পারতাম, আপনি ভীষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অন্য অনেকের সঙ্গে এবং সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল।
দেশে আমরা কেউ তৈরি ছিলাম না আপনার কথা নেওয়ার জন্য, কেন থাকব? আমাদের তো বাঁচতে হবে, খেতে হবে, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াতে হবে, নিজেদের ডলারে আয় করতে হবে। দেশকে স্বনির্ভর করতে গেলে, নিজেকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে গেলে অনেক দুঃসাহস লাগে, সেটা তো আমরা বিক্রি করেছি স্বাধীনতার দু–তিন বছর পরই, আপনি ৩৫ বছর পরে এসে আমাদের আবার সাহসী হতে বলবেন, তা কি হয় স্যার?
আপনার সঙ্গে অনেক অনেক স্মৃতি আর ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। তবু তো আপনি চেষ্টা করেছিলেন, সৎ ও একাগ্র চেষ্টা। বিদেশের সেট জীবন ফেলে দিয়ে দেশে গিয়েছিলেন, আপনি যে সৎ চেষ্টা করেছিলেন—মাত্র একজন মানুষও এ কথা অস্বীকার করবে না।
সেই কারণেই আমার মতো অনেক অনেক লুনা আজকে নীরবে আপনাকে মনে করবে। আব্বা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তাঁর কাছে আপনার কথা বলে কিছুক্ষণ কাঁদতাম। আব্বাও চলে গেছেন স্যার।
আপনি অনেক দিন বাঁচলেন। আমার মতো অনেকের কাছে আপনি আজন্ম বাঁচবেন। রাজপুত্রের মতো রূপ আর গুণ ছিল আপনার। বাংলাদেশ কি আর কোনো আনিসুর রহমান জন্ম দিতে পারবে কোনো দিন?
পরপারে দেখা হবে আপনার সঙ্গে, স্যার। অপেক্ষায় থাকলাম।
আপনাকে ভালোবাসতাম ভীষণ। আজকের চিঠিটা লিখলাম উজ্জ্বল গাঢ় নীল কাগজে। এ চিঠি রেখে দেব কাচের বয়ামে। ভীষণ অন্য রকম চিঠিটা কাচের বয়ামের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে রাখবে বছরজুড়ে।
বিনম্র সালাম জানবেন, স্যার। আপনি বাংলাদেশের ইতিহাস। আপনার চলে যাওয়া নেই।
লেখক: লুনা শিরীন, উন্নয়নকর্মী, টরন্টো, কানাডা
দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