তুমি ও সন্ধ্যা-২

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

আদিলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে মোবাইল হাতে নিল। শানুর নম্বর সেভ করা আছে। ফোন দিল। ধরেই নিয়েছিল ফোন বন্ধ পাবে। ও অবাক হয়ে গেল। রিং হচ্ছে। তবে কেউ রিসিভ করছে না। কয়েকবার চেষ্টা করল। লাভ হলো না। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাগের ভেতর রাখা ছাতাটা খুঁজে পেল না। মনে পড়ল, আদিলুরের চেম্বারে ফেলে এসেছে। আর ফিরতে ইচ্ছা হলো না। কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে হেঁটে তারপর একটা রিকশা নিল। মিনিট দশেক পর শানুর নম্বর থেকে কল এল। রফিক নিজেকে বিশ্বাস করতে পারল না। কল রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-হ্যালো, শানু?
-কে বলছেন?

রফিক কণ্ঠ চিনতে পারল। আনু ফোন ধরেছে। শানুর ছোট বোন। ওদের দুই বোনের কণ্ঠ হুবুহু এক। এমনকি দেখতেও। সহজে আলাদা করার মতো নয়। তবে রফিক আলাদা করতে পারত। শানু একবার বাজি ধরেছিল। সামনে রেকর্ড করা বেশ কয়েটি অডিও। কোনোটায় কণ্ঠ দিয়েছে শানু। আবার কোনোটায় আনু। রফিকের দায়িত্ব কণ্ঠ অনুযায়ী আলাদা করা। সবাইকে চমকে দিয়ে রফিক সব কটি ঠিকঠাক আলাদা করতে পেরেছিল। শানু অবাক। এ কী করে সম্ভব!
-আনু, আমি রফিক।

অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। কলটা কেটে গেছে। রফিক ঘড়ি দেখল। প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। রিকশা করে ধানমন্ডি যেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। যাওয়ার সময় শাহবাগের মোড় থেকে কয়েকটি গোলাপ ফুল কিনে ব্যাগে লুকিয়ে ফেলল। আপাতত বের করা যাবে না। হালকা ঠান্ডার ভেতর দুজন একসঙ্গে রিকশা করেই ফিরবে বাসায় ফিরবে। তখন শানুর হাতে গোলাপগুলো গুঁজে দেবে। শানুদের বাসা চিনতে সমস্যা হয়নি। সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু দেয়ালের নতুন রং ছাড়া। মনে হচ্ছে, এখনো কাচা রঙের গন্ধ যায়নি। কলবেল একবারের বেশি বাজাতে হলো না। শানুর মা দরজা খুলে দিল।  রফিককে বসিয়ে তারপর বলল,
-শানু তো বাসায় নেই। তুমি কি কিছু শোনোনি?
-কী শুনব?
-তোমার ভাই-ভাবি কেউ কিছুই বলেনি?
-না!
-ওহ! এখন তোমার শরীরের কী অবস্থা? অনেক দিন তো কথা হয় না।
শানুর মা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলল।
-আমি ভালো আছি। শানু কখন বাসায় ফিরবে?
শানুর মা সরাসরি কোনো উত্তর দিল না। রফিককে হাত ধরে সোফায় বসাল। তারপর বলল,
-বাবা, তোমাকে খারাপ একটা সংবাদ দেব। মন খারাপ কোরো না।

রফিক বুঝতে পারল না কী খারাপ খবর অপেক্ষা করছে ওর জন্য।  তবু মনে মনে একটু সাহস করে বলল,
-হ্যাঁ অবশ্যই, বলেন।
-আসলে তোমার সঙ্গে বিয়েতে শানুর মত ছিল না। ওর বাবা একপ্রকার জোর করেই দিয়েছিল বিয়েটা।
-কই, আমি তো কোনো দিন বুঝতে পারিনি।
শানুর মা বলতেই লাগল,
-তুমি তো অ্যাকসিডেন্টে পাগল হয়ে গেলে। শানু প্রথম প্রথম বেশ কান্নাকাটি করত। তারপর একদম চুপচাপ হয়ে গেল। চার মাস আগে তোমার ঠিকানায় ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। আমরা এখানে আর বাধা দিতে পারিনি। ডিভোর্সের চিঠি হয়তো তোমার বাসার অন্যরা পেয়েছে।
-শানু এখন কোথায়?
-অস্ট্রেলিয়ায় আছে।
-আবার বিয়ে করেছে?
-হুম। তুমি বাবা মন খারাপ কোরো না। বুঝতেই পারছ। আমাদের অবস্থাটা।
রফিক কিছু বলল না। শানুর মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
-বাবা, তুমি আমার একটা কথা রাখবে?
-হুম। বলেন।
-আমি তোমার জন্য গরুর মাংস রান্না করব। তুমি আমার সামনে বসে খাবে। তারপর না হয় বাসায় যেয়ো।
রফিক কিছু বলল না। অল্প একটু মাথা ঝাঁকাল।

