তুমি ও সন্ধ্যা-১

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

 সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। হঠাৎ রফিকের ঘুমটা ভাঙল। ব্যালকনিতে পানি পড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। টপ টপ শব্দ। রফিক গুনতে শুরু করল। এক, দুই, তিন, চার...রফিক অবাক হয়ে শুনল পানির ফোঁটাগুলো এখন নিজ থেকেই গুনে দিচ্ছে পাঁচ, ছয়, সাত, আট...নিজের কান দুটিকে বিশ্বাস করতে পারল না। এ কী করে সম্ভব। একটু পর আবার স্পষ্ট শুনতে পেল, পঁচিশ, ছাব্বিশ! আরে, আসলেই তো! ওরা গুনেই যাচ্ছে। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকাল। টিক টিক শব্দ করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। একটু পর মনে হলো ঘড়ির কাঁটাও সংখ্যা গুনছে! দশ, বিশ, ত্রিশ...এ রকম হচ্ছে কেন? বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে ঘড়ির কাঁটার গণনায় প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। রফিকের মনে হলো ওর মাথায় কিছু একটা হয়েছে। চারদিকে শোরগোলের শব্দ। দুই কানে শক্তভাবে আঙুল দিয়ে চেপে ধরল। লাভ হলো না। বৃষ্টির ফোঁটা আর ঘড়ির কাঁটার মধ্যে গণনার প্যাঁচ এখনো শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওরা একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। গায়ের ওপর কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। রফিক আর ভাবতে পারছে না।

 এমন সময় কেউ একজন এসে মুখের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে নিল। তারপর সোজা কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

 -মাথাব্যথাটা একটু কমেছে?

রফিক তাকিয়ে দেখল, অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে। মুখে লাজুকতার আভা। যেন সদ্য কিশোরীকাল পার করে এসেছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। এ কী করে সম্ভব! আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। কপালের ওপর ঠান্ডা নরম হাতটি এখনো রয়েছে।

 -কী, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছ কেন? ব্যথাটা কমেনি?

 রফিক এবার বলল,

 -ব্যথা?

 মেয়েটির ভ্রু কুঁচকে গেল।

 জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হলো, আমি কি আপনাকে চিনি? কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। একবার মনে হলো, পুরো ঘটনাই ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন। কী দরকার শুধু শুধু ঘুম ভেঙে। তার চেয়ে চলতে থাকুক। মন্দ লাগছে না। হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটিকে কোথাও যেন দেখেছে। তবে পুরোপুরি মনে করতে পারল না। রফিককে ভ্যাবাচেকা খাওয়া অবস্থায় দেখে মেয়েটি আরেকটু ঝুঁকে এল। তারপর কপালে হাত ভুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,

 -কী, কথা বলছ না কেন? ব্যথা সেরেছে?

 -হুঁ।

 ‘হ্যাঁ’সূচক উত্তর শুনে মেয়েটি এবার হাসল। মিষ্টি একটি হাসি। হাসির রেশ যেন সারা চোখেমুখে একাকার হয়ে ঢেউ খেলে গেল। রফিক এই হাসির সঙ্গে পরিচিত। কোথায় যেন শুনেছে। রফিক বৃষ্টির শব্দ শোনার চেষ্টা করল। নাহ, আগের মতো গণনার শব্দ আসছে না। বরং হাসির শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

 -তুমি কি আসলেই আমাকে চিনতে পারছ না?

 -না।

 -আমার নাম?

 -নাহ! পারছি না! তবে...

 -তবে কী?

 -তোমার গায়ের গন্ধ খুব পরিচিত লাগছে।

 -ওহ তা-ই? কিসের মতো?

 -হাসনাহেনা ফুল!

-মেয়েটি একটা কপট রাগের ভাব ধরে একটা মুচকি হাসি দিল। তারপর আবার বলল,

 -তাহলে তো ভালোই হলো। আজ থেকে আমি হেনা। পুরো নাম হবে হাসনাহেনা। বলেই হাসতে লাগল।

 রফিক হেনা নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়। কোথায় ভুল হয়ে যাচ্ছে, তা ধরতে পারল না।

 -চা খাবে? তাহলে দেখবে মাথার যন্ত্রণাটা একেবারেই চলে গিয়েছে।

 -হুঁ, খাব।

 হেনা নামের মেয়েটি চলেই যাচ্ছিল, এমন সময় রফিক অস্পষ্ট স্বরে বলল, চায়ে চিনি দিতে হবে না।

 এ কথা শুনে মেয়েটি পেছন ফিরে তাকাল। তারপর কপাল ও গলায় হাত দিয়ে আরেকবার দেখল জ্বর আছে কি না।

 -নাহ, জ্বর নেই শরীরে।

 তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করল,

 -তুমি কিন্তু আসলেই সব সময় চিনি ছাড়া চা খাও।

 রফিক কী বলবে বুঝতে পারল না। হুটহাট করে কোনো কিছু ভুলে যাওয়া ওর পুরোনো রোগ। বলতে গেলে জেনেটিক্যালি পেয়েছে। রফিকের বাবা অ্যালঝেইমারের রোগী ছিল। প্রথম দিকে তেমন সমস্যা ছিল না। শুধু মাঝেমধ্যে নিজের ছেলেদের নাম ভুলে যাওয়া ছাড়া। দেখা যেত, অনেকক্ষণ ছেলেদের দিকেও তাকিয়েও নাম মনে করতে পারছে না। আবার কখনো বড় ছেলে শফিককে, রফিক ডাকা শুরু করত। তবে সমস্যাটা প্রকট হয়েছিল চাকরির শেষ দিনগুলোয়।

রফিক দেখল কিছু পানির ঝাপটা রুম পর্যন্ত চলে আসছে। বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। হিমশীতল পরিবেশ। পাশের মসজিদ থেকে সুমধুর আজানের সুর ভেসে আসছে। এখান থেকে গলির রাস্তাটা দেখা যায়। রফিক তাকিয়ে দেখল, আজ রিকশার ভিড় নেই। কয়েকটি ছোট ছেলে কাকভেজা হয়ে সেখানে ফুটবল খেলছে। দেখতে খারাপ লাগছে না। ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। বাদলাদিনে সন্ধ্যা একটু আগেভাগেই নামে। এমন সময় মেয়েটির নাম মনে পড়ে গেল। ওর নাম হেনা নয়, শানু। রফিক মনে মনে হাসল। ঘুমের ঘোরে নিজের স্ত্রীর নামই ভুলে গিয়েছিল।

 ব্যালকনির এক পাশে একটি ছোট চেয়ার আর টেবিল আছে। রাতের বেলা এখানে আরাম করে বসা যায়। রফিক দেখল সেখানে এক কাপ চা রাখা আছে। অবাক হয়ে গেল। এখানে চা কখন রাখল।

 -কী, এখন একটু ভালো বোধ করছ?

 রফিক পেছন ফিরে দেখল, শানু দাঁড়িয়ে আছে।

 -কী, কথা বলছ না কেন? এখন একটু ভালো বোধ করছ?

 রফিক এবারও কোনো উত্তর দিল না। শুধু মিটিমিটি হাসতে লাগল।

 -কী, হাসছ কেন?

 -একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।

 -কী?

 -বিশ্বাস করবে?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রশ্ন শুনে শানু কপাল কুঁচকিয়ে ফেলল। রফিক স্পষ্টভাবে মনে করতে পারল। শানুর অল্পতেই কপাল কুঁচকিয়ে ফেলার বদভ্যাস আছে। বিয়ের সময় যেদিন প্রথম দেখা। ওদিনই ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল। তবে কাউকে বলেনি। রফিক গোপন করলেও কুঁচকিয়ে সমস্যাটা আরও একজন ধরতে পেরেছিল। রফিকের বড় ভাবি। রফিককে ঘরের এক কোনায় টেনে নিয়ে বলল,

 -দেখো ভাই, এ মেয়েকে খুব বেশি সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।

 -কেন, ভাবি। এত সুন্দরী একটা মেয়ে।

 -আরে রাখো তোমার সুন্দরী মেয়ে।

 রফিকের ভাবি হলিক্রস স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। সব সময় মেজাজ একটু চড়া। সাধারণ কথাবার্তাতেও উত্তেজিত হয়ে যায়। তবে মানুষ হিসেবে অসাধারণ। রফিক এবার সিরিয়াস হয়।

 -বলো তো ভাবি, কী সমস্যা দেখলে?

 -তোমার চোখে কিছু পড়েনি?

 -পড়েছে।

 -কী?

 -ওর হাসিটা। খুব সুন্দর।

 -তোমাদের পুরুষ মানুষের এই এক সমস্যা। রূপ দেখে পাগল হয়ে যাও। আগামাথা বিচারের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। মেয়েকে দেখলাম একটু পরপর তোমার দিকে তাকাচ্ছে। আর কপাল কুঁচকিয়ে ফেলছে। লক্ষণ ভালো ঠেকছে না।

 -ওহ। আমি তো ভেবেছিলাম টোল পড়েছে।

 দেবরের নির্বুদ্ধিতায় অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বলল,

 -আরে হুতোম, টোল পড়ে গালে। কপালে না।

 শানুর সিরিয়াস সমস্যা আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে আটকাল না। বরং মহা ধুমধাম করেই হলো। জগতের বিচিত্রতম ঘটনা প্রকাশ পেল বিয়ের কয়েক দিন পর। দেখা গেল, শানু আর বড় ভাবির মধ্য সবচেয়ে দহরম-মহরম সম্পর্ক। দুজন মিলে সারাক্ষণ কুটুরকুটুর কথা বলে। মাঝেমধ্যে হাসিরও শব্দ শোনা যায়। রফিকের খুব ইচ্ছা ওরা কী নিয়ে এত কথা বলে, তা শোনা। কিন্তু তা হয় না। রফিককে দেখলে চুপ হয়ে যায়। যেন তৃতীয় পক্ষের কেউ।

 -কী বলছ না কেন? কী ঘটনা ঘটে গেল।

 শানুর কথায় সংবিৎ ফিরল। রফিক হাসতে হাসতে বলল,

 -আমি তোমার নাম ভুলে গিয়েছিলাম।

 -এখন মনে পড়ল?

 -হুঁ।

 -বলো তো আমার নাম কী?

 -শানু!

 রফিকের কথায় শানু মোটেও অবাক হলো না। তারপর বলল, আর কারও কথা মনে আছে?

 -হ্যাঁ। মনে থাকবে না কেন?

 -আমাদের বিয়ের কথা?

 -হুঁ।

 তোমার গ্রামের বাড়ির কথা।

 -অবশ্যই।

 এমন সময় ধীরপায়ে কে যেন এগিয়ে এল। একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে। তুলোর মতো। রফিক চিনতে পারল। ওদের মেয়ে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসছে না। রফিক হাতের ইশারায় ডাক দিল। এল না। দূর থেকেই আবার রুমের ভেতর চলে গেল।

 -ও চলে গেল কেন?

 কোনো জবাব পায় না। রফিক আবার ডাক দেয়,

 -শানু?

 আবার কোনো সাড়া না পেয়ে পেছনে তাকাল। নাহ, কেউ নেই। এমনকি শানুও! একজন মানুষ কিনা ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। রফিক ভয় পেয়ে গেল। চায়ের কাপটি এখনো ওর হাতে। অদ্ভুত ব্যাপার। একটু পর বাসার কাজের মেয়েটি চায়ের কাপ নিয়ে গেল। রফিক ওকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থেমে গেল। রফিক ঘামছে। ভাবল, একজন সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে কথা বলার দরকার।

 রুমে গিয়ে ওর গোপন ডায়েরিটা বের করল। তারপর পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি লিখল। ডায়েরির পাতার বিগত দিনের লেখাগুলো পড়তে গিয়ে একটা মজার ব্যাপার আবিষ্কার করল। দেখল, একই রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। এক-দুবার নয়। বহুবার। সব কটি ঘটনার তারিখের নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া। আর সবার নিচে লাল কালিতে লেখা

  ‘ড. আদিলুর রহমান, নিউরো সায়েন্টিস্ট (এমআইটি, ইউএসএ)

 চেম্বার: এলিফ্যান্ট রোড, ১২ নম্বর বাসা।’

 ডায়েরির ঠিকানা একটা কাগজে লিখে বের হয়ে পড়ল। বৃষ্টির দিন হওয়ায় রাস্তা ফাঁকা। সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে আসতে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লেগেছে। কপাল ভালোই বলতে হবে। চেম্বারে অল্প কিছু রোগী। বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ। দেখা গেল ঘণ্টাখানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। অপেক্ষা করার সময়টায় একটা মজার ব্যাপার ঘটল। ওয়েটিং রুমে বড় করে ড. আদিলুরের ছবি। রফিকের মনে হলো আগে কোথায় যেন এ রকম চেহারার একটি মানুষ দেখেছে। হঠাৎ মনে পড়ল। আদিলুর ওর হাইস্কুলজীবনের বন্ধু। তুইতোকারি পর্যায়ের সম্পর্ক ছিল। স্কুলে মজা করে ডাকত আদু। তারপর আর যোগাযোগ ছিল না। এখন কীভাবে আদিলুরের ঠিকানা ওর ডায়েরির পাতায় এসেছে মনে করতে পারল না। সব রোগী বিদায় নেওয়ার পর আদিলুর সাহেব রফিককে নিয়ে বসলেন। অস্বস্তি নিয়ে রফিক সবকিছু বলতে শুরু করল। রফিক খেয়াল করল, ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলায় আদিলুর সাহেবের চোখেমুখে বিব্রতবোধ আর দ্বিধার ভাব ফুটে উঠেছে। এমনকি একপর্যায়ে রফিককে থামিয়ে, অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে রফিকের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল,

 -রফিক, আমার ব্যাপারে তোর কিছু মনে আছে?

 -হুঁ

 -কী মনে আছে?

 -স্কুলের কথা।

 -আর কিছু?

 -নাহ।

 -ওয়াও, গুড এনাফ। আমি তোর বন্ধু। আমার কাছে ভণিতা কিংবা লুকোচুরির দরকার নেই। ওকে?

 এবার রফিকের অস্বস্তি দূর হলো। একটু সময় নিয়ে বলল,

 -একটা বড় রকমের সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।

 -কী হয়েছে বল তো। কিছুই যেন বাদ না যায়।

 রফিক শানুর কথা, বাচ্চা মেয়েটির ব্যাপারটা বলল। তবে ডায়েরির লেখাগুলোর ব্যাপারে কিছু বলল না।

 -এখন আর শানুকে দেখতে পাচ্ছিস না?

 -না!

 -শেষ কবে দেখেছিস?

 -আজ সন্ধ্যায়।

 -তার আগে কবে?

 রফিক মনে করতে পারল না। তবে ওর ডায়েরিতে লেখা ছিল।

 -কী মনে করতে পারছিস না?

 -নাহ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

 আদিলুর একটি ফাইল এগিয়ে দিল। শুরুতে দিন-তারিখসহ সব আছে। লেখাটি রফিক চিনতে পারল। স্পষ্ট অক্ষরে ওর নিজেরই লেখা। তারিখ অনুযায়ী সর্বশেষ এসেছিল মাসখানেক আগে। ফাইলের কাগজগুলোয় প্রতিবার একই রকম ঘটনা। সব কটি উল্টেপাল্টে দেখল।

 -মাসখানেক আগে আমার সামনে বসে ঠিক আজকের এই ঘটনাটাই লিখেছিলি। মনে পড়ছে?

 -নাহ। কিছুই মনে রাখতে পারি না। পেছনের সবকিছুকেই ধূসর মনে হয়। তবে একটা ব্যাপার ছাড়া।

 -তবে কী?

 -একটা গন্ধ সব সময়ই পাচ্ছি।

 -কিসের গন্ধ?

 -হাসনাহেনা ফুলের মতো।

 -এখানেও পাচ্ছিস?

 -হুঁ। তবে আগের মতো তীব্র নয়।

 আদিল হাসল।

 -তুই হাসছিস?

 -আরে হাসব না। তোর অবস্থার অনেক উন্নতি হয়ে গিয়েছে। আমি যে তোর বন্ধু, এটা আজকেই প্রথম বলতে পারলি। আগেও জিজ্ঞাসা করেছি। পারিসনি।

 -মানে?

 -আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহে হ্যালুসিনেশন হতো। এখন তার ফ্রিকোয়েন্সি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র মাসে একবার।

 -এসবের মানে সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।

 -মানে সিম্পল। বছরখানেক আগেকার একটা দুর্ঘটনার কথা মনে আছে।

 রফিকের পুরো ঘটনা মনে নেই। কিছু ঝাপসা স্মৃতি মনে করতে পারল,

 -হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তবে খুব ডিটেইলস মনে করতে পারছি না।

 রফিকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপর বলল,

 -তোর বাবা আলঝেইমারের রোগী ছিল, তা মনে আছে?

 -হুঁ। অনেকটাই মনে করতে পারি।

 -ওকে। তাহলে বুঝতেই পারছিস। এমনিতেই জেনেটিক্যালি তোর আলঝেইমারের ঝুঁকি ছিল। আর ওই দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়ায় সমস্যাটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। একদিকে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে হ্যালুসিনেশন। এ দুয়ের ফলে তুই একটা কমপ্লিকেটেড সমস্যার ভেতর দিয়ে এসেছিস।

 -তার মানে? সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে?

 -নাহ। পুরোপুরি না। আলঝেইমারের কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত নেই। তবে আশার কথা হল, হ্যালুসিনেশন সমস্যাটা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিস।

 -আচ্ছা, তাহলে কি শানুর পুরোটাই হ্যালুসিনেশন?

 -না, আংশিক। প্যারিসের মতো। অর্ধেক নগরী তুমি অর্ধেক কল্পনা।

 বলেই আদিলুর হাসতে শুরু করল। কেউ হাসির কিছু বললে অন্তত ভদ্রতার খাতিরেও হাসতে হয়। কিন্তু রফিকের হাসির রেশমাত্র এল না। ওর জীবনের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল ঘটনা জানতে চলেছে এখন। আদিলুর আবার বলতে শুরু করল,

 -শানু তোর স্ত্রী। তবে...

 -তবে কী?

 -মাস ছয়েক আগেই তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছে!

 -তার মানে, শানুর সবকিছু হ্যালুসিনেশন!

 রফিক বিড়বিড় করে আরও অনেক কিছু বলল। তবে বোঝা গেল না।

 রফিককে চা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবে ওর ইচ্ছা নেই। আদিলুর রিভলভিং চেয়ারে দুল খেতে খেতে চা শেষ করল। তারপর আলতো করে রফিকের হাত ধরে বলল,

 -দোস্ত, সত্যি বলতে কি শানু চলে যাওয়ার পর থেকে এই সমস্যা শুরু। তিন ধরনের হ্যালুসিনেশন একসঙ্গে। ক্যান ইউ ইমাজিন!

 -তিন ধরনের?

 -হুঁ। মানুষ সাধারণত যেকোনো একটি সমস্যায় ভোগে। তোর কেসটা কমপ্লেক্স ছিল। একসঙ্গে ভিজুয়াল, অলফ্যাক্টরি আর ট্যাক্টাইল। ফলে তোর কল্পনায় ওদের এত জীবন্ত মনে হতো। যেন সত্যি সত্যি ওদের কথা শুনতে পারতি। দেখতে পারতি। এমনকি ট্যাক্টাইল হ্যালুসিনেশন কারণে স্পর্শ পর্যন্ত অনুভব করতে পারতি! এটা কিন্তু আসলেই রেয়ার কেস।

 রফিক সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইল। ওর কাছে সবকিছুই এখন ঝকঝকে পরিষ্কার। শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া।

 -একটা প্রশ্ন করব?

 আদিলুর হেসে বলল,

 -হুঁ, অবশ্যই। বল।

 -আমি তোর চেম্বারের ঠিকানা কীভাবে পেয়েছিলাম?

 -ইউএস থেকে আসার পর তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের দাওয়াত দেব। আর পেলাম রোগীকে!

 বলেই আবার হাসতে শুরু করল। রফিকের স্পষ্ট মনে আছে আগে কথায় কথায় হেসে ফেলার ছেলে আদিলুর ছিল না। বরং বয়সের চেয়ে একটু বেশিই রাশভারী ছিল। সময় কত দ্রুত মানুষকে বদলে দেয়।

 রফিকের মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি চেয়ার থেকে পড়ে যাবে। দুই হাতে সামনের টেবিল চেপে ধরল। তারপর একটু স্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

 -একটা সত্যি কথা বলবি?

 -হুঁ, বল।

 -আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম?

 রফিকের নিজের কাছেই প্রশ্নটা হাস্যকর লাগছে।

 -মোটেও না। আদিলুর রফিকের হাত ধরে বলল, একদম না। জাস্ট প্রপার মেন্টাল সাপোর্ট পেলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। চলবে...

 *লেখক: বদরুজ্জামান খোকন; পিএচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান

 **দূর পরবাসে লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]