শানুর মা আনুর রুমে একটু উঁকি দিল। রুম অন্ধকার। ভেতরে কোনো শব্দ নেই। আনু চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছে।

-কিরে আনু, রুম অন্ধকার করে বসে আছিস কেন?
-এমনিতেই। ভালো লাগছে না।
-রফিক এসেছে, শুনেছিস?
-হুম।
-ছেলেটার পাশে একটু বসবি? একা একা বসে আছে।
-মা, আজ আমার মন খুব খারাপ। কেন খারাপ, তা জিজ্ঞেস কোরো না।
-কেন, কী হয়েছে?
-বললাম না। জিজ্ঞাস কোরো না। দয়া করে তুমি রুম থেকে যাও।
শানুর মা বের হয়ে এল।  আগে রফিক এ বাসায় এলে আনু আঠার মতো লেগে থাকত। সম্পর্ক কত দ্রুত বদলে গেল। বাইরে বৃষ্টি আবার বেড়েছে। সঙ্গে দমকা বাতাস। রফিক জানালাটা বন্ধ করে দিল। তবু বন্ধ জানালা দিয়ে বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে। শানুর মা খাবার তৈরি করছে। রফিক ছেলেটির জন্য উনার অসীম একটা মমতাবোধ কাজ করে। কী জন্য, তা জানে না। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে, রফিককে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে আর কী খেতে ইচ্ছা করছে। মাংসে ঝাল একটু বেশি হলে সমস্যা হবে কি না। রফিক হু-হাঁ করে উত্তর দিচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণ আসা শুরু হয়েছে। রফিকের আজ কেন জানি রান্নার ঘ্রাণ সহ্য হচ্ছে না। ওর শাশুড়ির রান্নার হাত ভালো। রফিক খুব পছন্দ করত। বিয়ের প্রথম দিকে প্রায়ই গরুর মাংস রান্না করে পাঠিয়ে দিত ওদের বাসায়। কিচেন থেকে আসা গন্ধে রফিকের পেট গুলিয়ে যাচ্ছে। বাইরে পানির পড়ার শব্দ বেড়েছে। রফিক স্পষ্ট শোনতে পেল। পানির ফোঁটা সংখ্যা গণনা করছে। আগের মতো এক, দুই, তিন থেকে শুরু করেনি। ঘড়ির কাঁটার মতো করে বলছে, ১০, ২০, ৩০...ক্রমাগত চলছেই।  বুঝতে পারল, মাথাটা অল্প অল্প করে ঘুরছে। একই সঙ্গে মাথাব্যথাটাও ফিরে এসেছে। রফিক উঠে পড়ল। মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার আগেই বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার।

আনু রুম থেকে বের হয়ে দেখল, রফিক নেই। ভুল করে হাতের ব্যাগটা ফেলে গেছে। খুলে দেখল। কয়েকটি গোলাপ ফুল। একটু থেঁতলে গিয়েছে। তবে সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। ম-ম গন্ধ।  

রফিক প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে মাঝরাতে বাসায় ফিরেছে। পরদিন ঘুম ভাঙল বেলা ১১টার দিকে। রফিক দেখল, প্রায় আট ঘণ্টা টানা ঘুম হয়েছে। মাথাব্যথাটা কিছুটা কমেছে। তবে আগের সবকিছুই বেশ স্পষ্ট মনে করতে পারল। ওর অফিস ছিল বারিধারা এলাকায়। ভাবল, পুরোনো অফিসে একটু ঘুরে আসবে। চাকরিটা এখনো টিকে আছে কি না, খোঁজ নেওয়ার দরকার। অফিস ভবন খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। প্রথম চেষ্টাতেই সফল হয়েছে। তবে কপাল বেশ মন্দই।  বারিধারার যে ভবনে ওদের অফিসটি ছিল, তার হদিস খুঁজে পাওয়া গেল না। দারোয়ানের কাছে শুনল, আরও কয়েক মাস আগেই অফিসটি বন্ধ হয়ে গেছে। অফিস লাপাত্তা হয়ে গেলেও রফিকের মন ফুরফুরে লাগছে। স্মৃতিশক্তি দ্রুত ফিরে আসছে। রাস্তার পাশের টংদোকানটা চিনতে পারল। এখানে আগেও অনেকবার চা খেয়েছে। আজও এক কাপ খেল। স্বাদ একটুও বদলায়নি। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারের বৃষ্টি। রফিক হেঁটে বাসার দিকে রওনা দিল। বৃষ্টিতে ভিজতে খারাপ লাগছে না। বাসায় আসার আগে অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির পাশ দিয়ে ঘুরে এল। বাইরে লম্বা লাইন। বেশির ভাগই অল্প বয়সের ছেলে-মেয়ে। এ বয়সেই দল বেঁধে দেশ ছাড়ছে। বাসায় আসার পর খাবার খেল না। মাথাব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। শক্ত করে কম্বল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।  

আরও পড়ুন

রফিকের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার কিছু আগে। বুঝতে পারল, মাথাব্যথার সঙ্গে শরীরের উত্তাপ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ব্যালকনিতে চোখ গেল। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে।  একটা চাদর গায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এমন সময় হঠাৎ অতি পরিচিত ফুলের ঘ্রাণ নাকে ভেসে এল। রফিক চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল, হাসনাহেনা! জানো, আমার প্রচণ্ড ব্যথায় মাথাটা ভারী হয়ে গেছে। তোমার হাতের চা ছাড়া এ ব্যথা আর যাওয়ার নয়।

-এই নেন আপনার চা।  
রফিক চমকে গেল। গোধূলিবেলা। বৃষ্টি থামেনি এখনো। সন্ধ্যার মতো লাগছে। পেছন ফিরে দেখল, নীল রঙের শাড়ি পরা মেয়ে। চেনা চেনা লাগছে।
-তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
রফিক দেখল, মেয়েটি তার চেনা।  শানুর মতো দেখতে। হ্যাঁ, শানুই তো।
-কী, আবার আমার নাম ভুলে গিয়েছ?
-মেয়েটির নাম খুব ভালো করেই মনে আছে। রফিক এবার হেসে উত্তর দিল,
-শানু।
রফিককে অবাক করে দিয়ে শানু বলল,
-আমি শানু নই। আমি হেনা।  হাসনাহেনা।  

রফিক চা নিল। আজ দুই কাপ চা রাখা আছে। শানুর নিজের জন্যও এক কাপ বানিয়েছে। সঙ্গে কিছু ঝালমুড়ি। খেতে মন্দ লাগছে না। অল্প অল্প বৃষ্টির ফোঁটা ভেতরে আসছে। মাঝেমধ্যে দুজনের ভেতর চোখাচোখি হচ্ছে। কেউ কথা বলছে না। শানু লাজুক হাসি দিয়ে বৃষ্টির ভেতর একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ধবধবে ফরসা হাতে মেহেদির আলপনা করা। কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ একটা সুর তুলে পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কিছুক্ষণের ভেতর ওর তুলতুলে বাচ্চা মেয়েটিও চলে এল। সে আজ ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছে না; বরং নরম হাতে রফিকের গলায় জড়িয়ে ধরেছে। একটু পরপর আদুরে গলায় বলছে, পাপ্পা রেইন হচ্ছে। রেইন হচ্ছে। রফিক দেখল, বৃষ্টির ভেতর মাঝরাস্তায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। পরিচিত একটি চেহারা। আনুর মতো। হ্যাঁ আনুই। বৃষ্টির কারণে পুরো বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকছে। রফিক কোনো উত্তর দিল না। চোখ ঘুরিয়ে শানুর দিকে তাকাল। নাহ, আজ অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে সুমধুর মাগরিবের আজানের সুর ভেসে আসছে। আজ এ মায়াবী জগৎ ছেড়ে রফিকের কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।

**দূর পরবাসে লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]
*লেখক: বদরুজ্জামান খোকন; পিএইচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান